৫ জুলাই ২০১৭, বুধবার, ১২:৩০

ভুয়া বিল ভাউচারের ছড়াছড়ি দল করলে সব মাফ

অনিয়ম-দুর্নীতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পিছু ছাড়ছে না। বলা হচ্ছে, বরাদ্দ মানেই দুর্নীতি। আর প্রকল্প হলে তো কথাই নেই। যে যার মতো দলবাজির সাইনবোর্ড লাগিয়ে সব অনিয়ম জায়েজ করছেন। প্রশিক্ষণের নামে দেশ-বিদেশে প্রমোদ ভ্রমণ, মিটিংয়ের আড়ালে সম্মানী-ভোজবাজি, যেনতেন কেনাকাটার আড়ালে দেদারসে অর্থ খরচ, কাজ শেষ না হওয়া সত্ত্বেও ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ, ভুয়া ভাউচারে অর্থ লোপাটসহ বিভিন্ন ঘটনা ঘটেই চলেছে। ঠিকাদারি কাজ পেতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ যুবলীগের বাইরে সিডিউল কেনার সাহস কারও নেই। মাঝে মধ্যে ভাগে কম পড়লে নিজেরাই টেন্ডার নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া প্রকল্পের অধীন নির্মাণ কাজ ও কেনাকাটার টেন্ডার দেয়ার ক্ষেত্রেও অনিয়ম আছে বিস্তর। এ নিয়ে সরকারি অডিট দল আপত্তি দিয়ে দিয়ে এখন ক্লান্ত। মনিটরিং নেই। যারা দেখার তাদের অনেকে সুবিধাবাদী তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। অর্থাৎ রক্ষকদের অনেকে ভক্ষকের চরিত্রে। শিক্ষা সেক্টরজুড়ে এসব খবর এখন অনেকটা গা সহা হয়ে গেছে। ওদিকে মন্ত্রীও আছেন বেশ বিপাকে। কারণ বাস্তবিক অর্থে তিনিও নাকি পারছেন না। প্রতিনিয়ত দলীয় কিছু লোকের নানা অন্যায় আবদার তাকে ফেস করতে হয়। তবে ভুক্তভোগীরা এসব অজুহাত মানতে নারাজ। তাদের সাফ কথা- শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে হয়রানি, অনিয়ম দুর্নীতি হবে কেন? তাদের দাবি, প্রতিটি অভিযোগের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হতে হবে। সংশ্লিষ্ট একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে এসব অভিযোগের কথা জানা গেছে।

জানা গেছে, শিক্ষা ভবনে কয়েকজন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ও প্রকৌশলী, এসব কর্মকর্তার আত্মীয়স্বজন এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগের কিছু নেতাকর্মীর সমন্বয়ে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা পরস্পর যোগসাজশে নানা কৌশলে নির্মাণ কাজ ও কেনাকাটার টেন্ডার বাগিয়ে নিচ্ছেন। ব্যাংক গ্যারান্টি ছাড়া বা টেন্ডার শর্তপূরণ না করা সত্ত্বেও তদবিরের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার অভিযোগ আছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. এসএম ওয়াহিদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি বরদাশত করা হয় না। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও অডিট শাখাও আমাদের সঙ্গে কঠোর নজরদারি করছে। এক পয়সা দুর্নীতি বা লোপাটের প্রমাণ পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

