৭ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, ৫:২৬

সরেজমিন: মৌলভীবাজারের কুলাউড়া

ভাতের কষ্টে বানভাসি মানুষ

নলকূপটি বন্যার পানিতে ডুবে ছিল অনেক দিন। পানি কমায় অর্ধেক অংশ বের হয়ে এসেছে। খাওয়ার পানির জন্য এখন এই নলকূপই আশপাশের মানুষের ভরসা। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরদল গ্রাম থেকে গতকাল তোলা ছবি l আকমল হোসেন*সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ বিতরণ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল *নলকূপ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় খাবার পানির সংকটে মানুষ

বানভাসি আর দশটা মানুষের চেয়ে গৌরাঙ্গ দাসের অবস্থা কিছুটা ভিন্ন। অন্যদের কাজকর্ম লাটে উঠলেও তাঁর হাতে আছে নৌকা। নৌকা চালিয়ে কমবেশি উপার্জন করছেন। তবু পেট পুরে খাবার মিলছে না হাকালুকি হাওরপারের এই বাসিন্দার।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল ইউনিয়নের বরদলের বাসিন্দা গৌরাঙ্গ দাস প্রথম আলোকে বললেন, ‘তিন সপ্তাহ ধরি লাহুল (প্রচুর) পানি। ভাঙা ঘর ভাঙা দরজা। কেউ কিচ্ছু দিচ্ছে না। ডিলার (ওএমএস) থাকি পাঁচ কেজি চাউল আনতাম। এটাও নাই। পরিবারে ছয়জন। ভাড়া নাও নিয়া খেয়া দেই। কোনো দিন ১০০-১৫০ টাকা পাই। হকলে মিলি তুরা তুরা (অল্প অল্প) খাই।’

গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বরদলসহ হাকালুকি হাওরপারের বিভিন্ন গ্রামের প্রায় অর্ধশত নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলে একই চিত্র পাওয়া গেছে। ঘরবাড়ি-রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ার দুর্ভোগের পাশাপাশি ঘরে ঘরে এখন ভাতের কষ্ট। পাকার আগেই বোরো ধান পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় শূন্য গোলা। প্রচুর পানি থাকায় ধরা পড়ছে না মাছ। নেই কাজের সুযোগ। সরকারি-বেসরকারি কোনো ত্রাণই পাচ্ছেন না অনেকে।
দুপুর ১২টার দিকে বরদলের একটি চা-দোকানে কথা হয় সুভাষ মৎস্য দাসের (৫৫) সঙ্গে। বলেন, ‘আমরা তিন বেলা খাইয়া অভ্যস্ত। একটু আগে এক কাপ চা ও একটা বিস্কুট খাইছি। ঘরে অখনো রান্নাবান্না অইছে না। ছেলেরা হাওরে মাছ ধরতে গেছে। মাছ পাইলে বেচমু। নাইলে নাই। কোনো সাহায্যও নাই।’
বরদল সেতুর কাছে দাঁড়াতেই অনেক মানুষ এসে ভিড় করে। সবার কণ্ঠে অভাব-অনটনের হাহাকার। আবদুর রহিম (৬০) বললেন, ‘বাড়িত পানি। ঘর একখান তুফানে ফালাই দিছে। ঈদের সময় ১০ কেজি চাউল পাইছলাম। বিয়াম (কষ্ট) করি চললাম।’

