৫ জুলাই ২০১৭, বুধবার, ১২:৩১

আদালতে ফরহাদ মজহারের জবানবন্দি

ওরা আমাকে চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে তোলে

‘আমি তাদের চিনি না, সরকারকে বিব্রত করতেই অপহরণ’ : নিজ জিম্মায় যাওয়ার পর বারডেমে ভর্তি

কবি ও কলামিস্ট ফরহাদ মজহারকে অপহরণের মূল উদ্দেশ্য ছিল সরকারকে বিব্রত করা। আর এ তথ্য তিনি নিজেই জবানবন্দিতে আদালতকে জানিয়েছেন। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘সোমবার ভোরে আমি ওষুধ কেনার জন্য বাসা থেকে বের হই। এ সময় সরকারকে বিব্রত করতে কে বা কারা আমাকে জোর করে চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। আমি তাদের চিনি না। অপহরণকারীরা আমার কাছে কোনো চাঁদা দাবি করেনি। আমি নিজেই অপহরণকারীদের মুক্তিপণ দিতে প্রস্তাব দিই। সে অনুসারে আমি টাকা ম্যানেজের জন্য বাসায়ও ফোন করি। কিন্তু তারা (অপহরণকারীরা) মুক্তিপণ না নিয়েই আমাকে ছেড়ে দেয়।’

প্রায় ১৯ ঘণ্টা নিখোঁজ থাকার পর মঙ্গলবার দুপুরে ফরহাদ মজহারকে আদালতে হাজির করা করা হয়। এদিন তিনি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় ভিকটিম হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহা. আহসান হাবীব তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন। এ ছাড়া এদিন একই আদালতে ভিকটিমের জিম্মার বিষয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানি শেষে আদালত ফরহাদ মজহারকে নিজ জিম্মায় যাওয়ার অনুমতি দেন।

ফরহাদ মজহারের আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, আদালত ১০ হাজার টাকা মুচলেকায় ভিকটিমকে (ফরহাদ মজহার) নিজ জিম্মায় যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন।

আদালতের আদেশে স্বামীকে ফিরে পেয়ে ভীষণ খুশি বলে জানিয়েছেন ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আক্তার। তিনি বলেন, প্রায় ৩৭ ঘণ্টা বয়োবৃদ্ধ মানুষটির সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে পুরো পরিবার। অসুস্থ মানুষটিকে নিয়ে আমাদের চিন্তার শেষ ছিল না। অবশেষে তাকে ফিরে পেয়েছি। এর চেয়ে আনন্দ আর কী হতে পারে! এ সময় আদালত চত্বরে ফরিদা আক্তারের সঙ্গে ছিলেন ফরহাদ মজহারের মেয়ে সমতলী হক, পারিবারিক বন্ধু গৌতম দাসসহ অন্যান্য আত্মীয়স্বজন।

এদিকে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান যুগান্তরকে জানান, রাত সাড়ে ৮টার দিকে ফরহাদ মজহারকে তার পরিবারের সদস্যরা বারডেম হাসপাতালে নিয়ে আসেন। সেখানে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে তিনি হাসপাতালের ১১০৬ নম্বর কেবিনে চিকিৎসাধীন।

এর আগে ফরহাদ মজহার গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, ওষুধ কিনতে বাসা থেকে বেরিয়ে তিনি অপহরণের শিকার হয়েছিলেন। কয়েকজন চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। মাইক্রোবাসে তোলার পর তিনি আর কিছু জানেন না।

মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন। এ সময় তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার উপস্থিত ছিলেন। বেলা ১১টার কিছু আগে মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আবদুল বাতেন বলেন, ‘ফরহাদ মজহার জানিয়েছেন, সোমবার ভোরে ওষুধ কেনার জন্য তিনি বাসা থেকে বের হলে কয়েকজন একটি মাইক্রোবাসে করে তাকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর উনি নিজের মোবাইল ফোন থেকে স্ত্রীকে ফোন করে জানিয়েছিলেন, ৩৫ লাখ টাকা দিলে উনাকে ছেড়ে দেয়া হবে। আমরা এখন জানার চেষ্টা করছি কারা উনাকে নিয়ে গিয়েছিল।’

সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে যশোরের অভয়নগরে খুলনা থেকে ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনের একটি বাস থেকে উদ্ধার করা হয় ফরহাদ মজহারকে। উদ্ধারের পর প্রথমে খুলনায় নিয়ে ফরহাদ মজহারকে ঢাকার পুলিশের কাছে তাকে হস্তান্তর করা হয়। মঙ্গলবার সকাল ৯টার কিছু আগে ফরহাদ মজহারকে প্রথমে রাজধানীর আদাবর থানায় নেয়া হয়। সেখানে নাস্তা করে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার পর ফরহাদ মজহারকে নিয়ে যাওয়া হয় মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে।

দুপুরে ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আক্তার, মেয়ে সমতলী হক ও পারিবারিক বন্ধু গৌতম দাসসহ কয়েকজনকে গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ের সামনে একটি মাইক্রোবাসে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। ফরিদা আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, ‘গতকাল যখন কথা হয়েছিল তখন বলেছিলেন, সারা দিন কোনো খাওয়া-দাওয়া করেননি। সন্ধ্যা পর্যন্ত তার চোখ বাঁধা ছিল। আজ সকালেও বেশি কথা বলতে পারিনি। ব্লাড প্রেসারের ওষুধ দিয়েছি আর সামান্য কিছু খাবার দিয়েছি।’

সংবাদ সম্মেলনের পর বেলা আড়াইটার দিকে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ড করতে দুপুরে ফরহাদ মজহারকে আদালতে নেয়া হয়। পুলিশ জানায়, এ ঘটনায় আদাবর থানায় ফরহাদ মজহারের পরিবারের করা অপহরণের অভিযোগটি মামলা হিসেবে নেয়া হয়েছে। আদালতে জবানবন্দি রেকর্ডের পর তার ভিত্তিতেই তদন্ত চলবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

সোমবার আদাবর থানায় করা সাধারণ ডায়েরিতে (অভিযোগ) ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আক্তার বলেছেন, ‘আমার স্বামী সাধারণত খুব ভোরে ঘুম থেকে জাগেন এবং লেখালেখি করেন। সকাল ৫টার দিকে আমার ঘুম ভাঙার পর আমি উনাকে লেখার টেবিলে না দেখতে পেয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি এবং সারা ঘরে খুঁজতে থাকি। ইতিমধ্যে সকাল ৫টা ২৯ মিনিটে আমার স্বামী তার ফোন থেকে আমাকে কল দেন। তিনি ভয়ার্ত কণ্ঠে জানান, ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে, মেরে ফেলতে পারে। এরপর ফোনটি কেটে যায়। কে বা কারা তাকে এভাবে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারিনি।’ বিষয়টি মৌখিকভাবে আদাবর থানায় জানানোর পর পুলিশ তাকে উদ্ধারে তৎপর হয়। এরপর ফরহাদ মজহারের মোবাইল ফোন থেকে সারা দিনে আরও ৪ বার ফোন কল আসে। এসব ফোনালাপে মজহার জানান, অপহরণকারীরা ৩৫ লাখ টাকা চাচ্ছে। এ টাকা পেলে তারা তাকে ছেড়ে দেবে।

এদিকে উদ্ধারের পর সোমবার রাত ১টা ২০ মিনিটে খুলনার ফুলতলা থানায় সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি দিদার আহমেদ জানিয়েছিলেন, ফরহাদ মজহারের ব্যাগে মোবাইল ফোনের চার্জার, শার্টসহ বেড়াতে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া গেছে। ব্যাগ দেখে বোঝা যায় যে, তিনি স্বেচ্ছায় ভ্রমণে এসেছেন। তিনি সুস্থ আছেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, অপহরণ নাটক সাজানো হয়েছিল বলে মনে হয়।

এদিকে যুগান্তরের খুলনা ব্যুরো জানায়, সোমবার রাতে ফরহাদ মজহারকে যশোরের অভয়নগর থেকে উদ্ধারের পর পরই খুলনার ফুলতলা থানায় সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয়। সোমবার রাত সোয়া ১টায় পুলিশের খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি দিদার আহম্মদ সাংবাদিকদের বলেন, ওইদিন ভোর ৫টা ৮মিনিটে রাজধানীর আদাবর এলাকার নিজ বাসা থেকে সবার অগোচরে ফরহাদ মজহার বেরিয়ে আসেন। গাবতলী থেকে বাসে খুলনায় আসেন। এ ব্যাপারে তার স্ত্রী আদাবর থানায় জিডি এন্ট্রি করেন। উৎকণ্ঠা শুরু হয়ে যায় দেশজুড়ে। মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে বিকালে খুলনার কেডিএ অ্যাপ্রোচ রোড সংলগ্ন ইব্রাহিম মিয়া সড়কের ও নিউমার্কেট এলাকায় তার অবস্থান ধরা পড়ে। সোমবার বিকাল ৪টা থেকে র্যা ব, পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান শুরু হয়। অপরদিকে রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ নিউমার্কেট এলাকার গ্রিল হাউসে খাবার খেয়ে ফরহাদ মজহার রিকশায় হানিফ কাউন্টারে গিয়ে নিজ নামে ঢাকার টিকিট সংগ্রহ করেন বলে তিনি জানান।

