৭ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, ৫:০৭

জলাবদ্ধতায় নাকাল কয়েক লাখ মানুষ

কামাল উদ্দিন সুমন: ঘরের ভেতর হাঁটু পানি। খাটের নিচে এক এক করে ৪ টা ইট দেয়া। সে খাটের উপর বসে ভাত খাচ্ছেন ৮০ বছরের বৃদ্ধ রশিদ মিয়া। জিজ্ঞাসা করতেই কেঁদে কেঁদে বলেন, ‘এত দুর্ভোগ, কষ্ট আর ভালল্যাগেনা’এভাবে কি বাঁচা যায় বাবা? কতদিন ধরে পানিবন্দী হয়ে আছি । না পারি চলাফেরা করতে । রান্না-বান্না আর পয়নিষ্কাশনে কত সমস্যা। ছেলেরা পানি সেচে আবার বৃষ্টি হলে পানিতে ডুবে যায়। আমাদের কষ্টের কথা বলে শেষ করা যাবে না। ডিএনডির দেলপাড়া টাওয়াপার এলাকার বাসিন্দা রশিদ মিয়া এভাবে বর্ণনা দিলেন ডিএনডি এলাকার জলাবদ্ধ মানুষের দুর্ভোগের কথা।

একই এলাকার বাসিন্দা আব্দুল আউয়াল শিপন জানান, আগে রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে থাকতো এখন বাসার ভেতরে হাঁটু পানি। ময়লা আবর্জনা এবং শিল্পবর্জ মিশ্রিত পানিতে একাকার। তারই মধ্যে পরিবার পরিজন নিয়ে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ডিএনডির কয়েক লাখ মানুষ। শুধু নিচু এলাকার পথঘাটই নয় বাসাবাড়ি তলিয়ে গেছে পানিতে। অনেকের রান্নাঘর টয়লেট পানিতে ডুবে যাওয়ায় নিদারুণ কষ্টে দিন পার করছে। এছাড়া গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণে ডিএনডি (ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা বাধ) এলাকায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতা কিছুতেই কমছে না। গত দুইদিন ধরে বৃষ্টির মাত্রা কমে গেলেও জলাবদ্ধতার পানি সরতে না পারায় চরম দুর্ভোগে রয়েছে লাখো মানুষ। জলাবদ্ধতার কারণে এবার ঈদ উল ফিতরে ডিএনডিবাসীর আনন্দ পরিণত হয়েছিল নিরানন্দে।

জানা গেছে, ঈদুল ফিতরের দিন থেকে অব্যাহত বর্ষণে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার সস্তাপুর, কায়েমপুর, চাঁদমারী, ইসলাম বাগ, ইসদাইর, গাবতলী, তল্লা, কুতুবআইল, নয়াআটি, লামাপাড়া, কুতুবপুর, নন্দলালপুর, পিলকুনি, পাগলা, দেলপাড়া, আলীগঞ্জ, দাপা, ভুইগড়, পেয়ারাবাগান, রঘুনাথপুর, সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুড়ি, ধনকুন্ডা, মিজমিজির পাইনাদী, সানারপাড়, তুষার ধারা, গিরিধারা, সাদ্দাম মার্কেট, রাজধানী ঢাকার মাতুয়াইল, দনিয়া, শনির আখড়াসহ বিভিন্ন এলাকার অনেক বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট, মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজ, সবজি খেত, নার্সারী বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। নর্দমা ও বিভিন্ন শিল্পকারখানার দূষিত বর্জ্য বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে রোগব্যাধি ছড়াচ্ছে।

