৭ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, ৫:১৭

বন্যায় ছড়াচ্ছে পানিবাহিত রোগ

সিলেট ও মৌলভীবাজারসহ কয়েকটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে এসব এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত নানা রোগ-বালাই। সিলেটের ওসমানীনগর, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ এবং মৌলভীবাজারের বড়লেখায় ডায়রিয়া, আমাশয়, চর্মরোগ ও ভাইরাস জ্বরসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বানভাসি মানুষ। বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের রামু ও উখিয়ায় বানের পানিতে ডুবে দুই সহোদরসহ ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে নয় বছরের এক শিশু।

সিলেটের দক্ষিণ সুরমা সীমান্তিক সূর্যের হাসি ক্লিনিকের প্যারামেডিক মৌসুমী দাস জানান, বন্যায় নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, চর্মরোগ ও ভাইরাসজনিত জ্বরের জীবাণু বেশি সক্রিয় থাকে। ফলে সহজেই এ রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে এতে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।

এদিকে বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে হাহাকার দেখা দিয়েছে। অনেকে অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। যুগান্তর ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
কক্সবাজার : রামুতে বানের পানিতে ডুবে মারা যায় ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের চালইন্যা পাড়ার কামাল হোসেনের ছেলেশিশু মো. শাহিন (১০) ও মো. ফাহিম (৮)। রামুর ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফরিদুল আলম জানান, বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে তারা নানার বাড়িতে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য যাচ্ছিল। পথে প্রবল স্রোতে তারা ভেসে যায়। বিকালের দিকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়।
এদিকে উখিয়ায় বন্যার পানিতে ভেসে গিয়ে ও পাহাড়ের মাটিচাপায় নারীসহ ৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। তারা হলেন : জালিয়াপালং ইউনিয়নের সোনাইছড়ি গ্রামের জাফর আলমের শিশুকন্যা সামিরা আকতার (১৪), পালংখালী ইউনিয়নের আঞ্জুমানপাড়ার সরওয়ার আলমের শিশুপুত্র রাব্বী (৭), রতœাপালং সাদৃকাটা গ্রামের মৃত আবুল হোছেনের ছেলে কামাল উদ্দিন (৬০), রতœাপালং ইউনিয়নের মধ্যমরতœা গ্রামের মৃত অমূল্য বড়–য়ার ছেলে ইতুন বড়–য়া (১৫)। এদের মধ্যে রাব্বী বুধবার রাতে বাড়িতে পাহাড়ের মাটিচাপায় মারা যায়। বাকিরা বানের পানিতে ভেসে গিয়ে প্রাণ হারান বলে জানিয়েছেন উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাঈন উদ্দিন।

সিলেট, ওসমানীনগর, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ : ওসমানীনগর উপজেলার সাদীপুর ইউনিয়নের গজিয়া গ্রামের বাসিন্দা আহমদ হোসেন বলেন, বন্যার কারণে বাড়িঘর ও নলকূপ পানিতে ডুবে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে। দূষিত পানি পান করার ফলে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। আমার ছেলেও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ছিল। দু’দিন হাসপাতালে চিকিৎসার পর সে এখন কিছুটা সুস্থ আছে।

