বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যায় সিলেট শহর। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের পাঠানটুলা এলাকা পুরো বর্ষা মৌসুমেই তলিয়ে থাকে।
৭ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, ৫:৪৭

এক মাসে চারবার ডুবেছে সিলেটবাসী

সিলেট নগরের জলাবদ্ধতা কাটাতে গত আট বছরে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা খরচ করেছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো উপকার হয়নি নগরবাসীর। মাঝখানে দুই বছর কিছুটা স্বস্তিতে কাটলেও এ বছর জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যাচ্ছে নগরের বেশির ভাগ এলাকা। নগরের প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও ঢুকে পড়ছে পানি। গত এক মাসে চার দফা পানিবন্দি হয়ে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে নগরবাসীকে।

নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ছড়া ও খাল উদ্ধারে গত বছর ডিসেম্বরে ২৩৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেকে পাস হলেও তার কাজ এখনো শুরু হয়নি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ কাজ শুরু হয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল।
দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ না করা, অপরিকল্পিত ড্রেনেজ-ব্যবস্থা, বিভিন্ন ছড়া ও খাল দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের ফলে নগরজুড়ে জলাবদ্ধতা দেখা দেয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। পাশাপাশি প্রতিদিন নগরের অন্তত ২৫ শতাংশ বর্জ্য ড্রেনে গিয়ে পড়ায় সেগুলো ভরাট হয়ে যাওয়াও এর বড় একটি কারণ। বৃষ্টির সময় ড্রেনগুলো উপচে ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে যায় নগরজুড়ে।

বৃষ্টিপ্রবণ সিলেটে বর্ষায় টানা বৃষ্টি নতুন নয়। কিন্তু এবারের মতো দীর্ঘ জলাবদ্ধতা আগে দেখা যায়নি। একটানা আধা ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। এতে বিভিন্ন এলাকায় মানুষ হয়ে পড়ছে পানিবন্দি। ভারি বৃষ্টি হলেই দরগাহ গেট থেকে চৌহাট্টা পর্যন্ত রাস্তা, সুবিদবাজার এলাকায় সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের লন্ডনী রোড, পাঠানটুলা, হাওয়াপাড়া, শিবগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার সড়ক তলিয়ে যায়। ডুবে থাকা ড্রেন ও রাস্তার গর্তে আটকে রিকশাসহ বিভিন্ন হালকা যান দুর্ঘটনায় পড়ার চিত্র তখন নিয়মিত। অনেক এলাকায় বসতবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকে পড়ে পানি। এবার নগরের প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজারের বিভিন্ন বিপণিবিতান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। বন্দরবাজারের ‘সিটি মিউনিসিপ্যাল মার্কেট’ এলাকায় অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। ফলে বৃষ্টি নামলেই দুর্ভোগে পড়ে যান কয়েক হাজার ব্যবসায়ী।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, নগরের ভেতর দিকে বয়ে গেছে ছোট বড় ২৫টি প্রাকৃতিক খাল, যা ছড়া নামে পরিচিত। ২৫টি ছড়ার দৈর্ঘ্য প্রায় ১০০ কিলোমিটার। ছড়াগুলোর অন্যতম হলো, মালনি ছড়া, কালীবাড়ি ছড়া, মঙ্গলী ছড়া, যোগিনী ছড়া, হলদি ছড়া, ভুবি ছড়া, গোয়ালি ছড়া, ধোপা ছড়া, ধুবড়ি ছড়া, কেওয়া ছড়া ও গাভিয়ার খাল। নগর কর্তৃপক্ষের হিসাব মতে, নগরের ছড়া দখল করে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ভবনের সংখ্যা এক হাজার ৫৯। তবে বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। ছড়ার ওপর গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল ভবন, মার্কেট, বাসা, কমিউনিটি সেন্টার ও ক্লিনিক।
২০০৯ সালে ছড়া উদ্ধারের জন্য ১১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে সিটি করপোরেশন। ২০১৩ সালে বর্তমান মেয়র দায়িত্ব গ্রহণের পর ড্রেনেজ-ব্যবস্থা সংস্কারে নেওয়া হয় ২০ কোটি টাকার প্রকল্প। তবে আরিফুল হক চৌধুরী মেয়র পদ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর থমকে যায় ছড়া উদ্ধার অভিযান। তখন পর্যন্ত অবৈধ স্থাপনার মাত্র ২০টি উচ্ছেদ করতে পেরেছিল সিটি করপোরেশন।

সিলেট নগরের ছড়া ও খাল রক্ষায় গত বছরের ডিসেম্বরে ২৩৬ কোটি ৪০ লাখ টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এর কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সরকার ২০০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা এবং সিলেট সিটি করপোরেশন ৩৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা দেবে। এর আওতায় সিলেটের ১৩টি ছড়ার ২৬ দশমিক ৯৬ কিলোমিটার আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া পাঁচ কিলোমিটার ইউটাইপ ড্রেন, সাড়ে তিন কিলোমিটার ওয়াকওয়ে এবং ১০ কিলোমিটার ছড়া ও খাল খনন করা হবে। প্রকল্পের আওতাভুক্ত ছড়া ও খালগুলো হচ্ছে মালনীছড়া, গোয়ালীছড়া, গাভীয়ার খাল, মুগনীছড়া, কালীবাড়ী ছড়া, হলদিছড়া, যুগনীছড়া, ধোপাছড়া, বুবিছড়া, বাবুছড়া, রত্নার খাল, জৈন্তার খাল ও বসুর খাল। প্রকল্পের আওতায় ৯টি ইক্যুইপমেন্ট কেনা হবে। এর মধ্যে রয়েছে এমপিএসআইবিআই এস্কাভেটর। উভচর এই এস্কাভেটর দিয়ে নদী খননও করা যাবে। কিন্তু নতুন বছরের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পের কাজই শুরু হয়নি। এর টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে বলে জানা গেছে। আগামী শীতে কাজ শুরু হবে বলে কর্তৃপক্ষ দাবি করলেও তা আদৌ সম্ভব হবে কি না তা এখনো নিশ্চিত নয়।

নগরের জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম জানান, এর মূল কারণ সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং নগর সংস্থার কাজের ধারাবাহিকতার অভাব। একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যখন বিভিন্ন জটিলতায় দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হন, তখন তার খেসারত নগরবাসীকে দিতে হয়। নগরের ছড়া উদ্ধার ও সংস্কারের উদ্যোগ ব্যাহত হওয়ায় এ বছর জলাবদ্ধতার কারণে নগরবাসীর এ ভোগান্তি বলে তিনি মন্তব্য করেন।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/07/07/516282