৭ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, ৫:১৫

যারা গুম হয়েছেন

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ২০১৩ সাল থেকে শত শত মানুষকে বেআইনিভাবে আটক করে গোপন স্থানে আটকে রেখেছে বলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর এ পর্যন্ত ৩২০ জনের বেশি মানুষ গুম হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে অভিযুক্ত আসামি, সেনা সদস্য এবং বিরোধী দলের সমর্থক। এদের মধ্যে ৫০ জনকে পরে হত্যা করা হয় এবং ডজনের মতো এখনও ‘নিখোঁজ’ রয়েছেন। অপহরণের শিকার কিছু লোকদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে অথবা আদালতে হাজির করা হয়েছে। এ ধরনের নিখোঁজের ঘটনা এখনও ঘটছে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের সমর্থকদের নিখোঁজ করা হচ্ছে।’

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০১৬ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং মিডিয়া ৯০টির বেশি ঘটনা লিপিবদ্ধ করে। এর মধ্যে ২১ জনকে হত্যা এবং ৯ জন এখনও নিখোঁজ। অধিকার জানায়, ২০১৭ সালের প্রথম পাঁচ মাসে একইভাবে ৪৮ জনের নিখোঁজ হওয়ার খবর এসেছে।’

২০১৬ সালে নিখোঁজের ৯০টি ঘটনার মধ্যে তিন যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা গোলাম আযম ও মীর কাসেম আলী এবং বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদেও চৌধুরীর ছেলে যথাক্রমে আমান আজমী, মীর আহমেদ বিন কাসেম ও হুম্মাম কাদের চৌধুরীর কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে হুম্মাম ‘নিখোঁজ হওয়ার’ সাত মাস পর মার্চে বাড়ি ফেরেন, যাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এছাড়া বিএনপির ১৯ কর্মীর নিখোঁজ হওয়ার কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এদের ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে ঢাকা ও আশপাশের এলাকা থেকে তুলে নেয়া হয়। বিএনপির যে ১৯ জনের কথা প্রতিবেদনে এসেছে, তাদের মধ্যে আটজনকে র্যা ব, ছয়জনকে ডিবি এবং বাকিদের ‘অজ্ঞাত’ কোনো বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএনপি কর্মী সাজেদুল ইসলাম সুমন; যিনি ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর নিখোঁজ হন। ২০১৪ সালের ২৮ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজনৈতিক সহকর্মীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে গুম হন ঢাকা মহানগর ছাত্রদলের ৫ কর্মী। তারা হলেন- সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সম্রাট মোল্লা, ৭৯ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদল সভাপতি খালেদ হাসান সোহেল, ৭৮ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদল সভাপতি আনিসুর রহমান খান, একই ওয়ার্ডের সহসাংগঠনিক সম্পাদক বিপ্লব ও ৮০ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিক দল সম্পাদক মিঠু। ১১ দিন পর মুন্সীগঞ্জে নিয়ে আনিসুর রহমান, বিপ্লব ও মিঠুকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু এখনও খোঁজ মেলেনি সম্রাট ও খালেদের। ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর রাজধানীর শিশুপার্ক এলাকা থেকে মাহফুজুর রহমান সোহেল সরকার, বংশাল থানা ছাত্রদলের সহসভাপতি হাবিবুল বাশাল জহির, ৭১নং ওয়ার্ডের সভাপতি পারভেজ হোসাইন ও ছাত্রদল কর্মী হোসাইন চঞ্চলকে সাদা পোশাকে কে বা কারা তুলে নিয়ে যায়। তারা এখনও নিখোঁজ। একই বছর ৪ ডিসেম্বর রাজধানীর বসুন্ধরা থেকে ছয়জন নিখোঁজ হন। তারা হলেন- ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমন, সুমনের খালাতো ভাই জাহিদুল করিম তানভীর, মাজহারুল ইসলাম রাসেল, মো. আল আমিন ও আসাদুজ্জামান রানা, আবদুল কাদের ভুঁইয়া মাসুম। এদের মধ্যে তিনজন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ২০১৬ সালের ১৩ জুন শিবিরকর্মী শহীদ আল মাহমুদকে বাড়ি থেকে পুলিশ পরিচয়ে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই বছর ১ জুলাই বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন শহীদ। এছাড়া বিএনপি নেতা আদনান চৌধুরী, শামসুদ্দিন ২০১৩ সালের ডিসেম্বর নিখোঁজ রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিএনপির দাবি গুমের সংখ্যা প্রায় একশ’ : বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত প্রায় একশ’ নেতাকর্মীকে গুম করেছে বলে অভিযোগ বিএনপির। এদের মধ্যে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক জামায়াতের নেতাকর্মীও রয়েছেন। এদের মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, ছাত্রদলের সাবেক নেতা আনিসুর রহমান তালুকদার খোকনসহ কয়েকজনকে খুঁজে পাওয়া গেছে। আবার কয়েকজনের লাশ পাওয়া গেছে। তবে দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা এম ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হিরুসহ অনেককে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিএনপি ও নিখোঁজ পরিবারের অভিযোগ- এসব গুমের পেছনে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত। নরসিংদী কলেজ ছাত্রদলের নির্বাচিত জিএস সিদ্দিকুর রহমান নাহিদ গত রমজানের শুরুতে নিখোঁজ হন। এখনও তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
২০১৫ সালের ১০ মার্চ রাতে উত্তরার একটি বাসা থেকে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছে বলে পরিবারের দাবি। এ নিয়ে তারা উচ্চ আদালতে রিট মামলা ও থানায় জিডি করেন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বলছে, তারা সালাহউদ্দিনকে আটক করেনি। পরে তাকে ভারতের শিলংয়ে পাওয়া যায়।
২০১৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বিএনপি সমর্থক আইনজীবী সোহেল রানাকে উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টর থেকে ছাই রঙের মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। নিহতের স্ত্রী আফরোজা সুলতানা জানান, তার স্বামী বিএনপি সমর্থক হলেও সক্রিয় নেতা নন। ঘটনার দিন সোহেল আদাবরের বাসা থেকে তার বন্ধু রিংকুসহ উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টরে যান। সেখান থেকে রিংকু ও সোহেলকে আটক করে হাতকড়া পরিয়ে গাড়িতে তোলা হয়। কিছু সময় পর রিংকুকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু সোহেলের খোঁজ এখনও পাওয়া যায়নি।