ডিএনডি সূত্রে জানা যায়, ডিএনডি থেকে সুষ্ঠুভাবে সেচ কার্য পরিচালনা করা এবং পানি নিষ্কাশন করার জন্য ৯টি সেচ খাল, ৯টি ডিটিও খাল, ২১০টি আউট লেক খাল, ৮৫টি চকবন্দী খাল অনুসারে ১০টি নিষ্কাশন খাল রয়েছে। এ ছাড়াও এক কিলোমিটার দীর্ঘ ইনটেক খাল, ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ মেইন ক্যানেল টার্ন আউট খাল রয়েছে। এর মধ্যে চ্যানেল-১ খালের র্দৈঘ্য ৭ দশমিক ৯০ কিলোমিটার, চ্যানেল-২ এর দৈর্ঘ্য ৫ দশমিক ৮০ কিলোমিটার, পাগলা খাল ৩ কিলোমিটার, জালকুড়ি খাল ২ দশমিক ১০ কিলোমিটার, শ্যামপুর খাল ২ দশমিক ৭০ কিলোমিটার, ফতুল্লা খাল ১ দশমিক ৮০ কিলোমিটার ও সেকেন্ডারী চ্যানেলের দৈর্ঘ্য ১০ কিলোমিটার। এ সকল খালগুলোর অধিকাংশই ভরাট হয়ে গেছে বলে ভুক্তভোগীরা জানান।
জানা গেছে, ডিএনডি বাঁধ সংস্কার এবং ভেতরের জলাবদ্ধতা দূর করার একটি প্রকল্প গতবছর ৯ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) অনুমোদিত হয়েছে। ডিএনডি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন( ফেজ-২) নামে প্রকল্পের জন্যে ৫‘শ ৩৬ কোটি ৬০ লাখ টাকার বরাদ্দপত্র অনুমোদন হওয়ার পর বর্ষা চলে আসলেও প্রকল্পের কাজ এখন শুরু করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এর আগেও ডিএনডি বাঁধের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বছরের পর বছর ফাইলবন্দী ছিল।
ভূইগড় এলাকার গৃহিনী রোকসানা বেগম জানান, তার স্বামী আমজাদ হোসেন কৃষিকাজ করেন। ২ ছেলে ২ মেয়ে নিয়ে তার সংসার। বাড়িতে ৪টি গরু পালেন এবং গরুর দুধ বিক্রি করে ছেলে-মেয়ের লেখা পড়ার খরচ চালায়। দুই সপ্তাহের বৃষ্টিতে পানি ঘরের ঘাটের উপরে উঠে পড়ায় কয়েকদিন আগে উঁচু এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে সেখানে ছেলে-মেয়ে ও গরু নিয়ে উঠেছেন। মাঝে মধ্যে পানি ভেঙ্গে বাড়িতে এসে ঘরে রেখে যাওয়া আসবাবপত্র দেখে যান।

কুতুবপুর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড সাবেক ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম জানান, বাড়ি ঘর ছেড়ে প্রতিদিনই কেউ না কেউ অন্যত্রে চলে যাচ্ছে। তবে কেউ না খেয়ে আছে এমন অভিযোগ কেউ আমার কাছে এখনো করেনি। আমি প্রতিদিনই বিভিন্ন পানি বন্দী মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোজ খবর নেই। পানি বন্দী মানুষ অনেক দুর্ভোগে আছে। দ্রুত পানি নিষ্কাশনের বিষয়ে পাম্প হাউজে তাগিদ দিচ্ছি।
বরফকল এলাকার মদিনা জামে মসজিদের মোতোওয়াল্লী আব্দুল খালেক বলেন, রমজান মাস থেকে মসজিদে পানি, রাস্তা-ঘাটে পানি। কিন্তু দেখার কেউ নেই, খোঁজও নেয়না কেউ।এখন বৃষ্টির পানিতে আবারো জলবদ্ধতায় আমাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৯ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. আরিফ আহম্মেদ বলেন, পানিতে চলাফেরা করতে কষ্ট হয়। তাই সাড়ে ৫ হাজার টাকা দিয়ে নৌকা কিনে এনেছি। এখন বাসার সকলের চলাফেরা নৌকাতেই।
সিদ্ধিরগঞ্জের পাম্প হাউজের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আব্দুল জব্বার জানান, প্রধান নিষ্কাশন খালসহ শাখা খালগুলোয় স্থানীয় লোকজন পলিথিন, রান্না-বান্নার ময়লা আবর্জনা ফেলায় প্রতিবছরই ভরাট হয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এছাড়া পাম্প হাউজের ৫১২ কিউসেক ক্ষমতা সম্পন্ন চারটি পাম্পই ৫০ বছরের পুরনো। এগুলোর কর্মক্ষমতাও আগের মতো নেই ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ও ডিএনডির স্থায়ী জলাবদ্ধতা ও পানি নিষ্কাশন প্রকল্পের পরিচালক মো. আব্দুল আউয়াল মিয়া বলেন, ‘প্রকল্পের ক্রয় (ডিপিএম) অনুমোদন হয়ে গেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কাজটি বাস্তবায়ন করবে। ডিজাইন সম্পন্ন হলেই সেনাবাহিনী রেট কোড দেবে। প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণে জেলা প্রশাসকের কাছেও প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এছাড়া সয়েল টেস্টসহ বিভিন্ন কাজ চলছে দ্রুতগতিতে।

http://www.dailysangram.com/post/290620