৭ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, ৫:৩৩

পুলিশের চেকপোস্টের সামনে থেকে অপহৃত হন ফরহাদ

ফরহাদ মজহারফরহাদ মজহার যে স্থান থেকে অপহৃত হয়েছিলেন বলে আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, সেটি তাঁর বাসা থেকে প্রায় ১০৫ কদম দূরে। সেখানেই পুলিশের চেকপোস্ট রয়েছে। পুলিশের সদস্যরা সেখানে ২৪ ঘণ্টাই পাহারায় থাকেন। তবে ঘটনার দিন যাঁরা চেকপোস্টে দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা অপহরণের বিষয়ে কিছু জানেন না বলে পুলিশ দাবি করেছে।

রাজধানীর শ্যামলী মোড় থেকে পশ্চিম দিকে রিং রোড ধরে ৪০০ মিটারের মতো এগোলে হাতের ডান পাশে হক গার্ডেন। মূল সড়ক থেকে পাঁচ-সাত কদম ভেতরে ভবনটি। এর চতুর্থ তলার একটি ফ্ল্যাটে স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহার। গত সোমবার ভোরে ওই বাসা থেকে বের হওয়ার পর তিনি অপহৃত হন। পরে রাত সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশ যশোরের অভয়নগরের নওয়াপাড়ায় একটি ঢাকাগামী বাস থেকে তাঁকে নামিয়ে আনে। পরদিন তাঁকে ঢাকায় আনা হয়।

গত মঙ্গলবার আদালতে জবানবন্দিতে ফরহাদ মজহার বলেছেন, ‘আমি বাসা থেকে বের হয়ে পূর্ব (বাঁ) দিকে ঢাকা সেন্ট্রাল মেডিকেল হাসপাতালের দিকে হেঁটে রওনা হই। আমি গোল্ডেন স্ট্রিটের গলির কাছাকাছি পৌঁছামাত্র একটি সাদা মাইক্রোবাস আমার পাশে এসে দাঁড়ায় এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনজন লোক নেমে আমাকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়।’

