উদ্ধারের পর মেয়েকে কাছে পেয়ে আবেগ আপ্লুত ফরহাদ মজহার
৫ জুলাই ২০১৭, বুধবার, ১২:০২

অপহরণ ঘটনা নিয়ে নানা প্রশ্ন নানা কথা

সোমবার দিনের আলো ফোটার পর থেকে যে সব প্রশ্ন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছিল, তার কোনটারই সঠিক উত্তর মেলেনি। ঘটেনি নানা জল্পনা কল্পনার অবসানও। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকার সিএমএম আদালত থেকে বাসায় ফেরার সময় মুক্ত ফরহাদ মজহারের সহধর্মীনি ফরিদা আক্তারের কাছে উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের যে প্রশ্ন ছিল তার উত্তরে তিনি জানান, ‘আমরা এখন শ্যামলীর বাসায় যাচ্ছি’। এর আগে জন্ম নেয়া মেলা প্রশ্নেরই জবাব ভিন্ন ভিন্নভাবে ভাবা হলেও কোন সদুত্তর ছাড়াই কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহারকে তাঁর নিজ জিম্মায় বাসায় ফেরার অনুমতি দিয়েছেন আদালত। এর আগে বেলা ৩টা থেকে বিকেল ৫টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত তিনি জবানবন্দী দেন। ঢাকার মহানগর হাকিম আহসান হাবীব তাঁর জবানবন্দী রেকর্ড করে ১০ হাজার টাকা মুচলেকায় তাঁকে নিজ জিম্মায় বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দেন।

আদালত ফরহাদ মজহারের কাছে জানতে চান, তিনি নিজ জিম্মায় যেতে যান কিনা? জবাবে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই যেতে চাই।’ আদালতে তাঁকে বিমর্ষ দেখা গেছে। বিকেল ৫টা ৫২ মিনিটে একটি মাইক্রোবাসে করে আদালত প্রাঙ্গণ ত্যাগ করেন ফরহাদ মজহার। এ সময় সাংবাদিকরা তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চান। তবে তিনি কথা বলতে চাননি। জানতে চাইলে ফরিদা আখতার বলেন, ‘স্বামীকে ফিরে পেয়েছি। এতেই খুশি।’

এদিকে ফরহাদ মজহার ঢাকার আদালতে জবানবন্দী দেয়ার পর একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ফরহাদ মজহার অন্তর্ধানের তদন্তে যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা, ডিএমপির উপ-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার সন্ধ্যায় বলেন, তাকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে তিনি জেনেছেন। রাতে ফরহাদ মজহারের পরিবারের পক্ষ থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে তাকে হাসপাতালে ভর্তির কথা জানানো হয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, “আদালত থেকে ফরহাদ মজহারকে সরাসরি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি আগে থেকেই উচ্চ রক্তচাপ, ডায়বেটিস ও হৃদরোগে ভুগছিলেন। চোখ বাঁধা অবস্থায় গত দুই দিনের বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মানসিকভাবেও তিনি ভীষণ বিপর্যস্ত।”

সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত চিকিৎসকরা তাকে কথা বলতে নিষেধ করেছেন বলেও ফরিদা আখতার ও তার মেয়ে সমতলী হকের পক্ষে পাঠানো ওই বিবৃতিতে বলা হয়। রাত ৮টায় যোগাযোগ করা হলে বারডেম হাসপাতালে কর্তব্যরত এক চিকিৎসা কর্মকর্তা বলেন, “ডায়েবেটিসসহ মাল্টিপল সমস্যা নিয়ে তিনি ভর্তি হয়েছেন। তিনি কেবিনে আছেন।”

