৫ জুলাই ২০১৭, বুধবার, ১২:২৩

ভারত থেকে ফেনসিডিল ঢুকছেই

অস্ত্র চোরাচালান সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের সীমান্ত পারাপারের সুযোগ করে দিচ্ছে সংঘবদ্ধ চক্র

জীবনবিনাশী ফেনসিডিলের ভয়াল থাবা কোনভাবেই রুখে দেয়া যাচ্ছে না। সুন্দরবনের কৈখালী থেকে কুষ্টিয়ার চিলমারীর পদ্মাপাড় পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তের অন্তত অর্ধ শতাধিক পয়েন্ট দিয়ে ভারত থেকে সর্বনাশা ফেনসিডিল ঢুকছে। খুব কম দিনই আছে, যেদিন ভারত থেকে সীমান্তপথে ফেনসিডিল ঢোকে না। ফেনসিডিল, ইয়াবাসহ মাদক অপরাধ প্রবনতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, উৎস বন্ধ না করে যতরকম ব্যবস্থাই নেওয়া হোক শূন্যেকৌঠায় আসবে না। মাদকদ্রব্যের পাশাপাশি অস্ত্র চোরাচালান সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের সীমান্ত পারাপারের সুযোগ করে দিচ্ছে সংঘবদ্ধ চক্র। সীমান্ত সুত্র জানায়, দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তের ওপারে বনগাঁ, রানাঘাট, কৃঞ্চনগর, পেট্রাপোল, হরিদাসপুর, বারাসাত, বানপুর ও বহরমপুরসহ বিভিন্নস্থানে ফেনসিডিলের আড়ত রয়েছে বাংলাদেশে পাচারের জন্য। এ অঞ্চলে ৩০টি সিন্ডিকেট জড়িত নেটওয়ার্কের সাথে। যাদের অধিকাংশের আবার ঢাকার ৫টি স্পটের সিন্ডিকেটের সাথে যোগাযোগ আছে। বেনাপোল, যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা ও ঢাকার অন্তত ১০ জন গডফাদার কোটি কোটি টাকা লগ্নি করে ‘সর্বনাশা ব্যবসা’ পরিচালনা করছে।

বিজিবি, র্যা ব ও পুলিশসহ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার একাধিক সুত্র জানায়, শত চেষ্টা চলছে, তবুও ভারতীয় ফেনসিডিলসহ মাদক বাংলাদেশে ঢুকছেই সীমান্তের ফাঁকফোকর দিয়ে। ছোট বড় চালান আটকের ঘটনা ঘটছে অহরহ। মাসে কিংবা বছরে কি পরিমাণ মাদক ঢোকে এ প্রশ্নের জবাবে সুত্রগুলো জানায়, বিভিন্ন সংস্থা আটক করে। এর হিসাব দেওয়া কঠিন। এমন কোনদিন নেই যেখানে গোটা অঞ্চলের কোন না কোন স্থান থেকে মাদক আটক হয় না। সীমান্ত জেলা যশোর ছিল মাদক চোরাচালানের ট্রানজিট পয়েন্ট। জেলাজুড়ে লাগাতার মাদকবিরোধী জোরদার অভিযান, সচেতনতা সৃষ্টি ও বেশ কয়েকটি মাদক সম্রাটের আস্তানা পুলিশ সুপার মোঃ আনিসুর রহমান গুড়িয়ে দেওয়ায় এবং তালেব ও একছেরসহ কয়েকজন মাদকসম্রাট ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ায় ফেনসিডিল বিকিকিনি এখন অনেকটাই কম। কিন্তু গোটা অঞ্চলের সব জেলায় একযোগে অভিযানের অভাবে এবং সীমান্ত ওপারের উৎস বন্ধ না হওয়ায় মাদক নির্মূলের সম্ভাবনা ক্ষীণ।

