৭ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, ৫:০৫

মো হা ম্ম দ আ ব দু ল ম জি দ

প্রত্যক্ষ কর বনাম পরোক্ষ কর

২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে পরোক্ষ কর ভ্যাটকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আনা হয়। প্রবর্তনের অপেক্ষায় থাকা নতুন মূসক ও সম্পূরক শুল্ক আইনটিতে (শূন্য তালিকা ব্যতীত) সব পণ্য ও সেবার ওপর একক ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ এবং ‘ক্ষেত্র বিস্তৃতকরণ’ এবং ‘কর আদায় প্রক্রিয়া সহজীকরণ’-এর জন্য ভ্যাট হিসাবায়নের ‘নতুন পদ্ধতি’ প্রেসক্রাইব করা হয়েছিল, যা অনলাইন পদ্ধতিতে সহজসাধ্য ও নিয়মনিষ্ঠ হবে বলে প্রত্যাশা করা হয়েছিল। ধরেই নেয়া হচ্ছিল, অধিকাংশ ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে অনলাইনে অভ্যস্ত হয়েছে বা হবে। স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়, বড় ব্যয়ের বাজেট বাস্তবায়নে রাজস্ব আয় বাড়াতে সহজ উপায়ে পরোক্ষ করের বোঝা বাড়ানোর প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। এটা এত সহজে বাস্তবায়ন করা যাবে কিনা সেটি নিশ্চিত না হয়েই হয়তো নতুন ভ্যাট আইন প্রবর্তনের পথে ছিল রাজস্ব আহরণকারী কর্তৃপক্ষ। বাজেটে ছিল আগের ভ্যাট আইন ও নতুন আইনের মিশ্রিত ঘোষণা। আগের আইনে যা কিছু ছিল, সেখান থেকে কোনটা কেন রাখা হল তা পরিষ্কার করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে করের প্রভাব কোথায় বাড়বে কিংবা কোথায় কমবে, তা পরিষ্কার করা হয়নি। প্রভাব পরীক্ষা-পর্যালোচনা (impact study) না করে এ ধরনের নতুন রাজস্ব নীতি বা আইন বাস্তবায়নে যাওয়ায় অর্থাৎ কোনো সংস্কার না করে বাড়তি ভ্যাট আরোপ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা সব বোঝা ভোক্তার ওপর চাপাবেন, এমন আশঙ্কাও প্রবল হয়ে ওঠে। ফলে ভ্যাট আহরণে নানা ধরনের জটিলতা তৈরির এবং অপপ্রয়োগের ফলে সুন্দর আইনটি অসুন্দর হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠছিল। সংসদে উত্থাপিত আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে নতুন আইনের প্রবর্তন দু’বছর পেছানোর যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে আইনটি প্রবর্তনের পথে করণীয় সম্পর্কে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে সক্রিয় থাকতে হবে।

বিশেষভাবে লক্ষণীয়, ভ্যাটের গুরুত্ব বাড়াতে গিয়ে প্রত্যক্ষ করের (আয়কর) প্রতি বাঞ্ছিত মনোযোগ হ্রাস পেয়েছে। অথচ প্রত্যক্ষ করই কর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপায়। এ কথা অবশ্যই মানতে হবে, VAT touches everybody but income tax does not. সুতরাং পরোক্ষ কর ভ্যাট আরোপে যথেষ্ট বিচার-বিবেচনা প্রযুক্ত হওয়া উচিত। প্রত্যক্ষ কর অর্থাৎ আয়কর ব্যবস্থাপনাকে যথাযথ শক্তিশালী করার মাধ্যমেই সামষ্টিক অর্থনৈতিক তথা সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থাপনায় অগ্রগতি সাধন করা যেতে পারে। বিগত কয়েক বছরে আয়কর ক্রমশ রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস হিসেবে উঠে আসতে থাকলেও ২০১৭-১৮-তে ভ্যাট লক্ষ্যমাত্রা যেখানে ৯১ হাজার কোটি টাকা, আয়কর সেখানে ৮৫ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আয়কর আইন সংস্কার ও আহরণে কার্যকর জোর পদক্ষেপ গ্রহণের দৃষ্টিভঙ্গি নড়বড়ে হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং সম্পদের বণ্টন বৈষম্য দূরীকরণে প্রত্যক্ষ করের গুরুত্ব লঘু করে পরোক্ষ কর ভ্যাটের ওপর ভরসা করে রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর পদক্ষেপ থেকে সচেতনভাবে সরে আসতে হবে। প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে না পারায় পরোক্ষ করের ওপর চাপ বাড়ছে। এটা যুক্তিযুক্ত পদক্ষেপ নয়।