এর আগে গতকাল বেলা সোয়া একটার দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে অনুষ্ঠিত ব্রিফিংয়ে যুগ্ম-কমিশনার আবদুল বাতেন বলেন, ফরহাদ মজহারকে কয়েকজন চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। সোমবার ভোরে তিনি নিজের বাড়ি থেকে ওষুধ কিনতে বের হয়েছিলেন। পথে এ ঘটনা ঘটে। সোমবার রাতে উদ্ধারের পর গতকাল সকাল নয়টার কিছু আগে ফরহাদ মজহারকে প্রথমে রাজধানীর আদাবর থানায় নেওয়া হয়। সেখান থেকে বেলা ১১টার কিছু আগে মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। দুই ঘণ্টার বেশি সময় সেখানে জিজ্ঞাসাবাদ চলে। এরপর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী রেকর্ডের জন্য নিম্ন আদালতে পাঠানো হয় তাঁকে।

ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদে ফরহাদ মজহারকে চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে নিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন বলে জানান আবদুল বাতেন। তিনি বলেন, ফরহাদ মজহার তাঁদের বলেছেন, মাইক্রোবাসে তোলার পর তিনি আর কিছু জানেন না। এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, তুলে নেয়ার পর ফরহাদ মজহারের ব্যবহৃত নম্বর থেকেই তাঁর স্ত্রীকে ফোন করা হয়। ফোনে তিনি জানান, যারা তাঁকে নিয়ে গেছে তারা ৩৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়েছে।
সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে যশোরের অভয়নগরে খুলনা থেকে ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনের একটি বাস থেকে উদ্ধার করা হয় ফরহাদ মজহারকে। স্বজনেরা অভিযোগ করেন, ওই দিন ভোরে কে বা কারা ফরহাদ মজহারকে রাজধানীর শ্যামলীর হক গার্ডেনের বাসার সামনে থেকে তুলে নিয়ে গেছে।

পুলিশ আরও জানায়, আদাবর থানায় ফরহাদ মজহারের পরিবারের করা অপহরণের অভিযোগটি মামলা হিসেবে নেয়া হয়েছে। আদালতে জবানবন্দী রেকর্ডের পর তার ভিত্তিতেই তদন্ত চলবে বলে ব্রিফিংয়ে জানানো হয়। ব্রিফিংয়ে তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার উপস্থিত ছিলেন।
উদ্ধার করার পর সোমবার দিবাগত রাত ১টা ২০ মিনিটে খুলনার ফুলতলা থানায় সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি দিদার আহমেদ জানিয়েছিলেন, ফরহাদ মজহারের ব্যাগে মোবাইল ফোনের চার্জার, শার্টসহ বেড়াতে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া গেছে। ব্যাগ দেখে বোঝা যায় যে তিনি স্বেচ্ছায় ভ্রমণে এসেছেন। তিনি সুস্থ আছেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, অপহরণ নাটক সাজানো হয়েছিল বলে মনে হয়।
বাসায় ফেরার অনুমতি
নাটকীয়ভাবে যশোরে ‘উদ্ধার’ ফরহাদ মজহার ঢাকার আদালতে জবানবন্দী দেওয়ার পর বাসায় ফেরার অনুমতি পেয়েছেন। ঢাকার মহানগর হাকিম আহসান হাবীব গতকাল মঙ্গলবার বিকালে তার খাস কামরায় ১৬৪ ধারায় ফরহাদ মজহারের বিচারিক জবানবন্দী রেকর্ড করেন। পরে ১০ হাজার টাকার মুচলেকায় স্বাক্ষর নিয়ে তাকে নিজের জিম্মায় বাড়ি ফেরার অনুমতি দেন বিচারক।

পুলিশ দুপুরে ফরহাদ মজহারকে আদালতে হাজির করার পর তাকে নিজের জিম্মায় যাওয়ার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া, যিনি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পক্ষেও মামলা লড়েন। ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আখতার, মেয়ে সমতলী হক, ভাগ্নে মেজর ফেরদৌসসহ কয়েকজন পারিবারিক বন্ধু এ সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
শুনানিতে সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, “ফরহাদ মজহারের মামলার বিষয় আমরা কিছুই জানি না। জবানবন্দীতে কী বলেছেন তাও জানি না। আপনি কি দয়া করে আমাদের জানাবেন?”

