গতকালের বর্ষণের ফলে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক বঙ্গভবন সড়কের দৃশ্য
৬ জুলাই ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১:০৮

টানা বৃষ্টিতে রাজধানীর কোথাও হাঁটু পানি কোথাও কোমর পর্যন্ত

আষাঢ়ের টানা বর্ষণে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। সমন্বয়হীন খোঁড়াখুড়ির কারণে নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক থেকে অলি-গলি, মহল্লা পর্যন্ত কোথাও হাঁটু পানি, কোথাওবা কোমর পর্যন্ত প্লাবিত হয়ে গেছে। এতে নাগরিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী থেকে অফিসগামী পথচারি সবাইকে পড়তে হচ্ছে চরম দুর্ভোগে। নগরীর এমন নানা বিড়ম্বনার চিত্র দেখে গতকাল বুধবার অনেককেই বলতে শোনা গেছে, ঢাকা এখন অস্বস্তির নগরীতে পরিণত হয়েছে।
বর্ষা আসার আগে থেকেই এবার প্রবল বৃষ্টিপাত হতে থাকে। গতকালও যেন রাজধানীর আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। দিনভর থেমে থেমে বারিপাত হয়েছে। এদিন দুপুর একটা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ৬ ঘন্টায় ঢাকায় ১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করলেও সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আগের চব্বিশ ঘন্টায় বৃষ্টি হয়েছে ৫২ মিলিমিটার। আগের দিন মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী চব্বিশ ঘন্টায় ঢাকায় বৃষ্টিপাত হয় ২৮ মিলিমিটার। অতি ভারি বর্ষণ না হলেও প্রতিদিনই রাজধানীতে হালকা থেকে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। অব্যাহত বর্ষণে রাজধানীর সর্বত্রই কম-বেশি পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।

এদিন দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে কক্সবাজারে ২৭১ মিলিমিটার। এছাড়া কুতুবদিয়া ১৯৭, টেকনাফ ২২৩, ফেনী ১৪২, গোপালগঞ্জ ৮৪, বগুড়া ৭৮, মংলা ৭৪ ও পটুয়াখালেিত ১১৩ মিলিমিটার রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদফতর।
মঙ্গলবার রাতের টানা বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে গেছে। গতকাল সকাল থেকে কর্মমুখী মানুষদের ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। বিভিন্ন সড়কে পানিবদ্ধতার কারণে নগরজুড়ে তীব্র যান জটের পাশাপাশি পরিবহন সংকটও দেখা গেছে।

সকালে রাজধানীর মতিঝিল, গুলিস্তান, বঙ্গবাজার, পল্টন, নাজিমউদ্দিন রোড ও পুরনো ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, এসব এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া মীরপুর, শ্যামলী, কালশী, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে নতুন বাজার, খিলক্ষেত, রায়েরবাজার, মোহাম্মদপুর, রামপুরা, বাড্ডা, মৌচাক, খিলগাঁও, জুরাইন, পূর্বজুরাইনসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়ক ও নিম্নাঞ্চলের বাসাবাড়িতে পানি উঠে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বক্সগভবনের পাশের রাস্তায়ও কোথাও হাঁটু পানি, কোমর পর্যন্ত পানিতে প্লাবিত হয়ে পড়ে। যাত্রাবাড়ি ও সায়েদাবাদ থেকে গুলিস্তান হয়ে মিরপুর বা অন্য গন্তব্যের যানবাহনকে মতিঝিল-দিলকুশা হয়ে যাতায়াত করতে হয়েছে। মালিবাগ রেলগেট-মৌচাক এলাকায় হাঁটুর উপরে পানিতে কেবল বাসগুলোই চলাচল করতে পেরেছে।
বৃষ্টির কারণে খানাখন্দে ভরা সড়কগুলোতে দুর্বিসহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সকালে পরিবহন সংকট দেখা দেওয়ায় অফিসগামী মানুষকে দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। রাজধানীর জলাবদ্ধতা বড় ধরনের সমস্যা হলেও তা নিরসনে এখনও পর্যন্ত দীর্ঘ মেয়াদের কোনও উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

পানিবদ্ধতার ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র সাঈদ খোকন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা শান্তিনগরেরর পানিবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে সফলতা পেয়েছি। নাজিমউদ্দিন রোডের পানিবদ্ধতা নিরসনে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। আগস্টের মধ্যেই এর কাজ শুরু হবে। এরপর আর কোনও জলাবদ্ধতা থাকবে না। শান্তিনগরে এবছর ৮৫ ভাগ পানিবদ্ধতা কমে গেছে। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অন্যান্য এলাকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
নগরীতে ভারী বর্ষণ হলে ডিএসসিসির মতিঝিল এলাকায় কিছুটা পানিবদ্ধতা দেখা দেয়। এ বিষয়ে ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘শান্তিনগরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মতিঝিলে আরও একটি প্রকল্প নেয়া যায় কিনা তা চিন্তাভাবনা করছি।’

ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকন জানান, পানিবদ্ধতা নিরসনে তার সংস্থা থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩১০ কিলোমিটার নর্দমা পরিষ্কার এবং ২৩৯ দশমিক ১৫ কিলোমিটার নর্দমা নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ১৪০ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। এ জন্য ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি অত্যাধুনিক জেট অ্যান্ড সাকার মেশিনও কেনা হয়েছে।
ডিএসসিসির পূর্ব জুরাইন ও ডিএনডি বাঁধ এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ এলাকার পানিবদ্ধতা নিরসনে পাম্পের মাধ্যমে পানি অপসারণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এরই মধ্যে প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। তবে যেসব এলাকায় পাম্প ও ড্রেন বসবে বেদখল হওয়া সেসব এলাকায় প্রথমে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে। এরপর পাম্পের মাধ্যমে পানি সেচ দিয়ে বুড়িগঙ্গায় ফেলা হবে। ফলে এলাকার জলাবদ্ধতা কমবে বলে মনে করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। যদিও অন্যান্য বছরের মতো এবছরও এই এলাকাবাসীকে পানিবদ্ধতায় দুর্ভোগ পোহাতে হবে।
সম্প্রতি ডিএনসিসির বাজেট বক্তৃতায় ডিএনসিসি মেয়র আনিসুল হক বলেন, ‘আমরা পানিবদ্ধতা নিরসনে খাল উদ্ধার অভিযানে নামছি। এরইমধ্যে ঢাকা ওয়াসা ও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছি। কিছু কিছু খালের মধ্যে বহুতল ভবন পর্যন্ত উঠে গেছে। এ পযন্ত অন্তত চার শতাধিক ভবন ভেঙে দেয়া হয়েছে।’

সম্প্রতি রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে নগরভবনের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে উত্তর সিটি মেয়র আনিসুল হক বলেন, পানিবদ্ধতা নিরসনে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৬৮ কিলোমিটার ড্রেনের উন্নয়ন করা হয়েছে। গত অর্থবছরেও ৩০০ কিলোমিটার ড্রেনের উন্নয়ন করা হয়েছে। পানিবদ্ধতা নিরসনে দুই সিট করপোরেশনে প্রায় ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি অত্যাধুনিক 'জেট অ্যান্ড সাকার মেশিন' যুক্ত করা হয়েছে।’
ডিএনসিসি বলছে, এই যন্ত্রটি প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা কাজ করতে পারবে। প্রতি ১০ মিনিটের মধ্যে ১২০ মিটার দীর্ঘ ড্রেন সম্পূর্ণ পরিষ্কার করা যাবে। কিন্তু, দুই মেয়র, সিটি করপোরেশন আর ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তাদের এত আশ্বাস ও কর্মসূচির পরেও পানিবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না নগরবাসী। এখনও সামান্য বৃষ্টি হলেই মিরপুর, কালশী, কারওয়ান বাজার, কুড়িল, খিলক্ষেতসহ বিভিন্ন এলাকায় জমে যাচ্ছে থই থই পানি।

এছাড়া মিরপুর এলাকার কোথাও চলছে ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎ, টেলিফোন, গ্যাস, অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল প্রতিস্থাপনের কাজ। আবার কোথাও চলছে পয়ঃনিষ্কাশনের সংযোগ প্রশস্তের কাজ, কোথাও ওয়াসার পানি সরবরাহের সংযোগ বসানোর কাজ। সড়কজুড়ে চলছে খোঁড়াখুড়ি। একটি বাস চলাচলের মতো প্রশস্ত জায়গা দিয়ে লাইন ধরে ধীরগতিতে চলছে গাড়িগুলো। সঙ্গে বৃষ্টি-কাদা-পানিবদ্ধতা। মিরপুরের প্রবেশদ্বার আগারগাঁওয়ের বর্তমান চিত্র এমনই।

ব্যস্ততম এ সড়কে প্রতিদিন হাজার হাজার গাড়ি চলাচল করে। কিন্তু অর্ধেক রাস্তা কাটার ফলে তা সরু হওয়ায় দীর্ঘ যানজটের বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে মিরপুরগামী লাখ লাখ মানুষকে। তালতলা থেকে শুরু করে মিরপুর-১০ গোলচত্বর পর্যন্ত দীর্ঘক্ষণ গণপরিবহনে বসে থাকতে হচ্ছে। অনেকে বাধ্য হয়ে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে কাছের গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন।
মাসের পর মাস ধরে চলা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে জনদুর্ভোগ তীব্র আকার ধারণ করছে। ‘উন্নয়নের ভোগান্তি’ দেখে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেট্রোরেল প্রকল্প, ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশন, তিতাস, বিটিসিএলসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের সেবা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে অব্যাহত এ খোঁড়াখুঁড়িতে অতিষ্ঠ মানুষ। শিগগিরই তারা এ থেকে মু্ক্িত চান।

এদিকে আরও প্রায় দুই তিন দিন একই আবহাওয়ার অবস্থা বিরাজ করবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। ভারি বৃষ্টির কারণে পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভুমিধসের শঙ্কাও প্রকাশ করেছে আবহাওয়া অধিদফতর। আবহাওয়াবিদ শাহিনুল ইসলাম বলেন, ‘এখন আষাঢ় মাস, স্বাভাবিক ভাবেই বৃষ্টিপাত হবে। এখনও অতি ভারি বৃষ্টিপাত হয়নি। কোথাও কোথাও অতি ভারি বৃষ্টিপাত হতে পারে। এ অবস্থা পরিবর্তন হতে আরও দুই তিন দিন সময় লাগতে পারে।

এদিকে গতকাল সন্ধ্যা ৬ টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘন্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, মওসুমী বায়ুর অক্ষ রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত। এর একটি বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মওসুমী বায়ু বাংলাদেশের উপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারী থেকে প্রবল অবস্থায় রয়েছে। এর প্রভাবে রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ী দম্কা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারী ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারী ধরনের ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে।

http://www.dailysangram.com/post/290432