৫ জুলাই ২০১৭, বুধবার, ১২:১৩

ষোড়শ সংশোধনী সংবিধানের মূল কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক

উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদে ন্যস্ত করার সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে সরকারের আপিল খারিজ হয়েছে। এই আপিলের শুনানিতে সর্বোচ্চ আদালত দেশের ১২ জন বিশিষ্ট আইনজীবীকে এমিকাস কিউরি (আদালতকে আইনগত ব্যাখ্যা দিয়ে সহায়তাকারী) নিযুক্ত করেন। এই ১২ জনের মধ্যে ১০ জন আদালতে মতামত তুলে ধরেন। তাদের মধ্যে নয়জনই ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে পক্ষে মত দেন। তাদের মতামতে ঘুরে ফিরে একটি মত আসে সেটা হলো ষোড়শ সংশোধনী সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘষিক। এটা সংবিধানের মূল কাঠামোর পরিপন্থী। আর একজন মাত্র পক্ষে মত দিয়েছিলেন।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি আদালত ১২ জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে এমিকাস কিউরি নিয়োগ দিয়েছিলেন। এমিকাস কিউরি নিযুক্ত হলেও প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ মতামত দেননি। শুধু মাত্র জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে বৈধ বলে মত দিয়েছিলেন। অপর ৯ এমিকাস কিউরি বিচারপতি টিএইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমির উল ইসলাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক আইন উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, এটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী ও ফিদা এম কামাল, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, এম আই ফারুকী ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে তাদের মতামত তুলে ধরেন।
দেশের সবচেয়ে প্রবীণ আইনজীবী সাবেক বিচারপতি টি এইচ খানের লিখিত মত তুলে ধরেন তার ছেলে আইনজীবী আফজাল এইচ খান। লিখিত বক্তব্যে টি এইচ খান বলেন, হাইকোর্ট ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে যে রায় দিয়েছেন, সেটি বহাল রাখাই শ্রেয়। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চাইলে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে আরও শক্তিশালী করা এবং তাদের ক্ষমতা আরও বাড়ানো উচিত।
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন ষোড়শ সংশোধনীকে সংবিধানের সঙ্গে সাঙ্গর্ষিক বলে শুনানিতে মত দেন। হাইকোর্টের দেয়া রায় পুরোপুরি সমর্থন করে জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী বলেন, অষ্টম সংশোধনী মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হচ্ছে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। আরও কয়েকটি রায়ে বলা হয়েছে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ। ষোড়শ সংশোধনী বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খাটো করেছে। ষোড়শ সংশোধনী সংবিধানের মূল কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

এম আমীর-উল ইসলাম তার লিখিত বক্তব্যে মত দেন, দুনিয়াজুড়ে যে অবস্থা দেখছেন, তাতে বিচারকদের অসদাচরণের কোনো ঘটনা ঘটলে সেটা আদালতই ঠিক করবে। উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের জন্য একটি জুডিশিয়াল কাঠামো থাকতে হবে। এ জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি।
এ এফ হাসান আরিফ তার মত দিয়ে বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিচারকদের নিজস্ব প্রয়োজনে নয়, বরং জনগণের অধিকার রক্ষার জন্য দরকারি। এর আগে সুপ্রিম কোর্ট বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের একটি অপরিহার্য অংশ বলে রায় দিয়েছেন। ভারতসহ প্রতিবেশী বেশ কয়েকটি দেশে অনেক রায় হয়েছে, যেখানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বলা হয়েছে। জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষায় বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকবে।
রোকনউদ্দিন মাহমুদ বলেন, সিভিল সার্ভিসের সদস্যদের কারা অপসারণ করে? পুলিশকে কারা করে? সচিবদের কারা করে? আপনি? সংসদ? কেউ না। তাঁদের অপসারণ করেন তাঁদের ঊর্ধ্বতনেরা। সামরিক বাহিনীর সদস্যদেরটা তাদের ডিসিপ্লিনারিতে আছে। তাহলে আপনাদেরটা (বিচারক) কেন সংসদে যাবে? সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল না থাকলে এখানে (সুপ্রিম কোর্ট) অরাজকতা হবে।

এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ রয়েছে। এর কারণে নিজ দলের বিপক্ষে কেউ ভোট দিলে সংসদ সদস্যপদ চলে যায়। এটা থাকার কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে নিজ দলের বিরুদ্ধে মতামত দিতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে কি জনগণের মতামত প্রতিফলিত হবে? হবে না। বিচারক অপসারণের বিষয়েও সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে মতামত দিতে পারবেন না। ফলে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটবে না।
ফিদা এম কামাল বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ। সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায়ে এটা এসেছে। সুপ্রিম কোর্টই রায় দিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল রেখে দিয়েছেন। এ ব্যবস্থাকে আদালত স্বচ্ছ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার রক্ষাকবচ বলে উল্লেখ করেছেন।
আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া বলেন, ষোড়শ সংশোধনী সংবিধানের মূল কাঠামোর পরিপন্থী। এতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণœœ হয়েছে। অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে থাকলে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো নষ্ট এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণœ হবে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের ক্ষমতা প্রধান বিচারপতির হাতে থাকতে হবে। যদি এটা সংসদের হাতে দিয়ে দেয়া হয়, তাহলে ভারসাম্য নষ্ট হবে।

এম আই ফারুকী লিখিত বক্তব্যে বলেন, পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ে সুপ্রিম কোর্ট সামরিক শাসনামলে জারি করা সব ফরমান বাতিল করলেও সুপ্রিম জুডিশিয়াল ব্যবস্থা রেখে দিয়েছেন। সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীতেও এ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ অবস্থায় বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দিয়ে সরকার সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী করেছে। ষোড়শ সংশোধনী স্বাধীন বিচার বিভাগ ও গণতন্ত্রের মৌলিক কাঠামোর লঙ্ঘন। বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তা তদন্ত হতে হবে বিচারকদের দিয়ে, রাজনীতিবিদদের দিয়ে নয়।

অপরদিকে ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে যুক্তি দিয়ে আজমালুল হোসেন কিউসি বলেন, বিচারকেরা জনগণের হয়ে বিচার করছেন। তাদেরও জবাবদিহির প্রয়োজন আছে। সংবিধান অনুযায়ী সব ক্ষমতার মালিক জনগণ। জবাবদিহির জন্য সংসদে যারা নির্বাচিত সংসদ সদস্য, জনগণের যারা প্রতিনিধিত্ব করছেন, তাদের কাছে জবাবদিহি থাকার প্রয়োজন আছে। সংসদের হাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা দিয়ে যে সংশোধনী আনা হয়েছে, সেটি কার্যকর সংশোধনী। এ সংশোধনীর মাধ্যমে আদি সংবিধানে ফিরে যাওয়া হয়েছে। এই সংশোধনী অবশ্যই আইনত বৈধ।

প্রসঙ্গত গত সোমবার উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদে ন্যস্ত করার সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। সরকারের করা আপিল সর্বসম্মতভাবে খারিজ করে দেন সর্বোচ্চ আদালত। ফলে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে ফেরতের পথ সুগম হয়। সংসদের হাতে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা বাতিল হয়ে যায়।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এই রায় দেন। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন-বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।

http://www.dailysangram.com/post/290338