উত্তরে বিচারক বলেন, “এটা ৩৮৫ এবং ৩৬৫ ধারার মামলা; অর্থাৎ অপহরণ ও চাঁদাবাজি সংক্রান্ত অপরাধ। ফরহাদ মজহার জবানবন্দীতে আমার কাছে কী বলেছেন তা আপনাকে আমি বলতে পারি না। সে বিষয়ে পুলিশ ব্রিফ করবে।”
এরপর বিচারক আদালতে উপস্থিত ফরহাদ মজহারকে প্রশ্ন করেন, “আপনি কি নিজের জিম্মায় যেতে ইচ্ছুক?”
উত্তরে ফরহাদ মজহার বলেন, “জি, আমি ইচ্ছুক।”
পাঁচ মিনিটের শুনানি শেষে মুচলেকায় সই করে পরিবারের সঙ্গে মিলিত হন ডানপন্থি অধিকার কর্মী হিসেবে পরিচিত এই কবি, প্রাবন্ধিক, যিনি সোমবার ভোরে অপহৃত হন বলে এ মামলার অভিযোগ।
আদালতের আদেশের পর ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আক্তার বলেন, “এখন তাকে আমাদের আইনজীবী জিম্মায় পেয়েছি। আমরা এখন বাসায় যাচ্ছি।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “উনার শরীর সাংঘাতিক খারাপ। উনাকে আজকে ফুল রেস্ট দিতে হবে। আমরা নিজেরাও ভীষণ ক্লান্ত। সারাদিন কেউ খাওয়া দাওয়া করিনি। আজ উনার বিশ্রাম দরকার। আজকে কোনো কথা বলতে পারব না।”
মামলা
গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আখতারের অভিযোগের ভিত্তিতে সোমবার রাতে আদাবর থানা পুলিশ ওই মামলা নথিভুক্ত করে।
মামলায় বলা হয়, “আমার স্বামী সাধারণত খুব ভোরে ঘুম থেকে জাগেন এবং লেখালেখি করেন। সকাল ৫টার দিকে আমার ঘুম ভাঙার পর আমি উনাকে লেখার টেবিলে না দেখতে পেয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি এবং সারা ঘরে খুঁজতে থাকি। ইতোমধ্যে সকাল ৫টা ২৯ মিনিটে আমার স্বামী তার ফোন থেকে আমাকে কল দেন। তিনি ভয়ার্ত কণ্ঠে বলেন, ‘ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে, মেরে ফেলবে’। এরপর ফোনটি কেটে যায়।”

বিষয়টি মৌখিকভাবে আদাবর থানায় জানানোর পর পুলিশ তাকে উদ্ধারে তৎপর হয়। পুলিশের উপস্থিতিতেই সারা দিনে ফরহাদ মজহারের ফোন থেকে আরও চারবার কল আসে।
মামলায় লেখা হয়েছে, সেসব ফোনালাপে ফরহাদ মজহার তার স্ত্রীকে জানান, অপহরণকারীরা ৩৫ লাখ টাকা চেয়েছে। ওই টাকা পেলে তারা তাকে ছেড়ে দেবে।
অবশ্য মামলা হওয়ার আগেই পুলিশ অনুসন্ধানে নেমে মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে অরহাদ মজহারের অবস্থান শনাক্ত করে এবং খুলনা শহরে অভিযান শুরু করে। এরপর রাত সাড়ে ১১টার দিকে যশোরের নওয়াপাড়ায় ঢাকাগামী একটি বাসে ফরহাদ মজহারকে পাওয়ার কথা জানায় র্যা ব।