সীমান্ত সুত্র জানায়, বেনাপোলের ওপারের কৃঞ্চপদ, গোপাল ও শশিধর এবং এপারের বিপুল, জাকির ও আলমগীরসহ সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী একটি চক্র আছে, যাদের নেটওয়ার্ক ঢাকা ও কলিকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত। তাদের রয়েছে অসংখ্য সদস্য। এর বাইরেও গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দর্শনা, চৌগাছা, মহেশপুর, শার্শা, গাংনী, কলারোয়া, ভোমরা, বাগআঁচড়া, দৌলতপুর, ভেড়ামারা ও প্রাগপুরসহ বিভিন্ন পয়েন্টে রয়েছে শত শত চোরাচালানী। মুষ্টিমেয় কিছু গডফাদার তাদের পুষ্টপোষকতা ও অর্থ লগ্নি করে। তারা সবসময় থাকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অভিযোগ, মাদক চোরাচালান গ্রæপগুলোর নেপথ্যে শক্তি যুগিয়ে থাকেন একশ্রেণীর জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী ব্যক্তি।

সীমান্ত সুত্র জানায়, সীমান্তে ও তার আশেপাশে এমনকি পথে পথে অভিযান চলে, ফেনসিডিল আটক হয় বিপুল পরিমাণ, তাতেও মাদক চোরাচালানীদের গতি থামে না। বরং অপ্রতিরোধ্য গতিতে বেড়েই চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে যশোর ও খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমের বিভিন্নস্থানে ফেনসিডিল ও ইয়াবা উদ্ধার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেছেন, মাদক ব্যবসায়ীরা নেটওয়ার্ক এমনভাবে বিস্তৃত যে কোনভাবেই প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। খুলনার একজন সামাজিক নেতা বললেন, মাদক সন্ত্রাসে আমাদের যুব সমাজকে ধ্বংস হচ্ছে। সাতক্ষীরার কলারোয়ার ভাদিয়ালী সীমান্তের একজন সীমান্তবাসী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে বললেন, মাদক চোরাচালানীরা আটক হয়, দুর্বল চার্জশীট ও স্বাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে বের হয়ে আসে। যারা যুব সমাজকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে জোরদার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সীমান্তের এপার ও ওপারে বিশাল শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে সংঘবদ্ধ চোরাচালানীরা প্রতিনিয়ত ভারত থেকে ফেনসিডিলের চালান ঢোকাচ্ছে। নিয়মিত এক মাদকসেবীর বক্তব্য ‘অন্ধকার নেমে এলেই সারা শরীরের মধ্যে একটা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। থর থর করে কাঁপতে থাকে শরীর। মাদকসেবনের পরই অস্থিরতা কেটে যায়। তাই মাদকসেবন করি’। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অতিরিক্ত এ্যালকোহাল মিশ্রিত, নকল, ভেজাল, মেয়াদউত্তীর্ণ ও বিষাক্ত ফেনসিডিল সেবনে মাদকসেবীরা কর্মশক্তি হারিয়ে শারিরীক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সীমান্তপথে সবচেয়ে বেশী ফেনসিডিল ঢুকছে ভারতের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে। ফেনসিডিল আটকের সংখ্যাও বেশী এই সীমান্তে। সীমান্তের চোরা পয়েন্টগুলোর মধ্যে উল্লে¬খযোগ্য হচ্ছে সাতক্ষীরার কলারোয়ার ভাদিয়ালি, বড়ালি যশোরের মাসিলা, বেনাপোল, বড় আঁচড়া, ঝিনাইদহের মহেশপুরের যাদবপুর, সামান্তা, চুয়াডাঙ্গার জীবননগর, দর্শনা, মেহেরপুরের মুজিবনগর, গাংনী ও কুষ্টিয়ার দৌলতপুর। সংশ্লি¬ষ্ট সুত্র জানায়, এ অঞ্চলে বেশ কয়েকজন মাদক সম্রাটসহ শতাধিক ব্যক্তি মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। এছাড়া ফেনসিডিল ফেরি করে বিক্রি ও একস্থান থেকে আরেকস্থানে চালানের সাথে জড়িত রয়েছে সহস্রাধিক অভাবী নারী, পুরুষ ও কিশোর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ওয়ার্ল্ড ড্রাগ রিপোর্ট, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে দেশে কাজ করা বিভিন্ন এনজিও সুত্রে জানা যায়, দেশে কয়েক লাখ লোক মাদকাসক্ত। সুত্রমতে, দেশে সরকারীভাবে মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা না হলে নিকট ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে বলে অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষক মহল থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/86165