৬ জুলাই ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১২:২৮

বিনিয়োগে আস্থা পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা

দুই লাখ খেলাপির হাতে ৭৩ হাজার কোটি টাকা; অস্বাভাবিক অবকাঠামো ব্যয়ে উদ্যোক্তারা হতাশ; পাঁচ বছরে বিনিয়োগ বেড়েছে দুই শতাংশের কম

দেশে সরকারি বিনিয়োগ প্রতি বছরই বাড়ছে। অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় করা হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকঋণের সুদহারও সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে এসেছে। কিন্তু ব্যাংকে অলস টাকা পড়ে থাকলেও উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের জন্য সে টাকা নিচ্ছেন না। উল্টো আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে অনেক উদ্যোক্তাই বন্ধ করে দিচ্ছেন নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান। বিশ্লেষকদের মতে, বেসরকারি বিনিয়োগে এমন খরার পেছনে মূল কারণ আস্থাহীনতা। বিনিয়োগে আস্থা পাচ্ছেন না বেসরকারি উদ্যোক্তারা।

অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী সরকারি বিনিয়োগ বাড়লে বেসরকারি খাতেও বিনিয়োগে গতি আসে। কিন্তু গত ছয় বছর সরকারি বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে বাড়ানোর পরও ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২২ শতাংশের ঘরেই আটকে আছে। আবার ব্যাংক ঋণে সুদের হার কমলে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগমুখী হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তাও হচ্ছে না। সুদহার সিঙ্গেল ডিজেটে নামার পরও ব্যাংকে অলস টাকা পড়ে আছে, কিন্তু ব্যবসায়ীরা ঋণ নিচ্ছেন না।
দেশে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না জানিয়ে সিপিডির সম্মানিত ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য নয়া দিগন্তকে বলেন, বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি না পাওয়ায় বাড়ছে না কর্মসংস্থানও। কিন্তু সরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে ঘাটতি পূরণের চেষ্টা চলছে। বেসরকারি বিনিয়োগে নিরুৎসাহিতার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এর কারণ হলো পুরো উন্নয়নে গুণগতমানের চেয়ে সংখ্যার ওপর বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। বিনিয়োগ বাড়াতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের আস্থায় আনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ইউরোপে যেখানে চার লেনের এক কিলোমিটার রাস্তার নির্মাণ ব্যয় ২৮ কোটি টাকা সেখানে আমাদের দেশে ব্যয় হচ্ছে ৫৪ কোটি টাকা। চীনে এমন রাস্তায় খরচ হয় ১২ থেকে ১৩ কোটি টাকা। আট হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতুর ব্যয় বেড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এ খরচ শিগগিরই ৪০ হাজার কোটি টাকা হয়ে যাবে বলে অনুমান করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। দুই লাখ লোকের কাছে বছরের পর বছর আটকে আছে এ টাকা। গত তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় বলা হয়, এবারের বাজেটে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। এই হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত বিনিয়োগ লাগবে। এর মধ্যে সরকারি উৎস থেকে বিনিয়োগ আসবে ৫০ হাজার কোটি টাকা। সে ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রয়োজন হতে হবে ৬৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বর্তমান কাঠামোতে এক বছরে এই পরিমাণ বিনিয়োগ সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ঘর অতিক্রম করলেও জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমছে। বিবিএসের হিসেবে চলতি বাজারমূল্যে জিডিপির পরিমাণ দাঁড়াবে ১৭ লাখ ২৯ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ ৩ লাখ ৭৬ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা, যা জিডিপির ২১ দশমিক ৭৮ শতাংশ। আগের অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ২২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।

বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপ (বিডা) সূত্রে জানা যায়, বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটাতে ওয়ান স্টপ সার্ভিস আইন পাস হয়েছে। এর ফলে বিনিয়োগের জন্য একটি দফতর থেকেই ১৬ ধরনের সেবা মিলছে। এর মধ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভূমি নির্বাচনের অনুমতি, অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা, বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়ার অনুমোদন, সার্টিফিকেট অব অরিজিন বা উৎস দেশের সনদ, মূলধন ও লভ্যাংশ ফেরত নেয়ার অনুমোদন দেয়া হবে। পাশাপাশি রেসিডেন্ট ও নন-রেসিডেন্ট ভিসা, কাজের অনুমতি বা ওয়ার্কপারমিট, নির্মাণের অনুমোদন, হাইটেক পার্কের ভূমি নির্বাচনের অনুমতি, প্লট বরাদ্দ বা ইজারা, পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও টেলিফোন সংযোগ, যেকোনো ধরনের আইনগত দলিল এবং সরকার ঘোষিত অন্যসব সেবাও দিচ্ছে এ অফিস। কিন্তু কোনো কিছুতেই বিনিয়োগ বাড়ছে না।

জানা যায়, দেশের ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। এর বিপরীতে গত এক বছরে খেলাপি ঋণ আদায় হয়েছে মাত্র তিন হাজার ১৫২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ১০ হাজার ৬২৯ কোটি, বেসিক ব্যাংকের ৭ হাজার ৩৭৪ কোটি, জনতা ব্যাংকের ৬ হাজার ৫১০ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের ৬ হাজার ৮৬ কোটি, কৃষি ব্যাংকের ৪ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা এবং রূপালী ব্যাংকের রয়েছে ৪ হাজার ২৬৪ কোটি। খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। স্বাভাবিক কারণেই বিনিয়োগ স্থবিরতার জন্য এমন কুসংস্কৃতিকে বহুলাংশে দায়ী করছেন বিশ্লেষকেরা।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীা-২০১৭ অনুযায়ী, দেশে এখন বিনিয়োগের হার জিডিপির ৩০ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বিনিয়োগের হার ছিল ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ। পাঁচ বছরে দেশে বিনিয়োগ বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ২১ দশমিক ২৮ শতাংশ। পাঁচ বছর পর এখনকার বিনিয়োগের হার ২৩ দশমিক শূন্য শতাংশ। বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৭২ শতাংশ। সরকারি এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ কতটা নাজুক পরিস্থিতিতে।

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো সমস্যা এবং জমির সহজপ্রাপ্যতার অভাবকে বিনিয়োগ না হওয়ার কারণ জানিয়ে ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখনো অনেকে আস্থার সঙ্কটে ভুগছেন। এ ছাড়া শিল্পে গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় এবং এখনো ঠিকমতো সংযোগ না পাওয়ায় বিনিয়োগ প্রকল্প হাতে নিয়েও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। এর সঙ্গে আছে অনুন্নত অবকাঠামো। বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে বাজেটে কোনো দিকনির্দেশনা নেই বলেও মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন, দেশে বিনিয়োগের েেত্র নানান বাধা রয়েছে। গত এক বছরে দেশের বিনিয়োগের পরিবেশ আরো নিম্নমুখী হয়েছে। ফলে বিনিয়োগও হচ্ছে খুবই কম। বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও এ দেশে বিনিয়োগের েেত্র ‘ধীরে চলো’ নীতি গ্রহণ করছে।

অর্থনীতিতে মূল সমস্যা ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের অভাব মন্তব্য করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান নয়া দিগন্তকে বলেন, বিনিয়োগের জন্য তিনটি বিষয় জরুরি : সুশাসন প্রতিষ্ঠা, বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রণোদনা ও স্বচ্ছ ব্যাংকিং খাত। দেশের ব্যাংকিং খাতের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলো জনগণের টাকায় সম্পদ গড়ছে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে ওই সম্পদ দুর্বৃত্তদের হাতে চলে যাচ্ছে। দিনের পর দিন অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে। বাজেট থেকে অর্থ বরাদ্দ করে ব্যাংকগুলোকে সহায়তা দেয়া হচ্ছে। ব্যাংকিং খাত স্বচ্ছ না হলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়বে না বলেও সাফ জানিয়ে দেন তিনি।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/233364