৭ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, ৫:২৩

বহুমুখী সংকটে আবাসন খাত

দেশের সম্ভাবনাময় আবাসন খাত বহুমুখী সংকটে স্থবির হয়ে পড়ছে। মানুষের বাসস্থানের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি সরকারের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে এ খাত বড় অবদান রাখছে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে এ খাতে চরম সংকট চললেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা মেলেনি। ফলে ধীরে ধীরে মুখ থুবড়ে পড়ছে আবাসন খাত।

সর্বশেষ তথ্য মতে, সারা দেশে আবাসন খাতে বিক্রি হ্রাস পেয়েছে ৮০ শতাংশ। আর নতুন প্রকল্প গ্রহণের হার কমেছে প্রায় ৯০ শতাংশ। বিদ্যমান অবস্থা থেকে এ খাতের উত্তোরণের জন্য সরকারের বিশেষ সহযোগিতা দরকার বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সরকারের সহযোগিতা ছাড়া আবাসন খাত স্বাভাবিক হতে পারবে না। আর সেটা না হলে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে। উন্নত ও মধ্যম আয়ের দেশ গঠনের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে এ খাত।
আবাসন ব্যবসায়ীরা জানান, বাংলাদেশে ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রেশন ফি ১৪-১৬ শতাংশ, যা সার্কভুক্ত দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য দেশে রেজিস্ট্রেশন ফি ৪-৭ শতাংশের মধ্যে। একজন গ্রাহক একটি ফ্ল্যাট কিনলে অনেক টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে হচ্ছে। এ কারণে গ্রাহকদের এ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ কমছে। আর একটি ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনের কিছুদিন পর বিক্রি করে দিলে নতুন করে একই হারে ফি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নামমাত্র ফি ধার্য করলে এ খাতে সেকেন্ডারি একটি মার্কেট সৃষ্টি হবে। যেটা আবাসন ব্যবসায় ইতিবাচক ধারা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু সরকার সেই সুযোগ দিচ্ছে না। এ ছাড়া বিনা শর্তে অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগ, স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ও সরকারের বিশেষ ঋণ তহবিল না থাকায় আবাসন খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।

তারা আরও জানান, আবাসন খাতের সমস্যাগুলো সরকার সংশ্লিষ্টদের কাছে পরিষ্কার। কিন্তু জেনেবুঝেও তারা এ খাতে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করছে না। এ সংক্রান্ত নীতি-সহায়তার প্রয়োজন থাকলেও সেসব দিকে কেউ নজর দিচ্ছে না। অথচ এ সরকার ২০২১ সালের মধ্যে সব নাগরিকের জন্য আবাসন নিশ্চিত করার ঘোষণা দিয়েছে। এরপরও আবাসন খাতে কোনো ধরনের প্রণোদনা দিচ্ছে না সরকার।

জানা যায়, দেশের আবাসন খাতে প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিক কাজ করে। আর এ আয়ের ওপর ২ কোটি মানুষের জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে। এ খাত প্রকৌশলী, স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ ও প্রকল্প ব্যবস্থাপক পদে ৩৫ হাজার উচ্চশিক্ষিতের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে আবাসন খাত ১৫ শতাংশ অবদান রাখছে। ভারতে এ খাত ৬.৩, শ্রীলংকায় ৮.৭ ও পাকিস্তানে ৩ শতাংশ অবদান রাখে। এ খাতকে কেন্দ্র করে ২৬৯ প্রকার লিংকেজ শিল্প গড়ে উঠেছে। যার উদ্যোক্তা সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার। মন্দাবস্থা স্থায়ী রূপ পাওয়ায় সংশ্লিষ্টরা অনেকে এ ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছেন। এর প্রভাব হবে মারাত্মক। জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সহজতর করতে এ খাতে দ্রুততম সময়ে সরকারের বিশেষ দৃষ্টি কামনা করছেন ভুক্তভোগীরা।
আরও জানা যায়, বিশ্বের অনেক দেশে ৩-৪ শতাংশ সুদে আবাসন খাতে ঋণ সুবিধা দেয় সরকার। আর ঋণ মেলে ফ্ল্যাট বা প্লটের মোট মূল্যের ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত। মেয়াদকাল দেয়া হয় ৩০-৪০ বছর পর্যন্ত। এসব ঋণের যে মাসিক কিস্তি আসে তা বাড়ি ভাড়ার চেয়েও কম। এ কারণে কেউ রোজগার শুরু করলে একটি বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মালিক হতে পারেন। কিন্তু আমাদের দেশে আবাসন খাতে ঋণের ওপর বেশির ভাগ ব্যাংকের সুদের হার ডাবল ডিজিট। আর নানা চার্জ আরোপ করে তার পরিমাণ আরও বাড়ানো হয়। তবে সিঙ্গেল ডিজিটে ৮-৯ শতাংশ সুদে কিছু ব্যাংক ঋণ সুবিধা দিচ্ছে। কিন্তু সেটাও খুব বেশি না। আর সুদের এ হার ব্যাংকগুলো যে কোনো সময় বাড়াতে পারে। এ আশঙ্কায় ক্রেতারা এসব ঋণের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এ খাতে ২০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ দেয়ার বিষয়ে সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী আশ্বাস দিলেও সেটা কার্যকর হয়নি। এ তহিবল গঠনের মাধ্যমে সিঙ্গেল ডিজিটে ৩০ থেকে ৩৫ বছর মেয়াদি কিস্তিতে ঋণ সুবিধা চালু করলে ক্রেতারা আগ্রহী হবেন। ফ্ল্যাট কিনবেন। আর ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে আবাসন খাত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বিপুল পরিমাণ অপ্রদর্শিত অর্থ রয়েছে। দেশে বিনিয়োগ সহায়ক আইন না থাকায় এ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। এ পাচার প্রতিরোধ করতে হলে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। প্রকাশিত তথ্য মতে, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে ৭৬ হাজার কোটি টাকা। ২০১৪ সালে ৭২ হাজার কোটি ও ২০১৫ সালে পাচার হয়েছে ৭৪ হাজার কোটি টাকা। ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে ৬ লাখ কোটি টাকা। অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের খাত সৃষ্টি না করলে ভবিষ্যতে অপ্রদর্শিত অর্থ পাচার আও বাড়বে। দেশে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ করলে বিভিন্ন ধরনের হয়রানি করা হয়। এসব ক্ষেত্রে সরকারকে নতুন করে ভাবতে হবে। আবাসন খাতে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করলে এ খাত সহজে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।