গত ৬ জুন এক অনুষ্ঠানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ছয়টি প্রকল্পের ওপর একটি পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়, সঠিক মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না বিভিন্ন প্রকল্পের। অনুষ্ঠানে প্রকল্পের ওপর নানা সমস্যা ও অনিয়ম তুলে ধরা হয়। এ অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বক্তৃতাকালে বলেন, মনিটরিং সেলের মাধ্যমে আমরা প্রকল্পের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সফলতাগুলো দেখতে পাই। সব কাজের জবাবদিহিতা বাড়াতে মনিটরিং ব্যবস্থা বৃদ্ধি করা হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দুর্নীতির সঙ্গে গত কয়েক বছরে অদক্ষ ব্যবস্থাপনাও যুক্ত হয়েছে। যে কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন অগ্রগতি খুবই কম। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রথম দশ মাসে (জুলাই থেকে এপ্রিল) মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ ব্যয় হয়েছে মোট বরাদ্দের মাত্র ৫১ শতাংশ। আবার মার্চ পর্যন্ত এটা ছিল প্রায় ৩৪ শতাংশ। অর্থ্যাৎ এক মাসেই খরচ বৃদ্ধি দেখানো হয় ১৭ শতাংশ। আসলে অর্থবছরের ১০ মাসে তেমন কিছুই হয় না। তড়িঘড়ি কেনাকাটা আর অর্থ ছাড়ের নামে জুন ফাইনালে এসে দুর্নীতির এক ধরনের মহোৎসব চলে। এ প্রসঙ্গে অবশ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটা শুধু শিক্ষা খাত নয়, সরকারি বেশিরভাগ প্রকল্পের ক্ষেত্রেই একই চিত্র। মাউশি মহাপরিচালক প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্পর্কে বলেন, ‘আমাদের ১৪টি প্রকল্প আছে। এর মধ্যে কয়েকটি উপবৃত্তি প্রকল্প। জুন ও ডিসেম্বরে দু’বার উপবৃত্তি দেয়া হয়। ফলে সারা বছর প্রকল্প বাস্তবায়ন হার যা-ই থাকুক জুন-ডিসেম্বরে টাকা খরচ হলে এক লাফে তা অনেক বেড়ে যায়। তাই বাস্তবায়নের সংখ্যা দু’মাসে বেড়ে যাওয়ার হিসাবকে সামনে এনে অনিয়ম-দুর্নীতি চিহ্নিত করা ঠিক হবে না। তারপরও এ ব্যাপারে আমরা সজাগ আছি।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শেষদিকে এভাবে অস্বাভাবিক অর্থ ব্যয় করায় এর স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি এতে ব্যাপক দুর্নীতির আশঙ্কা তো আছেই। বিষয়টি নিয়ে খোদ শিক্ষামন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এ নিয়ে একাধিক বৈঠকে তিনি সতর্কও করেন। গত ৫ এপ্রিল মাসিক পর্যালোচনা সভায় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, সারা বছর কাজ না করে অর্থবছর শেষে এভাবে খরচ দেখানো কোনোভাবে মানা হবে না। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে। যারা এর সঙ্গে জড়িত, প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ধ১সংশ্লিষ্টরা জানান, অর্থবছরের শেষে যাচ্ছেতাইভাবে টাকা খরচের কারণে লুটপাটের দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে ইউএনএফপিএ’র অর্থায়নে বাস্তবায়িত ‘জেনারেশন ব্রেক থ্রু’ পাইলট প্রকল্পটি। ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন এবং কুসংস্কারমুক্ত করতে নেয়া হয় এ প্রকল্প। কিন্তু কর্মপরিকল্পনা, কিছু দিবস পালন ও প্রশিক্ষণেই শেষ হয়ে যায় প্রকল্পের মেয়াদ। এ সুযোগে প্রকল্পের লাখ লাখ টাকা হরিলুট হয়ে গেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগে সরকারি অডিট দল আপত্তি দেয়। অর্ধশতাধিক আপত্তি জানায় টিমটি। এ নিয়ে শোরগোল বাধলে অভিযোগ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ রাখার ব্যাপারে চিঠি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর শুরু হয় আরেক লুটের মচ্ছব। মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তাকে এ প্রকল্প থেকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও বৈঠকে যোগদানের নামে মোটা অঙ্কের টাকা দেয়া হয়। সর্বশেষ গত ৭ জুন বাজেট ও অডিট শাখার ৩ কর্মকর্তাকে চারটি চেকের মাধ্যমে প্রায় ৫৫ হাজার টাকা দেয়া হয়। সূত্র জানায়, প্রশিক্ষণে যোগদানের নামে এই টাকা দেয়া হলেও এর আগে একই কাজের জন্য তাদের ব্যয় বহন করা হয়।

এ প্রকল্পের আওতায় পটুয়াখালী, বরগুনা, বরিশাল ও ঢাকা মহানগরের ২৯০টি হাইস্কুল ও ৬০ মাদ্রাসায় ৪ জন করে মোট ১৪শ’ শিক্ষককে ৫ দিনের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা। কিন্তু বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ না দিয়েই ভুয়া ভাউচারে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আছে। আবার কোথাও নামমাত্র প্রশিক্ষণ হয়। পাশাপাশি অংশগ্রহণকারীদের সম্মানী বাবদ বরাদ্দ অর্থ থেকে কম দেয়ার অভিযোগও আছে। ঢাকা মহানগরে ৬০ স্কুল নিয়ে সেমিনার হওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে লালবাগ এলাকার বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকদের নিয়ে ৬টি প্রশিক্ষণ-সেমিনার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা না করে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের ভুয়া উপস্থিতি তৈরি করে ওইসব সেমিনারের খাবার, ডেকোরেশনসহ অন্যান্য খাতের খরচ ভুয়া ভাউচারে তোলা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। এ অভিযোগ লালবাগ শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই মাউশিতে জানিয়েছেন। পাশাপাশি তারা ভুয়া ভাউচার বিল অভিযোগের সঙ্গে জমা দিয়েছেন। এ বিষয়ে লালবাগ এলাকার একটি সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকও মৌখিকভাবে মাউশির সংশ্লিষ্ট পরিচালকের কাছে আপত্তি জানিয়েছেন। এভাবে অন্যান্য থানা এলাকায়ও কথিত প্রশিক্ষণ হয়েছে বলে দাবি করেন মাউশির কর্মকর্তারা।

