৭ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, ৫:০৪

ফরহাদ মজহারের কী অপরাধ

মাসুদ মজুমদার

ফরহাদ মজহার এখনো বিপর্যস্ত, অসুস্থ ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় হাসপাতালে রয়েছেন। অজানা আতঙ্ক এখনো তাকে তাড়া করছে। তার দেয়া জবানবন্দী আদালতের হাতে। তিনি শঙ্কামুক্ত হয়ে আবার কলম ধরবেন। জাতিকে নির্দেশনা দেবেন, তার প্রতিবাদী কণ্ঠ আবার দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করবেÑ এটা আমাদের প্রত্যাশা। তার মামলা ডিবিতে গেছে, তারা তদন্ত করবে না ডিপ ফ্রিজে রাখার ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে, তাও ভবিষ্যৎ বলবে। অনেকেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সাবাসি দিচ্ছেন। পুলিশকে স্বল্পসময়ের মধ্যে উদ্ধারের জন্য বাহবা দিচ্ছেন। আমরা সব প্রশ্নের জবাব না পেলে সাবাসি দিতে পারি না। কারা অপহরণের হোতা? অপহরণে ব্যবহৃত মাইক্রোবাসটি কোথায়? অপহরণকারীরা যশোর-খুলনার দিকে যাচ্ছিল কেন? মোবাইল ট্রাকিংয়ের পরও উদ্ধারে এত বিলম্ব হলো কী জন্য? ঢাকা থেকে খুলনা দীর্ঘ পথে মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের পরেও চেকপোস্ট বসিয়ে মাইক্রোবাসটি আটকের চেষ্টা কেন করা হলো না? খুলনার রেস্টুরেন্ট পর্যন্ত যাওয়া ও খাওয়ার বিলের টাকা দিলো কে? তাদের পরিচয় কী? হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দেয়ার নাটুকেপনা কারা করল? তাকে ঢাকা পাঠানোর পুরো বিষয়টি রহস্যাবৃত রাখা হচ্ছে কেন? কারা টিকিট ধরিয়ে দিলো, তাও রহস্যময়।

সাধারণত তিন-চারজন যাত্রী নিয়ে কোনো পরিবহন ঢাকায় আসে না। তা ছাড়া এখন ঈদ মওসুম। র্যা ব-পুলিশ যদি উদ্ধারকারী হয়, তারা অপহরণকারী শনাক্ত করেনিÑ এটা কিভাবে বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী তাকে জাতিকে ব্যাখ্যা দিয়ে জানাতে হবে সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেয়ার শঙ্কা জাগল কেন। এতসব প্রশ্নের বাইরেও বাস্তবে অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে গাড়ির নিচে বসিয়ে রাখা হয়। অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়।
আমরা ভুলে যাইনি বিএনপি সরকারের আমলে তিনিও একবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। সেটা ছিল আনসার বিদ্রোহের ব্যাপারে। তিনি মন্তব্য করেছিলেনÑ এরা কৃষকের সন্তান তাই বঞ্চিত হয়েছেন। বিদ্রোহ উসকানি দেয়ার কোনো অভিযোগ ছিল না। বর্তমান সরকারি মহলে তার ওপর বিরক্তি কারো অজানা নেই। আমরা যদ্দুর জানি, ফরহাদ মজহার একজন বামপন্থী তাত্ত্বিক। তার সব তত্ত্বের ভক্ত সবাই হবেনÑ এমনটি কেউ আশা করে না। তবে মোটা দাগে তিনি একজন চিন্তাবিদÑ তার সব চিন্তা জাতিকে ঘিরে। দেশকে নিয়ে। সেখানে তিনি সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে একজন নিখাদ দেশপ্রেমিক এবং যুক্তিবাদী মানুষ। দেশের মানুষ ও দেশ নিয়ে তার ভাবনার ব্যাপারে কোনো বিতর্ক নেই। হেফাজত ইস্যুতে তার অবস্থান স্পষ্ট। ঢাকায় লাখ লাখ লোকের উপস্থিতির প্রেক্ষাপটে তিনি বলেছিলেন এরাই বাংলাদেশ। এটা কোনো উসকানি ছিল না, ছিল আবেগাপ্লুত মানুষের অনুভূতি। এর সাথে দ্বিমত করার অধিকার সবার আছে। ফরহাদ মজহারেরও চিন্তার স্বাধীনতা আছে। চিন্তার স্বাধীনতা যারা মেনে নিতে পারে না তারাই ফ্যাসিস্ট।