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটার দিকে শ্যামলীতে গিয়ে দেখা যায়, গোল্ডেন স্ট্রিটের গলিটি ফরহাদ মজহারের বাসা থেকে প্রায় ১০৫ কদম দূরে। স্বাভাবিকভাবে ধীরগতিতে হেঁটে একজন যুবকের এই দূরত্ব পার হতে এক মিনিটের মতো সময় লাগে।
পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে ফরহাদ মজহার বলেছেন, ‘আমি একটু দ্রুতই হাঁটছিলাম।’ এ ক্ষেত্রে ৭০ বছর বয়সী ফরহাদ মজহার হয়তো ওই সময় বা তার কিছু কম সময়ের মধ্যে ওই জায়গায় পৌঁছেছিলেন।
মূল রাস্তা থেকে যে গলিটি ‘গোল্ডেন স্ট্রিট’ হয়ে ভেতরে ঢুকে গেছে, তার বাঁ পাশে ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল হাসপাতাল এবং ডানে পুলিশের চেকপোস্ট।
গতকাল হাসপাতালের সামনে নিরাপত্তাকর্মীর দায়িত্ব পালন করছিলেন অমর। একটি বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের হয়ে এক মাস ধরে তিনি এখানে বিভিন্ন শিফটে (দিনে ও রাতে) দায়িত্ব পালন করেছেন বলে জানান। তিনি বলেন, চেকপোস্টটিতে সব সময়ই পুলিশের সদস্যরা থাকেন।
গতকাল বিকেলে সেখানে আদাবর থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে চার-পাঁচজন পুলিশ সদস্যকে পাহারা দিতে দেখা যায়। জয়নুল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, ২৪ ঘণ্টাই এখানে পুলিশের পাহারা থাকে। কোনো গাড়িকে সন্দেহজনক মনে হলে তাঁরা চেক করেন। ফরহাদ মজহারকে এখান থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারব না। থানায় গিয়ে ওসি স্যারের সঙ্গে কথা বলেন।’
ফরহাদ মজহারের বাসা থেকে হেঁটে ঘটনাস্থলে যেতে হলে ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল হাসপাতালের সামনে দিয়েই যেতে হয়। হাসপাতাল ভবনের সামনের দিকে তিনটি সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে। একটি ক্যামেরা মূল প্রবেশপথের ওপরে, একটি ভবনের একেবারে সামনে এবং অন্যটি দ্বিতীয় তলার মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সামনে।
বিকেলে হাসপাতালের ফিন্যান্সিয়াল কন্ট্রোলার দেলোয়ার হোসেনের কাছে গেলে তিনি বলেন, সামনের সিসি ক্যামেরাটি হাসপাতালের সামনের রাস্তার ফুটেজ সংগ্রহ করতে পারে। পুলিশ এসেছিল। কিন্তু তারা ফরহাদ মজহার যাতায়াত করেছেন এমন কোনো দৃশ্য পায়নি বলে জানিয়েছে।
আদাবর থানা এলাকাটি পুলিশের তেজগাঁও অঞ্চলের আওতাধীন। তেজগাঁও অঞ্চলের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারের কার্যালয়ে গতকাল সন্ধ্যায় তাঁর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, চেকপোস্টে পুলিশের সদস্যরা ছিলেন। কিন্তু তাঁরা কেউ ফরহাদ মজহারকে তুলে নিয়ে যাওয়ার কোনো দৃশ্য দেখেননি। তিনি বলেন, হাসপাতালের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে রাস্তার কোনো দৃশ্য নেই।
হাসপাতালে গোয়েন্দা নজরদারি
রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের ১১ তলার একটি কেবিনে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ফরহাদ মজহার। গতকাল দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, এক সারিতে সাতটি কেবিন রয়েছে। অন্যান্য কেবিনের দরজায় রোগীর পরিচয় লেখা থাকলেও ফরহাদ মজহারের কেবিনে তেমন কিছু নেই। তাঁর দরজার সামনে একটি গোয়েন্দা সংস্থার উপপরিদর্শক পদমর্যাদার একজন সদস্য দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আলাপচারিতায় এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, সারা দিনই তাঁদের কেউ না কেউ এখানে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এসেছেন সকাল নয়টায়। ফরহাদ মজহারের কেবিন থেকে ওই সময় দুজন ব্যক্তি বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁদের নাম জিজ্ঞেস করতে দেখা গেল তাঁকে। এই প্রতিবেদকেরও নাম-ঠিকানা জেনে নেন তিনি।
‘ট্রমায়’ ফরহাদ মজহার
ফরহাদ মজহারের কেবিনের দরজায় টোকা দিলে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন সীমা দাস নামে উবিনীগের কর্মী। তিনি বলেন, ফরহাদ মজহারের স্ত্রী রাতে তাঁর দেখাশোনা করেন। আর তিনি সকালে আসেন। ফরহাদ মজহার কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তিনি ট্রমাটাইজড (আতঙ্কগ্রস্ত)। ডাক্তার জানিয়েছেন, ঠিক হতে সাত দিন সময় লাগতে পারে। এক মাসও লাগতে পারে। খুব কম কথা বলছেন। ঘুমাতে পারছেন না। বসে থাকলে চুপ করে বসে থাকছেন। মাঝে মাঝে মনে হয় তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু কাছে গেলে দেখা যায় জেগে আছেন। খেতে পারছেন না। সকালে একটি রুটি খেয়েছেন। ডাক্তার জানিয়েছেন, তাঁকে মনোবিজ্ঞানীকে দেখাতে হবে।’
ফরহাদ মজহার বারডেমের চিকিৎসক এ কে এম মুসার তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন। মুঠোফোনে এই চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেন, ফরহাদ মজহার সুস্থ রয়েছেন। তবে তিনি কিছুটা ভীতির মধ্যে রয়েছেন।
টেলিফোনে ফরহাদ মজহার প্রথম আলোকে বলনে, ‘আমি খুব ভালো নেই। প্রেসারে আছি, নার্ভাসনেসটাও আছে।’ টেলিফোনে তিনি এর বেশি মন্তব্য করতে চাননি।
জবানবন্দি
এদিকে যশোরে যে পরিবহনের বাস থেকে ফরহাদ মজহারকে উদ্ধার করা হয়েছিল, সেই হানিফ এন্টারপ্রাইজের খুলনা শিববাড়ী কাউন্টারের ম্যানেজার নাজমুস সাদাত ঢাকার আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। ঢাকার মহানগর হাকিম খুরশিদ আলম গতকাল বিকেলে তাঁর খাসকামরায় সাক্ষী হিসেবে নাজমুস সাদাতের জবানবন্দি ১৬৪ ধারায় রেকর্ড করেন।
অপহরণ মামলার নতুন তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মো. মাহবুবুল হক ঘটনার সাক্ষী হিসেবে নাজমুস সাদাতকে আদালতে হাজির করে জবানবন্দি নেওয়ার আবেদন করেন।
জবানবন্দির ব্যাপারে জানতে চাইলে নাজমুস সাদাত প্রথম আলোকে বলেন, জবানবন্দিতে তিনি বলেছেন, গত সোমবার বেলা ৩টা ৪০ মিনিটে খুলনার শিববাড়ী কাউন্টারে এসে এক ব্যক্তি এসি বাসের টিকিট চান। তিনি নাম জিজ্ঞাসা করলে ওই ব্যক্তি নিজেকে গফুর বলে জানান। ওই নামে তিনি টিকিট দেন। রাতে টেলিভিশনে সংবাদ দেখে তিনি জানতে পারেন, সেই ব্যক্তির নাম ফরহাদ মজহার।
নাজমুস সাদাত বলেন, ঢাকা থেকে পুলিশ কর্মকর্তারা এসে বলার কারণেই তিনি আদালতে এই জবানবন্দি দিয়েছেন।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1241406/