এদিকে এ প্রকল্পের বিভিন্ন ভুয়া খরচের চিত্র দেখে সরকারি অডিট দলের কর্মকর্তারা তাজ্জব বনে যান বলে জানা গেছে। তাদের দেয়া অর্ধশতাধিক আপত্তির উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- প্রকল্পের বিভিন্ন খরচের লাখ লাখ টাকা মাউশির পরিকল্পনা শাখার ‘ব’ আদ্যক্ষরের একজন কর্মচারীর ব্যক্তিগত হিসাবের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়। এই কর্মচারীর ইসলামী ব্যাংকের পল্টন ও গোপীবাগ শাখার হিসাবে এসব চেক জমা পড়ে। জানা গেছে, এই কর্মচারী মাউশির একই শাখায় প্রায় ২৭ বছর কর্মরত আছেন। একজন কর্মচারী হওয়া সত্ত্বেও হাতিরঝিলে তিনি জমি কিনে ৬তলা বাড়ি করেছেন বলে জানা গেছে। এই টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

এ প্রকল্পের পরিচালকের (পিডি) দায়িত্ব পালন করছেন মাউশির পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন। ব্যস্ততার কারণে তিনি প্রকল্পে সময় দিতে পারেন না। ফলে সহকারী পরিচালক দিল আফরোজ বিনতে আছির ফোকাল পয়েন্টের দায়িত্ব পালন করেন। তার সঙ্গে মিলে এ শাখার প্রধান সহকারী বদিউজ্জামান প্রকল্পটি চালান বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আবার এই দু’জনসহ মোট ৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রকল্পের কাজ করার নামে মাসে মোট ১২ হাজার টাকা করে নেন। অথচ তারা সরকারি বেতনভুক্ত জনবল। সংশ্লিষ্টরা এই দু’জনের ব্যাংক হিসাব অনুসন্ধানের দাবি জানিয়ে বলেন, এতে কোন প্রকল্প থেকে কত টাকা তারা নিয়েছেন তার হদিস বের করা সম্ভব।

এ প্রসঙ্গে বদিউজ্জামান মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পের বিভিন্ন খরচ নিয়ে যেসব অডিট আপত্তি পড়েছে তা প্রধান অফিসের ব্যাপারে নয়, পটুয়াখালী, ঢাকাসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ও জেলা-উপজেলা অফিসের ব্যাপারে। ওইসব আপত্তি নিয়ে এখনও কাজ চলছে। প্রকল্পের কিছু খরচের চেক আমার নামে ইস্যু হয় সত্যি, কিন্তু তার বিপরীতে উপযুক্ত ব্যয় ভাউচার জমা করা হয়। এসব অভিযোগ তিনি স্বীকার করেন, ‘হাতিরঝিলে তার বাড়ি আছে। তবে আরও তিনজন সেটার মালিক। সহজ শর্তে এক আত্মীয়ের কাছ থেকে জমিটি কেনা হয়। এই চাকরিতে যোগদানের আগে তিনি বিদেশে ছিলেন। সেখানে অর্জিত টাকায় বাড়ি কেনা হয়েছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, ভুয়া ভাউচারে অর্থ লোপাটের অভিযোগ একদম সঠিক নয়।

এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক ড. জাহাঙ্গীর যুগান্তরকে বলেন, ‘বৈঠক আয়োজন, অংশগ্রহণকারীদের সম্মানীসহ টুকটাক খরচের টাকা ক্রসড চেক হিসেবে ইস্যু হয়। যা প্রধান সহকারী বদিউজ্জামানের নামে ইস্যু করা হয়ে থাকতে পারে। এ ছাড়া অন্য কোনো খরচের টাকার চেক ইস্যু হয় কিনা তা আমার জানা নেই। আমি খোঁজ নিয়ে দেখব।’ তিনি বলেন, ‘লালবাগসহ ঢাকার ৬০টি স্কুলে সেমিনার আয়োজনের দায়িত্ব ছিল জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার (ডিইও)। ডিসেম্বরের মধ্যে এসব কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলেও খরচের টাকার চেক জানুয়ারিতে ইস্যু করা হয়। এতে অডিট দল আপত্তি দিয়েছিল। এর জবাবে ডিইও আমাকে জানিয়েছেন, ডিসেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষার ব্যস্ততার কারণে টাকা জানুয়ারিতে দেয়া হয়। অন্য খাত থেকে টাকা সংস্থান করে কর্মসূচি চালিয়ে নেয়ার কথা ঢাকার সব শিক্ষা কর্মকর্তাই জানিয়েছেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি যেহেতু কোনো সেমিনারে যাইনি, তাই এর সত্যাসত্য বলতে পারব না।’

http://www.jugantor.com/first-page/2017/07/05/136825