ফরহাদ মজহারের ব্যাগ ও পোশাক সবার চেনা, তার চলন-বলন এবং চেহারা-সুরতও কারো অচেনা নয়। তাই তার ব্যাগতত্ত্বের কোনো উত্তর এখনো মিলছে না। উত্তর পাচ্ছি না অপহরণকারীদের অসংলগ্ন আচরণের। তাকে যেভাবে ঢাকায় পাঠানো হলো তারও হিসাব মিলাতে পারছি না। অপহরণকারীদের উদ্দেশ্য যাই হোক, তারা ফরহাদ মজহারের বন্ধু, সুহৃদ কিংবা শুভাকাক্সী নন। তাদের চেহারা অচেনা। তারা কারা অনুমান করতে পারেননি ফরহাদ মজহার নিজেও।
ফরহাদ মজহার বাড়াবাড়ি করার মতো মানুষ নন। চিন্তাগত ফারাক অন্য জিনিসিÑ সেটা চিহ্নিত হওয়া উচিত। তাহলে কারা তাকে জব্দ করতে এতটা নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছে? সব প্রশ্নের জবাব না মিললে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বাহবা দেবো কিভাবে। তবে ফরহাদ মজহার ইস্যুতে তার সহমর্মী মানস কোনোভাবেই অশ্রদ্ধা করা যায় না। তাকে ওপারে ঠেলে দেয়ার শঙ্কা আমরা গুরুত্বের সাথে নেয়ার পক্ষে।

এখন ঘুরেফিরে প্রশ্ন একটাইÑ গুম ও অপহরণের যে দীর্ঘ তালিকা, বিচারবহির্ভূত হত্যার যে ফর্দ তার শেষ কবে হবে! কেই বা থামাবে এ অনাচার। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের উপসংহার না টানলে জাতিকে খাদের কিনারা থেকে উদ্ধার করবে কে? ভারত-ইসরাইলের নয়া কৌশল পড়শিদের জন্য আরো বিপজ্জনক হবে নাÑ সেই নিশ্চয়তা কার কাছে পাবো? কারণ ইসরাইলি বর্ণবাদী ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্রটি কারো বন্ধু হলে তার আর শত্রুর প্রয়োজন হয় না। ১৯৪৮ সাল থেকে আরবজাহান ও বিশ্ববাসী সেই ইসরাইলি গোয়েন্দা মোসাদের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে ভীতিকর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। এখন অভিজ্ঞতার ডালি কি আমাদের সীমান্তের ওপারে! অনেক পেছনে যাওয়ার গরজ নেই। প্রয়োজনও নেই। শফিক রেহমান প্রথিতযশা সাংবাদিক, উপস্থাপক ও রাজনৈতিক গদ্যের ভিন্ন ধারার লেখক। কিভাবে তাকে গুটিয়ে যেতে বাধ্য করা হলোÑ তা তো কারো ভুলে যাওয়া উচিত নয়। মাহমুদুর রহমান নিয়ে অল্প কথা বলাই ভালো। তিনি যখন সাদাকে সাদা বলা শুরু করলেন। লেখা শুরু করলেন নিজের মতো করে। হুল ফুটিয়ে দিলেন নীতিনির্ধারকদের শরীরে। তিনি হয়ে উঠলেন অসহ্য মানুষ। তারপরের ঘটনা সবার স্মৃতিতে তাজা।
আরো কম করে জনাদশেক মানুষের নাম বলা যাবে, যারা সাদাকে সাদা বলতে অভ্যস্ত হওয়ার কারণে এখন ‘অপাঙ্ক্তেয়’। তাদের টকশোতে ডেকে কর্তৃপক্ষ ঝুঁকির পাল্লা আরো ভারী করে তুলতে চান না। তাদের লেখা ছাপিয়ে কোপানলে পড়তে নারাজ। অবশিষ্ট রইলেন কবি, গবেষক ও চিন্তাবিদ ফরহাদ মজহার। কলাম লিখেন নিজস্ব ভাব ও ভাষায়। ইনসাফের কথা বলেন। মানবিকতার কথা বলেন। মানবাধিকারের কথা বলেন। বিচারবহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে সরব থাকেন। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কথা বলেন। পরাশক্তির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ উচ্চারণে কথা বলেন। ভারতবিরোধিতার নামে সস্তা রাজনীতি করতে নিরুৎসাহিত করেন। নেতা-নেত্রীদের দেশের জনগণকে মর্যাদা দিয়ে পরিকল্পনা নিতে বলেন। আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জাতিকে সতর্ক করেন। দেশপ্রেমের প্রেরণা জোগান। যা বলেন অনেক বেশি ঋজু ভাষায় বলেন। যারা বোঝেন না তারা চুপ থাকেন। যারা বোঝেন তারা অসহ্য বিবেচনা করেন। যাদের কাছে ফরহাদ মজহারের লেখা-চিন্তা অসহ্য, তারাই তাকে অপহরণ করেছেন। হয়তো হজম করতে পারেননি কিংবা চালে ভুল করেছেন। এমনও হতে পারেÑ একটা বড় খেলার মাঠ তৈরি করতে ফরহাদ মজহার বলির পাঁঠা হতে হতে বেঁচে গেলেন। এটাকেই বলা হয়Ñ রাখে আল্লাহ মারে কে? এখন যারা ফরহাদ মজহারকে শুইয়ে পেটাতে চাচ্ছেন, তাদের জন্য সলিমুল্লাহ খানের দাওয়াই যথেষ্ট। আরো খুঁচিয়ে যারা ক্ষত দগদগে করে সেখানে নুন ছিটাতে চান, তাদের জন্য বার্তা একটাই, যারা মৃত্যুকে জয় করার মতো সাহস সঞ্চয় করেন তারা কখনো হেরে যান না। হেরে যায় ভীরু কাপুরুষ এবং সময়ের কুসন্তানেরা।

