৭ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, ৫:৩১

পুরান ঢাকার ইসলামবাগে ঘন ঘন ট্রান্সফরমার

জীবিকার প্রশ্নে ঝুঁকি নিয়েই বাস

লালবাগের ইসলামবাগে ঘনবসতি, কারখানাও আছে অনেক। তাই বিদ্যুতের ব্যবহারও বেশি। যত্রতত্র বসানো হয়েছে ট্রান্সফরমার। কোনোটা মাথার একটু ওপরেই, আবার কোনোটা জানালার পাশে, যা ঝুঁকিপূর্ণ l ছবি: প্রথম আলোনিজ ঘরে ছয় বছরের মেয়ে কুলসুমের পিঠের দগদগে ঘায়ে মলম লাগাচ্ছিলেন বাচ্চু মিয়া। গত ১৯ জুন এই ঘরে বাবা-মেয়েসহ পরিবারের অন্যরাও ছিল। ঘরের লাগোয়া ট্রান্সফরমার থেকে ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে টিনের চালে পড়ে মুহূর্তেই পুরো ঘর পরিণত হয় ‘বিদ্যুৎ চেম্বারে’। ভেজা সিঁড়ি ধরে নামতে গিয়ে প্রাণ হারান বাচ্চুর মা আমেনা বেগম (৬০), স্ত্রী শিরীন আক্তার (৩০) ও এক মেয়ে আফরিন (৮)। আহত হয় কুলসুম।

পুরান ঢাকার ইসলামবাগে বাচ্চু মিয়ার বাড়ি। বাড়ির দোতলায় টিনশেডের তিন ঘরে তাঁরা থাকেন। ফায়ার সার্ভিস, ভুক্তভোগী পরিবার ও এলাকাবাসী বলছেন, ঘন ঘন স্থাপিত বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, বাড়ির নিচে কারখানা আর ওপরে আবাসনব্যবস্থার কারণে পুরো এলাকাই বিদ্যুৎ ও আগুনের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে।

বুড়িগঙ্গা নদী (বেড়িবাঁধ) ঘেঁষে থাকা ইসলামবাগকে বলা যায় রাবার (ইভা), প্লাস্টিক ও স্যান্ডেল-জুতা তৈরির অন্যতম কেন্দ্র। এখানে এসব পণ্যের অসংখ্য ছোট কারখানার পাশাপাশি রয়েছে এসব তৈরির কাঁচামাল যেমন বিভিন্ন রাসায়নিক, প্লাস্টিকের গুটি, রং ইত্যাদির দোকান ও গুদাম, ভাঙারি প্লাস্টিকের গুদাম, প্লাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ কারখানা। কিন্তু এগুলোর বেশির ভাগেরই অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা ও ফায়ার লাইসেন্স নেই। বাসিন্দাদের জীবিকাও কারখানা এবং এসব ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল। বাচ্চু ও তাঁর পরিবারের কয়েকজনও প্লাস্টিকের গুদামে কাজ করেন।
২০১০ সালে নিমতলীতে রাসায়নিকের গুদাম থেকে আগুন লেগে আশপাশের ভবনগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিল, নিহত হয়েছিলেন ১২৪ জন। এরপর তালিকা করে ৮০০ রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা কেরানীগঞ্জে সরানোর উদ্যোগ নেয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ইসলামবাগ ও শহীদনগর ঘুরে এই উদ্যোগের ব্যর্থতাই চোখে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, জীবিকার প্রশ্নে তাঁরা নিরাপত্তার সঙ্গে আপস করেই থাকছেন।

