৭ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, ৫:২০

ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা কার্যত অচল

ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। পানি ঢুকছে বাসাবাড়িতে। কিছু কিছু এলাকায় স্থায়ী রূপ পেয়েছে জলাবদ্ধতা। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো জলাবদ্ধতা নিরসনে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করলেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। পানি নিষ্কাশন মাধ্যমের টেকসই উন্নয়নে বিভিন্ন সময় ভালো কিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও সেসব আলোর মুখ দেখছে না। এছাড়া দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে ঠেলাঠেলির কারণেও জলাবদ্ধতা নিরসন কার্যক্রম সঠিক পথে এগোচ্ছে না। ফলে বিদ্যমান নগর ব্যবস্থায় জলাবদ্ধতার ভোগান্তি থেকে নগরবাসীর মুক্তির কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা শহরে দুই সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও বেসরকারি আবাসন খাত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার সঙ্গে নানাভাবে জড়িত। তবে সিটি কর্পোরেশন আওতাভুক্ত ১২৭.৬৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মধ্যে পানি নিষ্কাশন কার্যক্রম সরাসরি পরিচালনা করছে ঢাকা ওয়াসা ও ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। এর মধ্যে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ড্রেনেজ লাইন রয়েছে দুই হাজার কিলোমিটারের কিছু বেশি। আর ঢাকা ওয়াসার ড্রেনেজ লাইন রয়েছে ৩৭০ কিলোমিটার। যদিও ঢাকা ওয়াসার আওতাভুক্ত এলাকা ৪০০ বর্গকিলোমিটার। সব এলাকায় ঢাকা ওয়াসা ড্রেনেজ সিস্টেম গড়ে তুলতে পারেনি। অন্যদিকে রাজধানীতে ঢাকা জেলা প্রশাসনের মালিকানাধীন ২৬টি খাল রয়েছে। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে ঢাকা ওয়াসা। দখল-ভরাটে এসব খালের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। এর মধ্যে মাণ্ডা, হাজারীবাগ, কসাইবাড়ী, সাংবাদিক কলোনি ও বাইশটেকি খাল ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ড হয়ে রয়েছে। অভিযোগ মিলেছে জাল-জালিয়াত চক্র এটা করেছে। ওইসব খাল দখলমুক্ত করা জেলা প্রশাসন, ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি কর্পোরেশনের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। ব্যক্তিমালিকানায় চলে যাওয়া খালগুলো টিকিয়ে রাখতে ঢাকা ওয়াসা খালের জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করলেও প্রকল্প অনুমোদন না পাওয়ায় সেসব উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। জেলা প্রশাসন মালিকানাধীন খালগুলোও দখল ও ভরাটের কবলে হারিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা ওয়াসা ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন খালগুলো উদ্ধারের চেষ্টা চালালেও রহস্যজনক কারণে সেসব থমকে আছে।

ড্রেনেজের দায় নিতে মেয়রদের ভয় : বিভক্ত ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত মেয়র দায়িত্ব গ্রহণের পর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে ঢাকা ওয়াসার নিয়ন্ত্রণ দাবি করেন। পরে ড্রেনেজ বিভাগকে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে ভাগ করে দেয়ার প্রস্তাব করেন সরকারের কাছে। আলোচনার একপর্যায়ে ঢাকা ওয়াসা ড্রেনেজ বিভাগ সিটি কর্পোরেশনকে ছেড়ে দিতে চায়। কিন্তু এরপর থেকে ড্রেনেজ বিভাগ বুঝে নিচ্ছে না দুই সিটি কর্পোরেশন। এক্ষেত্রে নানা রকম যুক্তি দিচ্ছেন তারা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরো ড্রেনেজ বিভাগের দায়-দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনকে নিতে হবে। তাহলে ড্রেনেজ বিভাগের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হবে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন যুগান্তরকে বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসার ড্রেনেজ বিভাগ ঠিকঠাক করে দিলে আমরা নিতে রাজি আছি। নইলে ওই ড্রেনগুলো নিয়ে আমাদের মহামুশকিলে পড়তে হবে।’
এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সমন্বয় সভা করে ঢাকা ওয়াসার ড্রেনেজ বিভাগ আমরা বুঝে নেব।’ যদিও এক্ষেত্রে ডিএনসিসির কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে না।
বন্ধ খাল উদ্ধার কার্যক্রম : ঢাকা জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, ঢাকা শহরে একসময় ৪৩টি খাল ছিল। সরকারি-বেসরকারি সংস্থার দখল ও রূপান্তরের ফলে ১৭টির অস্তিত্ব নেই। ২০১০ সালে ঢাকা ওয়াসা ও জেলা প্রশাসনের তদন্তে বেরিয়ে আসে, ঢাকার খালগুলো দখল করেছে অন্তত ১০ হাজার ৫০০ জন প্রভাবশালী। যাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ২১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে দখল কাজে সহায়তা করেছে। ২০১২ সালে সরকার অবৈধ দখলদারদের ধরতে মাঠে নামলেও পরে রহস্যজনক কারণে কার্যক্রম থেমে গেছে। এ সংক্রান্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের এক জরিপে দেখা গেছে, ১৯৬০ সালে ঢাকা শহরে জলাশয় ও নিচু জমি ছিল ১৬ হাজার ৪৭৯ দশমিক ৬ হেক্টর। ১৯৮৮ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১৪ হাজার ৮২১ দশমিক ৩৫ হেক্টর। ২০০৮ সালে জলাধারের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৭৭৫ দশমিক ৯ হেক্টরে। ২০১৩ সালে পরিমাণ আরও কমে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৩২৫ হেক্টর। ১৯৬০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত জলাশয় ও নিন্মভূমি হ্রাসের পরিমাণ ৬২ দশমিক ৫৩ শতাংশ। রাজধানীর খালের দখল সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দফতর, অধিদফতরে জমা দিলেও কার্যত দখলদারদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদে ঢাকার খালের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করলেও রহস্যজনক কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। খাল উদ্ধারের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। দায়িত্ব গ্রহণের পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ২৬ সংস্থার সমন্বয় সভা করে খাল উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করলেও জিরানীখালে একদিন উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে থমকে গেছেন। তবে মেয়র বলেছেন, খাল উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা অব্যাহত রাখা হবে।