স্মৃতি প্রতারণা না করলে অনেকেরই স্মরণে পড়ার কথা, এবিএম মুসা টকশোতে বলেছিলেন, এক সময় বর্তমান সরকারের মুখপাত্ররা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় জনগণ বলবেÑ ‘ধর ধর ওই চোর যায়।’ তারপর মুসা ভাইকে কে বা কারা সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তিনি আমৃত্যু টকশো এড়াতেন!

আসাফউদ্দৌলা সত্য কথা সাহসের সাথে বলতেন, হঠাৎ একদিন টকশো থেকে বাড়ি ফেরার পথে তাকে টার্গেট করে অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দিলো। তিনি পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছিলেন, কিন্তু আর টকশোতে কথা বলতে রাজি হলেন না। কলাম লেখাও বন্ধ করে দিয়ে কুরআন চর্চায় মনোযোগ দিলেন। সাদাকে সাদা বলে সত্য উচ্চারণের একটা ভাবমর্যাদা সৃষ্টি করেছিলেন আসিফ নজরুল। তাকে এড়ানোর বিষয়টি কারো দৃষ্টি এড়াল না। ডক্টর তুহিন মালিক সাহসী উচ্চারণে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেনÑ এক সময় দেখা গেল, তিনি আর ডাক পান না। শেষ পর্যন্ত দেশের বাইরে থাকা ভালো ভাবলেন। নূরুল কবির দেশপ্রেমিক বাম ধারার সাহসী সাংবাদিক। অনুগত দাসানুদাসের মতো কথা বলেন না। বামপন্থী এই সাংবাদিক কথা বলতেন সাহসের সাথে এবং ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে। এক সময় দেখা গেল তার গাড়ি অনুসরণ করে জানান দেয়া হলো ‘খামোশ’। বিরোধীদলীয় রাজনীতির তুখোড় মানুষের দিকে তাকানÑ মামলার স্তূপ ঠেলে তারা সামনে পথ চলতে পারেন না। সামনে পাঁচ কদম এগোলে হেঁচকা টানে পনেরো কদম পিছিয়ে দেন।

মির্জা ফখরুলরা প্রায় শ’খানেক মামলার ঘানি টানছেন। খালেদা জিয়ার হাজিরার ধরন দেখুন না। গণতন্ত্রের এই ধরনের ভীতিকর বাতাবরণে কখনো বসন্ত আসে না, আসে দুর্যোগ। জানি না, রাজনীতিবিদেরা দুর্যোগ আঁচ করতে পারছেন কি না।
masud2151@gmail.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/233520