যোগেশ দাসের ঘরে পানি উঠে গেছে। পরিবার নিয়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। মাছ ধরে সংসার চলে। কিন্তু দিনে ৩০-৪০ টাকার মাছও পাচ্ছেন না। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি কেউই তাঁকে ত্রাণ দেয়নি। ত্রাণ না পাওয়ার কথা বললেন গীতেশ দাস, ছেকই বেগম, কবির মিয়া, সন্টু দাস, কটু দাস, কুটি মিয়াসহ অনেকে। তাঁরা যে মিথ্যা বলছেন না, তার জন্য একে অপরকে সাক্ষী করলেন।
বাড়ছে রোগব্যাধি
এই এলাকার বেশির ভাগ মানুষেরই এখন নৌকা ছাড়া ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। অনেক বাড়ির নলকূপ পানিতে ডুবে আছে।
কোনো নলকূপের মুখ সামান্য ভাসছে। বিশুদ্ধ পানির জন্য সেখানে কলসি নিয়ে ছুটছেন নারী-পুরুষ। অনেক বাড়িতে জ্বর, সর্দি-কাশিসহ নানা রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে।
বরদলের মো. সুহেল বলেন, ‘দুই দিন জ্বর আছিল। একটু কমছে। বাইর অইছি। মানুষের মাঝে খুব বেশি খাদ্যসংকট। এক বেলা খাইলে দুই বেলা নাই।’ হাঁটুপানি ভেঙে মো. সুহেলের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, এখনো তাঁর ঘরে প্রায় হাঁটুপানি। বাড়ির নলকূপটি ডুবে ছিল। এখন কিছুটা ভেসেছে। পাশের ফারুক মিয়ার বাড়ির নলকূপটি এখনো পানিতে ডুবে আছে। কদিন বৃষ্টির পানি জমিয়ে খেয়েছেন তাঁরা। এখন সুহেলের নলকূপ থেকে আশপাশের লোকজন পানি নিচ্ছে। তবে নলকূপে প্রথমে ঘোলা পানি ওঠে। কয়েকবার চাপ দেওয়ার পর পরিষ্কার পানি পাওয়া যায়।

কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. নুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ভুকশিমইল বাজারে চিকিৎসক দল কাজ করছে। এ ছাড়া নৌকায় ভ্রাম্যমাণ একটি দল কাজ করছে। এরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখছে। তবে নৌকায় করে বেশি দূর যাওয়া যায় না। ধীরে ধীরে সব এলাকায় গিয়ে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হবে।
পাশের কারেরা গ্রামে গিয়েও বানভাসি মানুষজনের দুর্দশা চোখে। পড়ে গ্রামের নজরুল ইসলাম বললেন, ‘আমরা কোনো দিন কিনিয়া খাইছি না। এখন ধনী-গরিব সমান। কিনিয়া খার না, এমন কেউ নাই।’ ছাত্রলীগের কুলাউড়া উপজেলা শাখার সহসভাপতি আবু সালেহ আম্বিয়ার বাড়ি এই গ্রামেই। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা বাস্তব। লুকানোর কিছু নাই। মানুষ খুব কষ্টে আছে। আগামী এক সপ্তাহ পর অনেকেই আর খেতে পারবে না। যা সঞ্চয় ছিল, তা শেষ হয়ে যাবে।’
বরদল ও কারেরা পড়েছে ভুকশিমইল ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে। এই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদুল মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তালিকা দিই দু-তিন শ জনের। ত্রাণ পাই ৫০-৬০ জনের। ফলে একসঙ্গে সবাইকে দিতে পারি না। যারা ত্রাণ পায়নি, পরেরবার তাদের দেওয়া হবে।’

এদিকে উপজেলার কাদিপুর ইউনিয়নের ফরিদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে এলাকার তিলকপুর গ্রামের তিনটি পরিবার এক সপ্তাহ ধরে আশ্রয় নিয়েছে। জয়ন্তী মালাকার নামের একজন বলেন, তাঁরা একদিন নগদ ৫০০ টাকা, একদিন ২০০ টাকা পেয়েছেন। একদিন শুকনা খাবার পেয়েছেন। জয়ন্তীর মা রানী বালা মালাকারের (৬৫) ডায়রিয়া হয়েছে। গত বুধবার চিকিৎসক দলের সদস্যরা তাঁকে ওষুধ ও স্যালাইন দিয়ে গেছেন। কাদিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয় নেওয়া আরও ১৩টি পরিবার চিড়া, মুড়ি, গম ও নগদ টাকা পেয়েছে।
কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) চৌধুরী মো. গোলাম রাব্বী প্রথম আলোকে বলেন, ‘যারা পায়নি বলেছে, তারা বোধ হয় সঠিক বলেনি। কোনো না কোনোভাবে সবাই পেয়েছে। এরপরও যারা পায়নি, তালিকা দেখে তাদের আগে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।’

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1241386