যশোর থেকে প্রথমে খুলনায় নিয়ে ফরহাদ মজহারকে ঢাকার পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর গতকাল মঙ্গলবার সকালে তাকে নিয়ে আসা হয় ঢাকার আদাবর থানায়। সেখানে থেকে নেওয়া হয় মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে।
গতকাল দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে এসে গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন বলেন, “ফরহাদ মজহার জানিয়েছেন সোমবার ভোরে ওষুধ কেনার জন্য তিনি বাসা থেকে বের হলে কয়েকজন একটি মাইক্রোবাসে করে তাকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর উনি নিজের মোবাইল ফোন থেকে স্ত্রীকে ফোন করে জানিয়েছিলেন, ৩৫ লাখ টাকা দিলে উনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। আমরা এখন জানার চেষ্টা করছি কারা উনাকে নিয়ে গিয়েছিল।”
সাংবাদিকরা বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করলে এই যুগ্ম কমিশনার বলেন, “আমরা এখনও তদন্ত করছি। আমাদের তদন্ত করার জন্য সময় দেন।”
পুলিশের সন্দেহ
সোমবার সকালে পরিবারের কাছ থেকে মৌখিক অভিযোগ পাওয়ার পর আদাবর থানার এসআই মহসিন আলী বলেছিলেন, ফরহাদ মজহার ‘কোনো একজনের ফোন পেয়ে’ ভোরে বাসা থেকে বের হয়ে যান বলে তার একজন আত্মীয় থানায় জানিয়েছেন।
আদাবর থানা থেকে তিনশ গজ দূরে ফরহাদ মজহারের বাসার দারোয়ান মো. আলি বলেছিলেন, তিনি ভোরে বাসা থেকে বের হয়ে হেঁটে ছোট ফটক দিয়ে বেরিয়ে সড়কে উঠতে দেখেছেন ফরহাদ মজহারকে। তাকে কেউ উঠিয়ে নিয়ে গেছে, এমন কোনো দৃশ্য তার চোখে পড়েনি।
আর পুলিশের আরেক কর্মকর্তা বলেছিলেন, শ্যামলী রিং রোড হক গ্যারেজের মোড় থেকে শ্যামলীর দিকে যেতে একটি হাসপাতাল রয়েছে। ওই হাসপাতালের সামনে ওই সময় একটি মাইক্রোবাস ছিল। পরে সেটি আর দেখা যায়নি।
অনুসন্ধানে যুক্ত থাকা পুলিশ কর্মকর্তা ডিএমপির উপ-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার সোমবার জানান, ফরহাদ মজহার যে আইফোনটি সচরাচর ব্যবহার করেন সোমবার ভোরে বের হওয়ার সময় তা সঙ্গে নেননি। “তিনি গ্রামীণ নম্বরের যে মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন এবং যে নম্বরটি সবার কাছে আছে সেটি বের হননি। এটি আইফোন। যে নম্বরটি রবির এবং সাধারণ একটি সেটের, সেটা নিয়ে তিনি বের হয়েছেন। এই নম্বরটি সবার কাছে নেই।”
ওই নম্বর ট্র্যাক করেই ফরহাদ মজহার খুলনা এলাকায় আছেন বলে সন্ধ্যার দিকে নিশ্চিত হন পুলিশ কর্মকর্তারা। এর ওপর ভিত্তি করেই শুরু হয় তল্লাশি। মধ্যরাতে তাকে যশোরে বাস থেকে উদ্ধারের খবর আসে।
উদ্ধারের তিন ঘণ্টা আগে ফরহাদ মজহার খুলনা নিউ মার্কেটের সামনে ‘নিউ গ্রীল হাউস’ নামের এক রেস্তোরাঁয় খাওয়া দাওয়া করেন বলে দাবি করেন ওই খাবার দোকানের মালিক আব্দুল মান্নান। পরে টিভিতে ছবি দেখে চিনতে পেরে তিনি র্যারবকে খবর দেন।