ফেঞ্চুগঞ্জে জলাবদ্ধ থাকা ও স্যাঁতসেতে আবহাওয়ার কারণে শিশুরা শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বড়রা ভুগছেন চর্মরোগে। বিয়ানীবাজারের ৫টি আশ্রয় কেন্দ্রে ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত লোকজনের সংখ্যা বাড়ছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ১৬টি ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিম আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিচ্ছেন। কুড়ারবাজার ইউনিয়নের খশির সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার মাসুম আহমদ আক্রান্তদের চিকিৎসা ও ওষুধ সরবরাহ করেছেন। তিনি জানান, নিউমোনিয়া আক্রান্ত ৩ শিশু এবং ডায়রিয়া ও ভাইরাস জ্বর আক্রান্ত আরও ১৩ জন নারী-পুরুষকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
গোলাপগঞ্জেও পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। ভাদেশ্বরের কাটকাই গ্রামের সালাহ উদ্দিন জানান, বন্যায় পানিবন্দি লোকজনের মধ্যে চর্মরোগ দেখা দিয়েছে। বালাগঞ্জ উপজেলা হাসপাতাল, ওসমানীনগরের বিভিন্ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও গোয়ালাবাজার, তাজপুরের প্রাইভেট চিকিৎসকের কাছে প্রতিদিন শত শত ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত রোগী চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করছেন।
গোয়ালাবাজারের এমবিবিএস চিকিৎসক ইকবাল মাসুদ বলেন, প্রতিদিন আমি যত রোগী দেখি এর মধ্যে তিন ভাগের এক ভাগই ডায়রিয়া, সর্দি-কাশি-জ্বরসহ বিভিন্ন ভাইরাস রোগে আক্রান্ত। দিন দিন এর তীব্রতা বাড়ছে। বালাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আনিসুর রহমান বন্যাকবলিত এলাকায় ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়ার সত্যতা নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, হাসপাতালে প্রতিদিন প্রায় ২শ’ রোগী চিকিৎসা নিতে আসে। যার মধ্যে ৫০ জনের ওপরে ডায়রিয়া রোগী।
সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. হিমাংশু লাল রায় জানান, বন্যা আক্রান্ত এলাকায় ঠাণ্ডাজনিত কারণে শিশু ও বৃদ্ধদের শ্বাসকষ্ট ও সর্দি-কাশি দেখা দিয়েছে। তবে আশঙ্কা রয়েছে যে কোনো সময় ডায়রিয়ার মতো নানা ধরনের রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

ডা. হিমাংশু বলেন, বন্যাকবলিত প্রতিটি ইউনিয়নে একজন মেডিকেল অফিসার কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্বে রয়েছেন। বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর উপজেলায় বন্যা আক্রান্ত এলাকায় ১১টি আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। প্রতিটি আশ্রয় কেন্দ্রেও সকাল-বিকাল স্বাস্থ্যকর্মীরা খোঁজখবর নিচ্ছেন।

ফেঞ্চুগঞ্জের দুই ইউনিয়নে ত্রাণবঞ্চিত দুর্গতরা : জনপ্রতিনিধি না থাকায় নবগঠিত উত্তর কুশিয়ারা ও উত্তর ফেঞ্চুগঞ্জ ইউনিয়নে বন্যাদুর্গতরা ত্রাণবঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ দুই ইউনিয়ন প্রশাসক দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।
কুলাউড়া (মৌলভীবাজার) : কুলাউড়ার কামালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় এক মাস ধরে আছেন মিলন রানী বিশ্বাস। তিনি বলেন, অনেকদিন হয়ে গেল আশ্রয় কেন্দ্রে আছি। এই প্রথম বুধবার সরকারি সাহায্য বলতে ৭-৮ কেজি গম পেলাম। উত্তরভাগ ইউনিয়নের সদস্য মজনুর রহমান বলেন, ত্রাণ বিতরণের জন্য পাই একশ’ নাম আর বানভাসি মানুষ ৩শ’। এদিকে ছড়িয়ে পড়েছে ‘ভাইরাস জর’। সোমবার রাতে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পাঁচগাঁও ইউনিয়নের আমীরপুর গ্রামের রুকুব মিয়ার মেয়ে তামান্না আখতার (৯) মারা যায়। কুশিয়ারা নদীর বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধের কান্দিগাঁও এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে।

বড়লেখায় ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব : হাকালুকি হাওরপারের বড়লেখা উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে দুর্গত এলাকায় ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত নানা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এ পর্যন্ত নারী-শিশুসহ ২৫ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন এবং ৫ জন ভর্তি রয়েছেন। পানিবন্দি মানুষের মাঝে রোগ-বালাই যাতে মারাত্মক আকার ধারণ করতে না পারে সে জন্য ১ জুলাই ১০টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়। বৃহস্পতিবার জেলা সিভিল সার্জন বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন।