পাবলিক সেক্টরের অদক্ষতা ও দুর্নীতির দায়ভার তাদের কর অব্যাহতিদানের মাধ্যমে সেই করের বোঝা বেসরকারি সেক্টরের ওপর চাপানোয় কর জিডিপি অনুপাত পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা যেমন সংকুচিত হচ্ছে, তেমনি তাদের বেসরকারি খাতের করের টাকায় রিফাইন্যানসিং করায় কর প্রদান সংস্কৃতি উন্নয়নের পথে আস্থাহীনতা ও উৎসাহ কমে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ৪৮টি সংস্থার মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি লোকসানে রয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সর্বাধিক ভর্তুকি নিচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১৪টি প্রতিষ্ঠানকে সরকারি অনুদান বা ভর্তুকি মিলিয়ে প্রায় ২ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। আগের বছরে ১১টি প্রতিষ্ঠানকে অনুদান বা ভর্তুকি বাবদ দেয়া হয়েছিল প্রায় ১ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা। বাজেটে শিক্ষায় যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তার বড় অংশই যাবে বেতন-ভাতা ও ভবন নির্মাণে। সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে জিডিপির মাত্র ৫ শতাংশ। অথচ রেলওয়েকে স্বাস্থ্য খাতের সমান বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য মৌলিক অধিকার। স্বাস্থ্যের কারণে কেউ দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে যাবে, আবার অসুখ হলে তিনি দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে আসবেন, এটা দুঃখজনক। রেলওয়ের বিকল্প অন্য বাহন আছে- স্বাস্থ্যের তো কোনো বিকল্প নেই। রিফাইন্যানসিংয়ের মাধ্যমে সরকারি ব্যাংকের অনিয়ম-অদক্ষতার ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে, ফলে সরকারি ব্যাংকগুলোতে অনিয়ম উৎসাহিত হচ্ছে কিনা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। নন-ট্যাক্স রেভিনিউ খাতে (যা সরকারি সংস্থা প্রদেয়) অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ক্রমশ কমানো হচ্ছে, আর এ কারণে এনবিআর রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা হারাহারি মতে বৃদ্ধি করতে হচ্ছে।

উপরের সারণিতে দেখা যায় কর ব্যতীত প্রাপ্তি ক্রমশ কমছে, আর এই কমতির চাপ মোট রাজম্ব আয়ের হিস্যায় কর রাজস্বের ওপর গিয়ে আপতিত হচ্ছে। পাবলিক সেক্টরের প্রকল্প ব্যয়ের ওপর সিডি ভ্যাট ও কর রাজস্ব হিসেবে আহরণের সুযোগ সীমিত হয়ে আসছে। বড় বড় প্রকল্পে কর অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে, অনেক সংস্থা লাভজনক অবস্থানে এলেও সরকারকে কর রাজস্বসহ লভ্যাংশ প্রদান করছে না। এ সব সংস্থা কর অব্যাহতি দেয়ার ফলে সেখানে আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বলবৎ হচ্ছে না।

রাজস্ব আহরণে নজর দেয়া উচিত আয়করের ওপর। সাধারণ নিয়মে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর যথাক্রমে ৬০ ও ৪০ শতাংশ হওয়া উচিত। বাংলাদেশে এর উল্টোটা দেখা যায়। এবার প্রত্যক্ষ করের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৫ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা, যা ৩৪ শতাংশ। আর পরোক্ষ করের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৬৩ হাজার ১৪ কোটি টাকা, যা ৬৬ শতাংশ। কর পরিহার ও কর ফাঁকি নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এতে বণ্টনমূলক ন্যায্যতার অভাব ফুটে উঠেছে এবং তা আয়বৈষম্য বাড়াবে।

তৈরি পোশাক খাতের ওপর উৎসে কর আরোপের বিষয়টি পর্যালোচনাযোগ্য। ১০-১৫ বছর ধরে এ খাতে যে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, তা শ্লথ হয়ে গেছে। প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি না হলে পোশাক খাতে ২০২১ সাল নাগাদ ৫০ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয়ের লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হবে না। পোশাক রফতানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। নতুন করে উৎসে কর বাড়ালে রফতানি খাতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা আরও হ্রাস পাবে। প্রতিযোগী অনেক দেশ তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটিয়েছে। বিপরীতে টাকার মূল্য বাংলাদেশে ধরে রাখা হয়েছে। এতেও রফতানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। টাকার অবমূল্যায়নের বিষয়টি বিবেচনা করা দরকার।

এদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ২৪ লাখ ৮১ হাজার ৯০১ কোটি টাকা সংগ্রহ করা আদৌ সম্ভব হবে কিনা, এ আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রস্তাবিত ও সংশোধিত বাজেটে এনবিআর কর্তৃক সংগৃহীত করের পার্থক্য ছিল ১৮ হাজার ১৫২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নতুন ভ্যাট আইন প্রবর্তন না হওয়ায় ভ্যাটের বর্ধিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। রফতানি ও প্রবাসী আয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে নিন্মমুখী প্রবণতা রয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষি ফসল উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ অবস্থায় রাজস্ব আদায়ের এই উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। তাই অর্জনযোগ্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তদারকি ও নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন।

রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য বিনিয়োগ খুব গুরুত্বপূর্ণ। রাজস্ব নীতিকে বিনিয়োগবান্ধব করতে আরও সংস্কারের প্রয়োজন। কিছু সংস্কার প্রতিবছরই করা হয়, সে হিসাবে আরও কিছু করার সুযোগ ছিল। ব্যক্তিগত পর্যায়ে আয়কর একই রাখা হয়েছে, মূল্যস্ফীতির কারণে এ খাতে কিছু সংস্কার দরকার ছিল।

মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

http://www.jugantor.com/sub-editorial/2017/07/07/137451