৫ জুলাই ২০১৭, বুধবার, ১২:৩৮

সিলেটের ৭টি উপজেলায় পানিবন্দী মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগে

সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের মীর্জানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও প্রক্রিয়াধীন আশ্রয় কেন্দ্রের নিচতলা বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। ছবিটি গতকাল মঙ্গলবার ক্যামেরাবন্দী করেছেন ফটো সাংবাদিক আশরাফুল ইসলাম ইমরান
ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢল ও অব্যাহত ভারি বর্ষণে সিলেটের সাত উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয়নি। পানিবন্দী মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে। তাদের কষ্টের যেন শেষ নেই। গতকাল মঙ্গলবার পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ দেখতে ঢাকা থেকে এসেছিলেন দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। দক্ষিণ সুরমা উপজেলা প্রধান সড়কের উপর দিয়ে পাশর্^বর্তী ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ উপজেলায় পানিবন্দী মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখতে গেলেও পানিবন্দী দক্ষিণ সুরমা উপজেলাবাসীর খবর নেননি মন্ত্রী মায়া। বিপদগ্রস্ত মানুষের প্রতিমন্ত্রী মায়া মায়া না দেখিয়ে চলে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ দক্ষিণ সুরমাবাসী। সিলেটের অন্যান্য উপজেলার ন্যায় দক্ষিণ সুরমা উপজেলার জালালপুর, দাউদপুর ও মোগলাবাজার ইউনিয়নের প্রায় ২৪টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দী। মোগলাবাজার ইউনিয়নের উপর দিয়ে সিলেট-৩ আসনের এমপি মাহমুদ-উস-সামাদ কয়েসের নির্বাচনী এলাকা ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জবাসীর দুঃখ-দুর্দশা দেখলেন মন্ত্রী মায়া। কিন্তু অপর নির্বাচনী এলাকা দক্ষিণ সুরমাবাসী পাশে দাঁড়ালেন না এই মন্ত্রী। এতে করে এই উপজেলায় সমালোচনার ঝড় হয়ে যাচ্ছে। এই সমালোচনা থেকে বাদ পড়ছেন না এমপি কয়েস চৌধুরীও। গতকাল মঙ্গলবার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় পানিবন্দী মানুষের দুঃখ-দুর্দশা পরিদর্শনকালে মন্ত্রী মায়া বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে পানিবন্দী মানুষের সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করা হবে। এরপর তিনি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে এক মতবিনিময় সভায় যোগদান করেন।

সিলেট জেলার ৭টি উপজেলার অন্তত ৩ লক্ষাধিক পানিবন্দী মানুষ রয়েছেন চরম দুর্ভোগে। বন্যাকবলিত এলাকায় দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। বাড়ছে পানিবাহিত নানা রোগের প্রকোপ। কাজ না থাকায় দিনমজুর মানুষরা কর্মহীন হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। ত্রাণ না পেয়ে বাড়ছে মানুষের হাহাকার।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। সিলেটের বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, ওসমানীনগর, গোলাপগঞ্জ, জকিগঞ্জ ও কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা বন্যার পানিতে তলিয়ে রয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কুশিয়ারা ও সুরমা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। সোমবার বিকেল পর্যন্ত কুশিয়ারা নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমারা ১৩৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল পানি। এছাড়া নদীর আমলসিদ পয়েন্টে বিপদসীমার ৯৪ সেন্টিমিটার ও শেওলা পয়েন্টে ১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। এদিকে, সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার দশমিক ৫৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ কমছে না।
গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিনে বিয়ানীবাজারে গিয়ে দেখা যায়, এ উপজেলার দশটি ইউনিয়নের মধ্যে সাতটিই বন্যাকবলিত। উপজেলার দুবাগ ইউনিয়নের সাদিমাপুর, সিলেটিপাড়া গ্রাম ও মেওয়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এসব গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে আছে। গ্রামের বাড়িঘর, রাস্তাঘাট সবকিছুই পানির নিচে নিমজ্জিত। যানবাহন চলাচলের রাস্তার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় সেখান দিয়ে নৌকা চলাচল করতে দেখা গেছে। যাদের নৌকা নেই, তারা হাঁটু ও কোমর পানি ভেঙে কষ্ট করে চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছেন। বন্যাকবলিত গ্রামগুলোর অনেক বাড়িতেই অসুস্থ মানুষজন রয়েছেন। কিন্তু চারদিকে থৈ থৈ পানি থাকায় অসুস্থদের নিয়ে চিকিৎসাকেন্দ্রে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বন্যাদুর্গত মানুষরা জানান, দুই দিন পানি কিছুটা কমলেও সোমবার থেকে আবারও পানিবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।