মান্নান সাংবাদিকদের বলেন,“আমার হোটেলে ভাত, ডাল ও সবজি খেয়ে রাত ৮টার দিকে বের হয়ে যান তিনি। তার পরনে লুঙ্গি ও মাথায় সাদা কাপড় ছিল। তাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল।”
ফরহাদ মজহারকে যশোরে বাস থেকে উদ্ধার করার পর রাতে ফুলতলা থানায় এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের উপ মহাপরিদর্শক দিদার আহম্মেদ বলেন, “একজন সুস্থ মানুষ যেভাবে জার্নি করে, সেভাবেই তিনি ছিলেন। তার সঙ্গে একটি ব্যাগ ছিল, গেঞ্জি ছিল। কিছু টাকাও ছিল। এমনকি মোবাইল চার্জার নিতেও ভোলেননি তিনি।”
র্যা ব অপহরণেরে কোনো ইঙ্গিত পায়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “মনে হয় না এটা অপহরণ।”
‘ফরহাদ মজহারের কাছে ব্যাগ আসলো কোথা থেকে?’
পুলিশ দাবি করেছে ফরহাদ মজহারের কাছ থেকে তারা একটি ব্যাগ উদ্ধার করেছে। তাতে জামা, মোবাইল ফোনের চার্জার ছিল। তবে তার স্ত্রী ফরিদা আখতার ও মেয়ে সমতলী হক বলেছেন, ভোরে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তার কাছে কোনও ব্যাগ ছিল না।
ব্যাগ প্রসঙ্গে তার স্ত্রী ফরিদা আখতার বলেন, 'ব্যাগ সঙ্গে নিয়েছেন কিনা তা তো জানি না। বাট উনি প্রায়ই একটা ব্যাগ সঙ্গে রাখেন। যার মধ্যে পড়ার জন্য বই ও ওষুধ থাকে। তবে তার কাছে যেমন ব্যাগ দেখা গেছে তেমন ব্যাগ উনি ইউস করেন না। এ ব্যাগ কোথা থেকে আসলো?' তিনি আরও বলেন, 'উনি ব্লাড প্রেসারের রোগী। ওষুধ না খেলে অসুস্থ হয়ে পড়েন। আর আমার মনে হচ্ছে উনি ঠিকমত খাননি। সঙ্গে ওষুধ নেননি। ওনাকে দেখে খুব খারাপ লাগছে। আগে এমন দেখিনি।'
ফরহাদ মজহারের মেয়ে বলেন, ‘আপনারা তো বাড়ি থেকে বের হওয়ার ফুটেজ দেখেছেন। তার কাছে তো কোনও ব্যাগ ছিল না। এখন ব্যাগ আসলো কিভাবে?’

উদ্ধারের পর আদাবর থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) হাফিজ আল ফারুকের নেতৃত্বে তাকে যশোর থেকে ঢাকায় আনা হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি দল যশোর থেকে একটি মাইক্রোবাসে (গাড়ি নম্বর- ঢাকা মেট্রো চ ১৩৪১৩১) করে তাকে নিয়ে সকাল পৌনে ৯টার দিকে ঢাকা পৌঁছায়। সেখানে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আদাবর থানায় তার স্ত্রী ফরিদা আখতার ও মেয়ে সমতলী হক ছিলেন।
ফরহাদ মজহারকে উদ্ধারের পর র্যারব ৬-এর সিও খন্দকার রফিকুল ইসলাম সোমবার জানিয়েছিলেন, ‘রাত সাড়ে ১১টার দিকে তাকে উদ্ধার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে খুলনায় নেওয়া হচ্ছে।’ অবশ্য রাত ১২টা ৫০ মিনিটে যশোরের অভয়নগর থানার ওসি আনিসুর রহমান জানিয়েছেন, ফরহাদ মজহার থানা হেফাজতে রয়েছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী তার ব্যাপারে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।
আমরা মামলা করিনি : মজহারের স্ত্রী
ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আক্তার বলেছেন, তার স্বামীকে অপহরণের ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো মামলা করা হয়নি। যদিও মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) আব্দুল বাতেন দাবি করেছেন পরিবারের করা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ফরহাদ মজহারকে উদ্ধারের পর রাতেই আদাবর থানায় একটি অপহরণ মামলা হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে পুলিশের সংবাদ সম্মেলনের পর ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদার সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ হলে তিনি বলেন, ‘মামলা করার প্রশ্নই আসেনা। আর অভিযোগ করাকে মামলা বলে কিনা আমার জানা নেই। আমরা উনাকে উদ্ধারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহায্য চেয়েছিলাম। এটাকে কোন আইনের ভাষায় মামলা বলে সেটা আমার জানা নেই। মামলা করতে হলে তো আমরা আইনজীবীর সাহায্য নিতাম।’
ফরহাদ মজহার হঠাৎ করেই বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। শোনা যাচ্ছে আগেও তিনি এভাবে বাড়ি থেকে হঠাৎ করে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফরিদা বলেন, ‘এটা গুজব ছাড়া কিছুই না। আমার জানা মতে এই বয়সে কখনো এমন ঘটনা ঘটেনি।’
ফরহাদ মজহার অপহরণ হওয়ার পর আপনারা মিডিয়ার কাছে মুখ খোলেন নি কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তার স্ত্রী বলেন, ‘ইচ্ছে করেই কথা বলিনি। যেহেতু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাপারটা দেখছিল তাদের কাজে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে সে চিন্তা করেই আমরা জানাই নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও কিছুটা বিধি নিষেধ ছিল এ বিষয়ে।’
ফরহাদ মহজহারের সঙ্গে পারিবারিক কোনো সমস্যা ছিল কিনা জানতে তিনি বলেন, ‘এটা কেমন প্রশ্ন হলো? এমন কোনো কিছুই আমাদের মধ্যে নেই। যদি আপনারা এমন কিছু পান তাহলে বের করেন।’
এখন আপনারা কি চাচ্ছেন? জানতে চাইলে ফরিদা বলেন, ‘আমরা এখন তাকে মুক্ত অবস্থায় দেখতে চাই। এমনিতেই উনি অসুস্থ, ব্লাড প্রেসার রয়েছে। তার উপরে উদ্ধার হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত তার উপর দিয়ে যা যাচ্ছে তাতে তিনি খুবই ক্লান্ত ও বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন। তাই এখন আমরা অন্য কিছু নিয়ে ভাবছি না। তার শারীরিক বিষয়টিই আমাদের কাছে মুখ্য।’
নানা প্রশ্ন

দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ফারুক ওয়াসিফ। তার ফেসবুক ওয়ালে ফরহাদ মজহারের অপহরণের ঘটনা নিয়ে কিছু প্রশ্ন রাখেন। তার শুরুতে তিনি নিজকে দাবি করেন এভাবে, গল্পবাজ নই, সাংবাদিক। তাই জানতে চাই: মাইক্রোবাসে করে গিয়ে বাসে ফিরলেন কেন? সেই মাইক্রোবাসটি কার? কে চালিয়েছিল? কোথায় তা এখন? সন্ধ্যা পর্যন্ত চোখ বাঁধা ছিল কেন? যিনি ফিরে আসছেন বা যাঁকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে, তিনি/তাঁকে কেন ছদ্মনামে লুকিয়ে বাসে ওঠানো হলো? এগেইন, ওই মাইক্রোবাস কেন ফিরলো না? গ্রিল হাউসে কবে থেকে ভাত-ডাল-সব্জি বিক্রি হয়? তাঁকে র্যা ব ক্যাম্পে নেয়া হয়েছিল কেন? তখনই তো তাঁকে পরিবারে বা হাসপাতালে পাঠিয়ে চেকাপ করানোর কথা। কার ফোন পেয়ে তিনি বের হন? সিসিটিভি ফুটেজে একবস্ত্রে বের হওয়া ব্যক্তি কীভাবে ব্যাগসহ 'উদ্ধার' হন? ৩৫ লাখ টাকার মুক্তিপণের ফোন কেন করানো হয়েছিল? ভারতে মুসলিম নিধন নিয়ে প্রতিবাদের পরপরই কেন এটা ঘটলো? নিজেকে 'গুম' দেখিয়ে ওনার কী লাভ? অসুস্থ, বিভ্রাšত ও নির্বাক দেখাচ্ছিল কেন তাঁকে?অতীতের নিখোঁজেরা ফিরে এসে কেন চুপ হয়ে যান?অতীতের ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধের সরকারি গল্পগুলো কী এবারের গল্পের মতোই? মেগাসিরিয়ালের পরের ভানুমতীর খেল কী?
সংযোজন: বেলার রিজওয়ানা হাসানের স্বামীর অপহরণ ও উদ্ধারের সঙ্গে প্যাটার্ন মিলে যাচ্ছে কি?
এ ভাবেই শেষ করেন সাংবাদিক ফারুক ওয়াসিফ।

http://www.dailysangram.com/post/290302