তারা আরও জানান, আবাসন খাতের সহায়ক শিল্প হিসেবে সিমেন্ট, স্টিল, রং, সিরামিক শিল্প গড়ে উঠেছিল। বাংলাদেশে এখন সিমেন্টের উৎপাদন ক্ষমতা ৩০০ কোটি টন। কিন্তু দেশের বর্তমান চাহিদা ১ কোটি ৮০ লাখ টন। আবাসন খাত সচল থাকলে এ অবস্থা থাকত না। নতুন কারখানা গড়ে উঠারও সম্ভাবনা তৈরি হতো। দেশের স্টিল কারখানাগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ৭০ লাখ টন। কিন্তু বাজারের চাহিদা না থাকায় উৎপাদন করছে মাত্র ৪০ লাখ টন। সিরামিক পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বাড়লেও দাম কমেছে। কমে গেছে রঙের চাহিদাও। এর পাশাপাশি ইট, আসবাবপত্র, ইলেকট্রিক পণ্যসহ অন্যান্য পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রি কমেছে।

উদ্যোক্তাদের মতে, আবাসন শিল্প প্রতিবছর প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনে এবং অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহে কার্যকর ভূমিকা রাখছিল। এ খাত মন্দাবস্থায় পড়ায় গত কয়েক বছর রেমিটেন্স প্রেরণের হার কমেছে। রেমিটেন্স কমে যাওয়ার বিষয়টি ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী স্বীকারও করেছেন। রেমিটেন্সের প্রবাহ একদিকে যেমন দেশের আবাসন শিল্পের বিকাশ ঘটিয়েছিল অন্যদিকে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধি করেছিল।
তারা আরও বলছেন, এ খাতের উদ্যোক্তারা সহজে নাগরিকদের আবাসনের মালিকানা তৈরি করে মানুষের মনে আত্মনির্ভরতা সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া সরকারের রাজস্ব আয়, কর্মসংস্থান, লিংকেজ শিল্প প্রসারের মাধ্যমে সমগ্র নির্মাণ খাতে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। দেশের উন্নতির স্বার্থে সরকারকে এ খাতের উন্নতির প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন যুগান্তরকে বলেন, আবাসন খাতের মন্দাবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে স্বল্প ও মধ্যবিত্ত আয়ের ক্রেতাসাধারণের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ তহবিল গঠন এবং সিঙ্গেল ডিজিটে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ সুবিধা চালু করতে হবে। এছাড়া আবাসন শিল্পে অন্যান্য দেশের মতো শিল্পঋণ সুবিধা চালু, রেজিস্ট্রেশন ব্যয় ৪ শতাংশে কমিয়ে আনা এবং সেকেন্ডারি মার্কেটে রেজিস্ট্রেশন ফি আরও কমাতে হবে।
স্থপতি ও নগর বিশ্লেষক মোবাশ্বের হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আবাসন মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম। এজন্য সরকারকে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের কথা চিন্তা করে এ খাতকে সচল রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আর প্লট বরাদ্দ সিস্টেম বাতিল করে ফ্ল্যাট বরাদ্দের দিকে এগোতে হবে। এ ছাড়া ঢাকা ও আশপাশের এলাকার বাইরে মফস্বল শহর ও গ্রামের দিকে পরিকল্পিত আবাসন গড়ে তুলতে কাজ করতে হবে।

গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, যারা ভবন নির্মাণ করেন তারা সব ধরনের ট্যাক্স দিয়ে থাকেন। যারা অ্যাপার্টমেন্ট করেন, তারা রড, সিমেন্ট, টাইলস, কমোড, গ্লাস, দরজাসহ ২৫০ ধরনের উপকরণ ব্যবহার করেন। এগুলোর ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে আসছে। তারপর অ্যাপার্টমেন্ট করছেন। আবার ১৪ শতাংশ রেজিস্ট্রেশন ফিও দিচ্ছেন। তাই আবাসন ব্যবসার ক্ষেত্রে সরকারকে কিছু প্রণোদনা দিতে হবে। এখন ফ্ল্যাট কেনার কথা হলে হোয়াইট মানি আছে কিনা, সেই প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এসবের কোনো যুক্তি আছে বলে আমি মনে করি না। সরকারের মন্ত্রী হয়েও আবাসন খাতের মন্দাবস্থা দূর করতে এ খাতে সরকারকে মনোনিবেশ করার অনুরোধ জানাচ্ছি। এ খাত মুখ থুবড়ে পড়লে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/07/07/137395