সরেজমিনে বালাগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় গিয়েও একই অবস্থা প্রত্যক্ষ করা গেছে। ফেঞ্চুগঞ্জে প্রায় এক মাস ধরে দীর্ঘমেয়াদী বন্যায় চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন মানুষ। বালাগঞ্জ উপজেলার প্রায় আশি ভাগ এলাকা বন্যাকবলিত। বন্যার পানিতে ডুবে গেছে উপজেলা পরিষদ, ডাকবাংলো, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সও। বন্যার কারণে নলকূপ তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়া খাদ্য সংকটও তীব্র হয়ে ওঠছে। ছড়িয়ে পড়ছে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়াসহ পানিবাহিত নানা রোগের প্রকোপ।

দক্ষিণ সুরমায় প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন গ্রাম : এদিকে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার বন্যায় আক্রান্ত গ্রামগুলোর মানুষ পর্যাপ্ত পরিমাণ সরকারি সহযোগিতা পাচ্ছেন না। সিলেটের অন্যান্য উপজেলায় বন্যার্তরা যেভাবে সহায়তা পাচ্ছে সেই তুলনায় দক্ষিণ সুরমায় তা খুবই অপ্রতুল্য। এতে করে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টির পাশাপাশি ত্রাণের জন্য হাহাকারের সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিদিন নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে উপজেলার দাউদপুর, মোগলাবাজার ও জালালপুর ইউনিয়নের ২৪ টি গ্রাম পুরাপুরি পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। এ গ্রামগুলোতে জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত সহায়তা প্রদান জরুরী হয়ে পড়েছে। এ এলাকার ৩/৪ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি থাকায় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়েছে। তাছাড়া উপজেলার অন্যান্য ইউনিয়নের আরো বেশ কয়েকটি গ্রাম আংশিক পানির মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে।
টানা বৃষ্টি, উজানের ঢল, কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ‘কুশিয়ারা ডাইক’ ভেঙে যাওয়ার কারণে বন্যা প্লাবিত হয় দক্ষিণ সুরমা উপজেলা। চৈত্রের অনাকাক্সিক্ষত বন্যায় এলাকার কৃষকদের বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ার পর আশায় বুক বেঁধে আউশ ধানের চাষ করলেও ইতিমধ্যে বন্যার জলে অনেক ফসলী জমি বন্যার পানির নিচে নিমজ্জিত রয়েছে। উপজেলায় ১৫০ হেক্টর আউশ ফসল পুরোপুরি পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। এতে কৃষকদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে।
দ্রুত পানি বৃদ্ধির কারণে ডুবে গেছে ১০টি ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামীণ রাস্তাঘাট, বসতবাড়ি, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। তলিয়ে গেছে আউশ ধান, ভেসে গেছে মৎস্য খামার ও পুকুরের মাছ। সব মিলিয়ে বন্যার কারণে চরম দুর্ভোগে রয়েছে উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নতুন নতুন এলাকা বন্যা প্লাবিত হচ্ছে এবং মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানিতে নিমজ্জিত থাকায় বিভিন্ন পাকা রাস্তা গালা উঠে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

দ্রুত পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় দক্ষিণ সুরমার যেসব এলাকার মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন সেসব গ্রামগুলো হচ্ছে- দাউদপুর ইউনিয়নের ইনাত আলীপুর, মির্জানগর, মানিকপুর, সোনাপুর, পানিগাঁও, রাউৎকান্দি, সিকন্দরপুর, বিন্নাকান্দি, মোগলাবাজার ইউনিয়নের সোনাপুর, হরিনাথপুর, শাহাদতপুর, চিচরাকান্দি, আনিলগঞ্জ, মোহাম্মদপুর, মুর্তি, জালালপুর ইউনিয়নের সমসপুর, করিমপুর, মালাকান্দি, বুরুন্ডা, মোল্লারগাঁও ইউনিয়নের চিটা হাজরাই, লামা হাজরাই, গোয়ালগাঁও, কামালবাজার ইউনিয়নের শহীদপুর, কৃষ্ণপুর, কাড়ারপার, তেতলী ইউনিয়নের মাঝপাড়া, বিলপাড়, নিজগাঁও, সুনামপুর, বেটুয়ারপার, লালাবাজার ইউনিয়নের খতিরা, কৈইকুড়ি, বরইকান্দি ইউনিয়নের জৈনইপুর, চান্দাই মাঝপাড়া সিলাম ও কুচাই ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম সহ অর্ধশত গ্রাম।

বিশেষ করে দাউদপুর ইউনিয়নের ইনাত আলীপুর, মির্জানগর, মানিকপুর, সোনাপুর, পানিগাঁও, রাউৎকান্দি, সিকন্দরপুর ও বিন্নাকান্দি, মোগলাবাজার ইউনিয়নের সোনাপুর, হরিনাথপুর, শাহাদতপুর, চিচরাকান্দি, আনিলগঞ্জ, মোহাম্মদপুর, জালালপুর ইউনিয়নের সমসপুর, করিমপুর, মালাকান্দি, বুরুন্ডা, মুর্তি গ্রামের লোক পানি বন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। এ পরিবারগুলো পানি বন্দী হয়ে পড়ায় মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে। ত্রাণের জন্য হাহাকার রয়েছে পানিবন্দী মানুষের মধ্যে।

http://www.dailysangram.com/post/290378