বেড়িবাঁধ থেকে ঢাল বেয়ে নেমে যে রাস্তাটি ইসলামবাগের দিকে গেছে, তার দুই পাশের ঘরবাড়িগুলোর বেশির ভাগের পুরোটা অথবা একাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে কারখানা, গুদাম বা দোকান হিসেবে। মাথার ওপর তারের জট, সারিবদ্ধ ট্রান্সফরমার আর সরু গলি।
ইসলামবাগে প্রতিবছরই আগুন লেগে বা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি চারতলা একটি বাড়ির নিচতলার প্লাস্টিক কারখানায় লাগা আগুন পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে পড়লে তিনজন নিহত হন। দুর্ঘটনার পর কিছুদিন হইচই হয়, তারপর সব চুপচাপ। অবস্থাও বদলায় না।
কার কাছে বিচার চাইবেন বাচ্চু?
৪ জুলাই বাচ্চু মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছোট মেয়ে কুলসুমের শুশ্রূষা করছেন তিনি। মেঝেতে বসে থাকা শাশুড়ি হোসনে আরা বেগম মেয়ের জামাকাপড়ের ব্যাগ কোলে নিয়ে মাঝে মাঝেই কাঁদছেন।
সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করে বাচ্চুর ছোট বোন নাজনীন আক্তার বলেন, বৃষ্টি পড়ছিল। হঠাৎ বাইরে থেকে চিৎকার ভেসে আসে ‘আগুন, আগুন’। মুহূর্তে ঘরের স্টিলের আলমারি, লোহার দরজা তপ্ত ও লাল হয়ে ওঠে। তিনি দৌড় দেন। তাঁর পেছনে আফরিন। সিঁড়িটা ভেজা ছিল। সিঁড়ির মাঝামাঝি যাওয়ার পর যেন ঝাটকা খেয়ে নিচে ছিটকে পড়েন তিনি। আফরিন সিঁড়িতেই পড়ে যায়। তাঁর মা (আমেনা) ও ভাইয়ের (বাচ্চুর) স্ত্রীও সিঁড়িতে বিদ্যুতের ঝটকা খেয়ে পড়ে মারা যান। তবে মায়ের কোলে থাকা তাঁর (নাজনীন) আট মাসের মেয়ে মাথায় ও গলায় আঘাত পেলেও বেঁচে যায়।
বাচ্চু মিয়ার বাড়ির দুই পাশে তিনটি ট্রান্সফরমার। বাচ্চুর ভাই মো. জুম্মন বলেন, প্রায় ১০ বছর ধরে তাঁরা এভাবেই বাস করছেন। ভয়ে কেউ জানালার বাইরে হাতও দেন না।
গৃহকর্তা বাচ্চুর অভিযোগ, এত বড় ঘটনার পরও বিদ্যুৎ বিভাগ ট্রান্সফরমার সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে না। ওই ঘটনার বিচার দাবি করে তিনি বলেন, ‘কিন্তু কার কাছে বিচার চামু। আমরা গরিব মানুষ। মামলাও করিনি। পুলিশ নাকি করছে। কার কাছে বিচার চামু, কন!’
এ বিষয়ে ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ডিপিডিসি) ওই এলাকার সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ সাঈদ হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, বাচ্চু মিয়ার বাড়িতে ঘটা দুর্ঘটনার তদন্ত চলছে। পরিবারটিকে আর্থিক সহায়তার সুপারিশও করা হচ্ছে। ট্রান্সফরমার সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা হয়েছে, তিনি এখন বিদেশে আছেন। তিনি এসে যে জায়গা দেখিয়ে দেবেন, ট্রান্সফরমার সরিয়ে সেখানেই নেওয়া হবে।
এরপরও ঝুঁকি নিয়েই বসবাস
ইসলামবাগের রাস্তাগুলোর দুই পাশেই অনেক ট্রান্সফরমার। লোকজন বলেছেন, প্রায়ই ট্রান্সফরমার বিস্ফোরিত হয়, লোকজন আহত হয়। ডিপিডিসির কর্মকর্তারা বলেন, এই এলাকায় প্রচুর প্লাস্টিক কারখানা হওয়ায় ভারী যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য তাদের চাহিদা অনুযায়ী এসব ট্রান্সফরমার বসানো হয়েছে।

রাজনারায়ণ ধর সড়কের দুধ মিয়ার গলিতে ব্যবসায়ী আবদুস সাত্তার বলেন, এখানে এ রকম ব্যবস্থাই চলে আসছে বছরের পর বছর। প্রায়ই ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু যেহেতু জীবিকার প্রশ্ন, তাই নিরাপত্তার সঙ্গে আপস করেই থাকতে হয়।
ফায়ার সার্ভিসের লালবাগ স্টেশনের দায়িত্বে থাকা ওয়্যারহাউস পরিদর্শক নাসরিন সুলতানা বলেন, এই এলাকায় খুব ঘন ঘন ট্রান্সফরমার স্থাপন করা হয়েছে, যা ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এ ছাড়া এখানে আবাসিক ভবনে স্থাপিত কারখানাগুলোর তারের ওয়্যারিং ভালো না, উচ্চ ভোল্টেজের তারও এলোমেলোভাবে ঝুলে থাকে। যার কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়। তিনি বলেন, এখানকার কারখানাগুলোর বেশির ভাগেরই ফায়ার লাইসেন্স, অগ্নিনিরাপত্তার প্রস্তুতি নেই। পানির উৎস নেই। বেশির ভাগ কারখানার ওপর বসতবাড়ি। এ ধরনের ব্যবস্থা আরও ঝুঁকিপূর্ণ।

কারখানা ও গুদাম স্থানান্তরের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা বলেন, সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু বাস্তবায়ন করা যায়নি। কিছু কারখানা কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। তবে এখনো ৯০ শতাংশ কারখানা এখানেই রয়ে গেছে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, যেকোনো কারখানা করার পূর্বশর্ত হচ্ছে যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ প্রস্তুতি রেখে বিধি মেনে ফায়ার লাইসেন্স নিতে হবে। কিন্তু এখানে যে কেউ চাইলেই বাড়ির নিচে কারখানা করছেন। এভাবেই এখানে আবাসিক এলাকায় শিল্প গড়ে উঠেছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা প্রতি শনিবার ওই এলাকায় জনসচেতনতা তৈরির জন্য যান। তাঁদের অগ্নিনির্বাপণ প্রস্তুতি, ফায়ার লাইসেন্স করার কথা বলেন। তাঁরা শোনেন, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেন না। ডিপিডিসির উচ্চপর্যায়ের কমিটির একজন সদস্য প্রস্তাব করেছেন, খরচ বেশি হলেও এ ধরনের ঘিঞ্জি এলাকায় সঞ্চালন লাইনের তারগুলো যদি অপরিবাহী আবরণযুক্ত (কাভার্ড) করা যায়, তাহলে একটু নিরাপদ হয়। এ প্রস্তাব ডিপিডিসির বোর্ডে পাস হলে তারপর বাস্তবায়ন করা যাবে। এ জন্য সময় লাগবে। তবে এখনো ডিপিডিসির কোথাও এ রকম আবরণযুক্ত সঞ্চালন লাইন নেই।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1241341/