এদিকে যশোরের অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সোমবার বিকাল থেকে ঢাকাগামী বিভিন্ন পরিবহন, মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কার তল্লাশি করা হয়। রাত সাড়ে ১১টায় নওয়াপাড়ায় ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনের একটি বাস (ঢাকা-মেট্রো-ব-১৪-৯৮০১) তল্লাশিকালে পেছন দিকের ডান পাশের আই সিরিজের সিট থেকে ফরহাদ মজহারকে উদ্ধার করা হয়। এ সময় র্যা বের টহল দল ৪টি মাইক্রো বাসে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে তাকে গাড়িতে তুলে খুলনার র্যারব ৬ এর সদর দফতরের উদ্দেশে রওনা দেয়। এদিকে রাত ১২টায় খুলনা-যশোর মহাসড়কের ফুলতলা থানা এলাকায় জ্যাম থাকায় র্যালবের গাড়িবহর থানা চত্বরে ঢুকে পড়ে। রাত ১টা ৫ মিনিটে খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি দিদার আহম্মদ, অতিরিক্ত ডিআইজি মো. হাবিবুর রহমান, খুলনার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সজীব খান উপস্থিত হন। ফরহাদ মজহারের সঙ্গে থাকা ব্যাগে ১টি জামা, ১টি গেঞ্জি, মোবাইল ফোনের ১টি চার্জার ও কিছু টাকার কথা উল্লেখ করে ডিআইজি দিদার আহম্মদ বলেন, অপহরণ নয়, বরং স্বেচ্ছায় সংক্ষিপ্ত ভ্রমণের উদ্দেশ্যে তার বের হওয়া। এ সময় র্যা বের একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাস (ঢাকা-মেট্রো-হ-১২-২৩৫২) থেকে ফরহাদ মজহারকে বের করা হয়। তবে তিনি কোনো কথাই বলেননি। এদিকে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার এসি শাহাদাতের নেতৃত্বে একটি টিম আদাবর থানার জিডির পরিপ্রেক্ষিতে ফরহাদ মজহারকে একটি মাইক্রোবাসে (ঢাকা-মেট্রো-চ-১৩-৮৯৩১) তুলে ডিএমপির অপর একটি গাড়ির স্কট দিয়ে রাত ১টা ৩৫ মিনিটে ঢাকার উদ্দেশে ফুলতলা ত্যাগ করে।

এদিকে ফরহাদ মজহার যে বাসে চড়ে ঢাকায় যাচ্ছিলেন, সেই বাসের সুপারভাইজার হাফিজুর রহমান জানান, সোমবার রাত সোয়া ৯টায় তিনি হানিফ পরিবহনের ৫০৫ নম্বর এসি কোচ খুলনা থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়। ফরহাদ মজহার তার বাসের আই-থ্রি সিটের যাত্রী ছিলেন। তিনি খুলনা নগরীর শিববাড়ী কাউন্টার থেকে বাসে ওঠেন। বাসে উঠেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। নওয়াপাড়ার কাছাকাছি স্থান থেকে তিনি ফরহাদ মজহারের টিকিট চেক করেন। তার টিকিটে নাম লেখা ছিল ‘মিস্টার গফুর’। নওয়াপাড়ায় পৌঁছানোর পর পুলিশ তাকে গাড়ি থামাতে নির্দেশ দেয়। অভয়নগর থানা পুলিশ ফরহাদ মজহারকে বাস থেকে নামিয়ে নেয়। এরপর র্যা ব সদস্যরাও ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায়।

হানিফ পরিবহনের খুলনার শিববাড়ী কাউন্টার ইনচার্জ মো. সাদিক জানান, ফরহাদ মজহার নিজেই নিজেকে ‘গফুর’ নাম বলে তার কাছ থেকে টিকিট নেন। এরপর রাত সোয়া ৯টায় বাসটি খুলনা কাউন্টার ত্যাগ করে। এ সময় তার সঙ্গে কেউ ছিলেন না।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/07/05/136824