মৌলভীবাজারে তলিয়ে গেছে ফিশারি : সদর উপজেলার হাইল হাওরে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনকারী ৬টি ফিশারির অন্তত ৫০টি পুকুর বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ফিশারির মালিকরা। এর মধ্যে অনেকেই ব্যাংক ঋণ নিয়ে ফিশারি করলেও এখন তারা সর্বস্বান্ত। বেকার হয়ে পড়েছেন ফিশারিতে কর্মরত অন্তত দু’শ কর্মচারী। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবদুল কুদ্দুছ আখন্দ বলেন, বন্যায় ওই ফিশারিগুলো ছাড়াও জেলার আরও বিভিন্ন এলাকার ফিশারি তলিয়ে মালিকদের ক্ষতি হয়েছে। এ বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছি।

কুড়িগ্রাম : প্রধান প্রধান নদ-নদীতে পানি বাড়ায় নিন্মাঞ্চল তলিয়ে গেছে। প্রায় দেড় হাজার পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্র এবং উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের পোড়ারচরের বাসিন্দা আদুরী (৩৫) বলেন, ‘আমাগো বাড়িতে পানি ওঠায় পোলাপানগো লইয়া আবাসনে যাই।’ ছোট্ট নৌকায় প্রতিবেশী সাহের আলী তাদের নিয়ে যাচ্ছিল। আদুরীর ছেলে আকাশ (৮) ও মেয়ে খুশি (৭) তখন নৌকায় বসে খাচ্ছিল। আকাশ বলল, ‘ক্ষেত-খামার ভাইসা গ্যাছে। তরি-তরকারি নাই। খুদের চালের ভাত খাইতাছি।’ এই গ্রামে নতুন করে শাহজাহান, আফান আলী, শফিকুল, লালচান, মাহাবুর, তহুরুদ্দি, শাহাজামাল, তারাচান ও ছামসুলের বাড়িতে পানি উঠেছে।

বান্দরবান, আলীকদম ও লামা : বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় বান্দরবানে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে দুর্গত এলাকায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এদিকে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বহীনতায় আলীকদমে বানভাসি মানুষ ত্রাণ পায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।

জামালপুর ও ইসলামপুর : জামালপুরে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনা নদী ও ব্রহ্মপুত্র নদে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ইসলামপুরের ৬ ইউনিয়নের নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
চন্দনাইশ (চট্টগ্রাম) : চন্দনাইশে বসতবাড়িতে পানি ঢুকে শতাধিক বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জোয়ারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিন আহমদ চৌধুরী রোকন ও সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আহমদুর রহমান বন্যার ফলে তাদের এলাকায় ক্ষতির সত্যতা স্বীকার করেন।

সিরাজগঞ্জ : যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চরাঞ্চলের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সিরাজগঞ্জ পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী রণজিৎ কুমার জানান, এভাবে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ২-১ দিনের মধ্যে যমুনার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করবে। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ইমাম জানান, যে কোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রস্তুত।
বাঘা (রাজশাহী) : পদ্মায় পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চরের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন নদীবেষ্টিত রাজশাহীর বাঘার পদ্মার চর। নদী ভাঙনগ্রস্ত ও সহায়সম্বলহীন মানুষরাই চরে অবস্থান করে। কিছু কিছু চরে স্থায়ী জনবসতি গড়ে উঠেছে। আবার কিছু কিছু চরে অস্থায়ী বসতি রয়েছে। চরের চকরাজাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক গোলাম মোস্তফা জানান, গেল বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে না-নিতেই আবারও পদ্মায় নতুনভাবে পানি বাড়া শুরু করেছে। ফলে আমরা আঙ্কিত।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/07/07/137377