অসচেতনতায় ভরাট হচ্ছে ড্রেন : ঢাকা শহরের পানি নিষ্কাশনের জন্য তৈরি প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার ড্রেন থাকলেও নগরবাসী এসব ড্রেন ভরাট করে ফেলায় কাক্সিক্ষত সাফল্য মিলছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অসচেতন নগরাবাসী গৃহস্থালির বর্জ্য, নির্মাণ বর্জ্য, কঠিন বর্জ্য, প্লাস্টিকসহ নানাবিধ আবর্জনা ফেলে ভরাট করে ফেলছে ড্রেন। এ কারণে বিশালাকার পাইপের মাধ্যমে ড্রেনেজ সিস্টেম গড়ে তুললেও কাক্সিক্ষত সাফল্য মিলছে না। এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী কামরুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, নগরবাসীর অসচেতনতায় ড্রেনলাইনগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়েও জলাবদ্ধতা নিরসন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত বর্জ্যব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা খোন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, নগরবাসী ড্রেনগুলো নানা বর্জ্যে ভরাট করে ফেলছে। এজন্য পরিষ্কার করেও কোনো কূলকিনারা করা সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল হাসনাত মোহাম্মদ আশরাফুল আলম যুগান্তরকে বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে নগরবাসীকে ড্রেন ও খালগুলো ভরাট করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সিটি কর্পোরেশন সীমিত সামর্থ্য দিয়ে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়েও নগরবাসীর অসচেতনতার কারণে ড্রেন ও নালাগুলো ঠিক রাখতে হিমশিম খাচ্ছে।

এসব বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও নগর বিশেষজ্ঞ ড. আজহারুল হক যুগান্তরকে বলেন, ঢাকা শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দুই সিটি কর্পোরেশনকে নিতে হবে। তাহলে ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক সুফল মিলবে। এটা হলে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষে পানি নিষ্কাশন মাধ্যমগুলো এককভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সংস্কার কার্যক্রম করে ঠিকঠাক রাখা সহজ হবে। নইলে বিদ্যমান অবস্থার উন্নতি হবে না।

তিনি আরও বলেন, পানি নিষ্কাশন মাধ্যমগুলো ঠিক রাখতে নগরবাসীকেও সচেতন হতে হবে। নইলে সরকারি সংস্থাগুলো কাজ করেও কাক্সিক্ষত সাফল্য পাবে না। নির্মাণ বর্জ্য, গৃহস্থালির বর্জ্য ড্রেনে না ফেলে নিয়ম মেনে যেখানে ফেলা দরকার, নগরবাসীকে সেসব স্থানে ফেলতে অনুরোধ জানান তিনি।
নগরবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ঢাকা শহরে পানি নিষ্কাশন মাধ্যমগুলো সঠিক মেইনটেনেন্স করে সক্রিয় রাখতে হবে। এ কাজ সমন্বিতভাবে করা দরকার। ওয়াসা ও দুই সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় না থাকলে কাজের ফল কম আসবে। তাছাড়া শোনা যাচ্ছে, ড্রেনেজের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশন নিতে চায়, সেটা নিলেও দ্রততম সময়ের মধ্যে নেয়া উচিত।
প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক বলেন, ঢাকার খালগুলো ভরাট করে ফেলাই রাজধানীর জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ। তবে এখন সেসব বলে লাভ নেই, বিদ্যমান অবস্থায় টেকসই ড্রেনেজ সিস্টেম গড়ে তোলার পাশাপাশি খালগুলো দখল ও ভরাটমুক্ত রাখতে হবে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক যুগান্তরেক বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে ড্রেনেজ সিস্টেম উন্নয়নের কাজ চলছে। এর বাইরে ঢাকা ওয়াসার মাধ্যমে খাল পরিষ্কার করা হচ্ছে। আশা করি, আমাদের সমন্বিত কাজে ধাপে ধাপে ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে।

এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন যুগান্তরকে বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের মূল কাজ ওয়াসার। কিন্তু তারা সেই কাজ করছে না। তাদের নির্দেশনা দিলেও সেসব মানছে না। তবে তিনি বলেন, ডিএসসিসির তত্ত্বাবধানে নতুন ড্রেন তৈরি, সংস্কার ও পরিষ্কার কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এ ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে আগামী বছরের মধ্যেই জলাবদ্ধতার সিংহভাগ নিরসন করা সম্ভব হবে। ঢাকা ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী কামরুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, ঢাকা ওয়াসা রুটিন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ড্রেন ও খাল সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে সমস্যা হচ্ছে, এসব পরিষ্কার করার পর নগরবাসী পুনরায় আবর্জনায় ভরাট করে ফেলছে। নগরবাসীর প্রত্যেকে সচেতন না হলে শুধু ঢাকা ওয়াসার পক্ষে এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এজন্য নগরবাসীকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান এই প্রকৌশলী।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/07/07/137391/