এম ইলিয়াস আলী ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে বনানীর বাসার কাছ থেকে ড্রাইভার আনসার আলীসহ নিখোঁজ হন। তাদের এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ২০১০ সালের ২৫ জুন রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা থেকে নিখোঁজ হন বিএনপি নেতা কমিশনার চৌধুরী আলম। তাকেও ফিরে পায়নি পরিবার। ওই বছরের ১৭ এপ্রিল রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড থেকে অপহৃত হন ঝালকাঠির রাজাপুর থানা যুবদল নেতা মিজানুর রহমান জমাদ্দার এবং তার দুই সহযোগী মুরাদ ও ফোরকান। কয়েক মাস পর ফোরকান বেরিয়ে এসে তাদের নিখোঁজ হওয়ার কাহিনী মিডিয়ার সামনে তুলে ধরেন। এর কয়েকদিন পর আবারও নিখোঁজ হন ফোরকান। মিজানের কোনো হদিস মেলেনি আজও। এরপর মিজানের শ্যালক মিজান শিকদার এবং তার ভাতিজা সুমনকেও একইভাবে গাজীপুর থেকে অপহরণ করা হয়। সেই থেকে তারা নিখোঁজ। সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু ও লাকসাম পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর কুমিল্লা বিশ্বরোডের কাছ থেকে নিখোঁজ হন। এখনও তাদের সন্ধান মেলেনি। এছাড়া ঢাকার হাজারীবাগ থেকে ২০১৪ সালের ৪ জানুয়ারি গুম হন স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা আবদুল হালিম, ২০১৩ সালের ১১ ডিসেম্বর পল্লবী থেকে নিখোঁজ হন ছাত্রদল নেতা সেলিম রেজা পিন্টু। একই বছর ৬ ডিসেম্বর দক্ষিণখান থেকে ছাত্রদল নেতা তরিকুল ইসলাম ঝন্টু নিখোঁজ হন। এছাড়া ঢাকা মহানগরে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের যেসব নেতা বিভিন্ন সময়ে গুম হন তাদের মধ্যে আছেন- মাহাবুবুল হক সুজন, ফরহাদ হোসেন, জিয়াউর রহমান শাহীন, জসিম, মো. সোহেল ও কাশেম। এছাড়া সিলেটে নিখোঁজ হন ইফতেকার আহম্মেদ দীনার, জুনেদ আহম্মদ। লক্ষ্মীপুরে নিখোঁজ হন ইকবাল হোসেন জুয়েল, বেলাল হোসেন, আলমগীর হোসেন, রাজু, ওমর ফারুক ও আবদুল কাদের।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/07/07/137374