৫ জুলাই ২০১৭, বুধবার, ১২:০৭

বাজেট বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মুখে

নতুন ভ্যাট আইন স্থগিত করলেও বাজেটে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়নি। আর এ কারণেই রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। পুরনো আইনে টার্গেট বাস্তবায়নে এনবিআর কাজ করলেও কোন দিক নির্দেশনা দেয়া হয়নি। লক্ষ্য অর্জনে রূপরেখার কাজ চলছে। অর্থ বিল বাদ দিয়ে বাজেট বিল পাস হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। এতে করে ঝুঁকিতে পড়তে পারে দেশের অর্থনীতি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন মধ্য মেয়াদে এই বাজেটে বড় ধরনের কাটছাট করতে হবে। তা না হলে উন্নয়ন বাজেট বাধাগ্রস্ত হবে।

তবে, প্রশাসনিক কাঠামোর সংস্কার ও পুরনো ভ্যাট আইনের আধুনিকীকরণের মাধ্যমে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। এমন মত অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুরের। অন্যদিকে এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তা মনে করেন নতুন আইন বাস্তবায়ন না হওয়ায় খুব একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না রাজস্ব আহরণে।
বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থের সিংহভাগই আসে রাজস্ব আহরণের মাধ্যমে। আর প্রতিবছরই নির্ধারণ করা হয় সেই লক্ষ্যমাত্রা। স্বাধীনতার পর সর্বপ্রথম ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হলেও এখন তা ছাড়িয়ে গেছে ৪ লাখ ২শ কোটি টাকা। এতে বেড়েছে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রাও। গেল অর্থবছরে সংশোধীত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা।
বড় অঙ্কের এই রাজস্ব আহরণের অন্যতম একটি ক্ষেত্র হওয়ার কথা ছিল ২০১২ সালের ভ্যাট আইন। নানা সমালোচনার মুখে যেটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না এ অর্থবছরেও। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন এর ফলে রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে, এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তা মনে করেন অডিট কার্যক্রম বাড়ানোর মাধ্যমে ভ্যাটের পরিসর বাড়ালে খুব একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।

এদিকে গেল অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে এনবিআর। সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে বকেয়া আদায় বাড়ানো গেলে আরো বাড়বে রাজস্ব আহরণ।
নতুন ভ্যাট আইনকে দুই বছরের জন্য স্থগিত করার সিদ্ধান্তকে ব্যবসায়ীরা সাধুবাদ জানালেও উদ্বেগের কথা বলছেন অর্থনীতিবিদরা। এ সিদ্ধান্ত রাজস্ব আদায়ে দেখা দিবে বড় ঘাটতি। যা বিরুপ প্রভাব ফেলতে পারে সার্বিক অর্থনীতিতে। এ জন্য অর্থনীতিবিদের পরামর্শ ঘাটতি পূরণে আয়করসহ রাজস্বের অন্যখাত থেকে বাড়তি আয়ের।
ব্যবসায়ী মহল বলছে প্রস্তাবিত ১৫ শতাংশ ভ্যাটের পরিবর্তে অর্থ বিলের আগের ভ্যাট আইন বহাল রাখায় দেশের ব্যবসা বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে।
এফবিসিসিআই পরিচালক আবু মোতালেব বলেন, নতুন পরিবর্তনের কিছু পরিবর্ধন প্রয়োজন ছিলো। তিনি বলেন ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পের জন্য ১৫ শতাংশ ভ্যাট আইন প্রত্যাহার করে তাদেরকে সব ধরনের সুবিধা দেয়ায় একটা সামঞ্জস্য পেয়েছে।
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন ব্যবসায়ীরা লাভবান হলেও সার্বিক ভাবে ক্ষতি হয়েছে নতুন বাজেট এ অবস্থা কাটাতে নতুন বাজেট রাজস্ব ঘাটতি কমানোর পরামর্শ অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমানের। নতুন ভ্যাট আইন স্থগিত না করে সবার জন্য সহনীয় হয় এমন হারও বলবত করা যেতে পারে বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গর্বনর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বাজেট বাস্তবায়ন হবে বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থ বিল বাদ নিয়ে বাজেট বিল পাশ এটাই প্রথম। এতে করে ঝুঁকিতে পড়তে পারে দেশের অর্থনীতি। এর আগে বাজেট নিয়ে সরকারি দলের এমপিরা এত বির্তক করেননি। ভ্যাট এবং আবগারি শুল্কের মত বিতর্কিত দুটি বিষয় বাদ দেয়ায় বাজেট বাস্তবায়ন লক্ষ্যচ্যুত হতে যাচ্ছে।

নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নকে সামনে রেখে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট খাতে সর্বোচ্চ ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার। কিন্তু ‘মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ দুই বছরের জন্য স্থগিত হওয়ায় ভ্যাটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে,ভ্যাট থেকে এনবিআরের আয় হয় ৬৪ হাজার কোটি টাকা। ভ্যাট আইন পরিবর্তন করে লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৯১ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু নতুন ভ্যাট আইন স্থগিত করলেও লক্ষ্যমাত্রা ঠিক রাখা হয়েছে। এতে করে বাস্তবায়ন নিয়ে আরও জটিলতা বেড়েছে। অর্থাৎ শুধু নতুন ভ্যাট আইন স্থগিত করার কারণেই এনবিআরের আয় কমবে ২৭ হাজার কোটি টাকা। বর্ধিত আবগারি শুল্ক থেকে আয় হওয়ার কথা ছিল হাজার কোটি টাকা।
সদ্য পাস হওয়া বাজেটে ভ্যাট আইন স্থগিত করলেও ভ্যাটের লক্ষ্যমাত্রায় কোনো ধরনের কাটছাট করা হয়নি। তার ওপর নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসহ বেশিরভাগ পণ্যে ভ্যাট অব্যহতি দেওয়া হয়েছে।
ভ্যাট খাতের বিশাল আকৃতির এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) কোনো দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়নি। তবে নতুন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কাজ শুরু করেছে এনবিআর। ভ্যাটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নতুন উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সংস্থাটি।
রাজধানী থেকে গ্রাম পর্যন্ত দেশের প্রতিটি প্রান্তে ভ্যাট অভিযান চালানোর কথা জানিয়েছেন এনবিআর কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, ভ্যাটের বিশাল এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এবার ভ্যাট আওতার বাইরে থাকা নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে নজর দেয়া হবে। ভ্যাট সংগ্রহে দেশের প্রতিটি প্রান্তে চিরুনি অভিযান চালানো হবে।
এনবিআরের হিসেবে, দেশে ৫০ লাখের বেশি ভ্যাট যোগ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৮ লাখ ৮৪ হাজার প্রতিষ্ঠান ভ্যাট নিবন্ধন নিয়েছে। মাত্র ৩৪ হাজার প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ভ্যাট রিটার্ন জমা দিচ্ছে।
গত ২৩ মার্চ থেকে অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন শুরু হয়। ২২ জুন পর্যন্ত ৫০ হাজার ১৭১ নিবন্ধন হয়েছে। এর মধ্যে টার্নওভার প্রতিষ্ঠান ১ হাজার ২৭৯ ও ৪৮ হাজার ৮৯২ ভ্যাট নিবন্ধন। নতুন ভ্যাট নিবন্ধন নিয়েছে ১৯ হাজার ৬৯৪টি ও পুনঃনিবন্ধন করেছে ৩০ হাজার ৪৭৭ প্রতিষ্ঠান।

এনবিআর সূত্র জানায়, দিক-নির্দেশনা না থাকলেও ভ্যাট লক্ষ্যমাত্রা পূরণে রূপরেখা তৈরি করছে এনবিআর, জরিপ কার্যক্রম জোরদার হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ভ্যাট যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে খুঁজে বের করে নিবন্ধনের আওতায় আনা। বার্ষিক বিক্রয়ের পরিমাণ (টার্নওভার) নির্ধারণ এবং প্যাকেজ ভ্যাটের আওতাভুক্ত কি না- তা যাচাই করা হবে। রাজধানী থেকে গ্রাম পর্যন্ত সব মার্কেট ও শপিং মলে অভিযান চালাবে ভ্যাট কর্মকর্তারা।

সূত্র আরও জানায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে দুই লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকার রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ভ্যাট খাতের ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। যেখানে ২০১৬-১৭ অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭২ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। পরে সংশোধন করে ৬৮ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা করা হয়। গত অর্থবছর ভ্যাট খাতে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার সাথে ৩৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে অর্থাৎ অতিরিক্ত ২২ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা ধরা হয়।
বর্তমানে ২০টি সেবা খাতে সংকুচিত হারে ভ্যাট আদায় করা হয়। এর মধ্যে আবাসন খাতে দেড় থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ, নির্মাণ সংস্থা ৬ শতাংশ, আসবাবপত্র ৬ ও ৪ শতাংশ, জুয়েলারি ৫ শতাংশ, পরিবহন ঠিকাদার সাড়ে ৪ ও ১০ শতাংশ, বিদ্যুৎ ৫ শতাংশ, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল সাড়ে ৭ শতাংশ হিসাবে ভ্যাট আদায় হয়। অন্যদিকে গুঁড়ো দুধ, বিস্কুট, কেক, চাটনি, জুস, নিউজপেপার, ইট, জেনারেটর, সয়াবিন তেলসহ ১৭৯টি পণ্যে ট্যারিফ ভ্যালুর আওতায় ভ্যাট আদায় করা হতো।
এনবিআরের একজন সদস্য বলেন, নতুন আইন বাস্তবায়নকে টার্গেট করে ভ্যাটের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই টার্গেট পূরণে একটি গাইডলাইন ছিল। আইন তো বাস্তবায়ন হয়নি। আমাদেরকে কোনো দিক-নির্দেশনাও দেয়া হয়নি। বিশাল এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ চ্যালেঞ্জ হবে। তবে আমরা রূপরেখা তৈরি করছি।

তিনি বলেন, ভ্যাট যোগ্য নতুন প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করা ভ্যাট বিভাগের রুটিন ওয়ার্ক। এবার রুটিন ওয়ার্ককে স্থায়ী করে দেয়া হচ্ছে। শুধু শহর নয়, গ্রামে পর্যায় পর্যন্ত ভ্যাট কর্মকর্তারা ভ্যাট যোগ্য প্রতিষ্ঠানে হানা দেবে।
পিআরআই’র নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, নতুন ভ্যাট আইন বাতিল হওয়াতে বাজেট বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। যারা বেশি গলাবাজি করে তাদেরও ভ্যাটে আওতায় আনতে হবে। মূলত একটি শ্রেণী ভ্যাট না দেয়ার জন্যই এই গলাবাজি করে। তিনি বলেন, এনবিআরের যে লোকবল আছে, তাতে বাজেটের ২০/২৫ শতাংশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব। গত পাঁচ বছরে তারা প্রকৃত টার্গেট অর্জন করতে পারেনি।

http://www.dailysangram.com/post/290324