৫ জুলাই ২০১৭, বুধবার, ১১:৫৬

সুইস ব্যাংকে বিএনপির টাকা!

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রসিক মানুষ। বিশেষ ভঙ্গিতে তিনি যখন বিরোধী দল কিংবা ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সমালোচনা করেন, তখন সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। শব্দচয়নেও তিনি অন্য রাজনীতিবিদদের চেয়ে আলাদা। যেমন দলের মধ্যে অনুপ্রবেশের উদাহরণ হিসেবে কাউয়া, ফার্মের মুরগি কিংবা হাইব্রিড উপমা নিয়ে তিনি বেশ আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছেন। সম্প্রতি দেশ থেকে বিভিন্নভাবে টাকা পাচারের নানা তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। সর্বশেষ সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক তাদের রিপোর্টে বলছে, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশীদের টাকা রাখার পরিমাণ বেড়েছে। সমগ্র বিশ্ব থেকে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে যখন অর্থ জমা রাখার পরিমাণ কমেছে, সেখানে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে এক হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ জমা হয়েছে বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছ থেকে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলছেন, এই টাকা পাচারের সাথে বিএনপির নেতাকর্মীরা জড়িত। দলের সম্পাদকমণ্ডলীর এক বৈঠক শেষে ৩০ জুন তিনি বলেন, সুইস ব্যাংকে আওয়ামী লীগের কোনো টাকা নেই, বরং এ টাকা বিএনপি নেতাদের (যুগান্তর, ১ জুলাই ২০১৭)।

কেন এভাবে টাকা বিদেশে জমা করা হচ্ছে এবং কারা তা করছে, তা নিয়ে জার্মান সংবাদ সংস্থা ডয়েচে ভেলেকে আওয়ামী লীগপন্থী অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ কিছু ধারণা দিয়েছেন। তিনি বলছেন, আমার ধারণা প্রধানত তিনটি কারণে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের আমানত বাড়ছে। সোনালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংক থেকে কয়েক হাজার টাকা লুট হয়েছে। সেই ব্যাংক লুটের টাকা সুইস ব্যাংকে জমা করা হয়েছে। এটা ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতিরই ফল। আমদানি-রফতানির েেত্র ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে টাকা পাচার ছাড়াও ঘুষের টাকা পাচার বেড়েছে এবং বিদেশে বাংলাদেশী নাগরিক যারা ব্যবসায় করছেন, অর্থ উপার্জন করছেন, তাদেরও একটি অংশ সুইস ব্যাংকমুখী হয়েছেন।

বাংলাদেশ থেকে কী পরিমাণ টাকা সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে জমা হয়েছে, তার চিত্র দেখা যাক। ২০১৬ সালে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ থেকে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি ১০ লাখ সুইস ফ্রা, বাংলাদেশী মুদ্রায় বিনিময় করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় পাঁচ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ থেকে জমার পরিমাণ ছিল প্রায় ৫৫ কোটি সুইস ফ্রা, বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় চার হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে আগের বছরের চেয়ে পরের বছর জমার পরিমাণ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা বা ২০ শতাংশ বেড়েছে। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সাল থেকে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ থেকে অর্থ জমার পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। ২০১২ সালে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় ২২ কোটি ৮০ লাখ সুইস ফ্রা, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় এক হাজার ৯৬১ কোটি টাকা। ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল। এই সময়ের মধ্যে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশের জমা রাখা অর্থের পরিমাণও তিন গুণ বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ থেকে যখন স্ইুস ব্যাংকে টাকার পরিমাণ বাড়ছে, তখন অনেক দেশ থেকে কমছে। যেমন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের েেত্র সুইস ব্যাংকগুলোতে অর্থ জমার পরিমাণ ২০১৬ সালে আগের বছরের চেয়ে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। ২০১৫ সালে সুইস ব্যাংকগুলোতে ভারতের জমার পরিমাণ ছিল প্রায় ১২১ কোটি সুইস ফ্রা, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১০ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে এসে ভারতের জমার পরিমাণ অনেক কমে দাঁড়িয়েছে ৬৬ কোটি ৪০ লাখ সুইস ফ্রা, বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় পাঁচ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শুধু বেড়েই যাচ্ছে। ২০০৯ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের জমার পরিমাণ ছিল ১৪ কোটি ৯০ লাখ সুইস ফ্রা বা এক হাজার ২৮১ কোটি টাকা, আর তা ৩৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে এখন পাঁচ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা।

আমরা দেখছি, ২০০৯ সাল থেকে সুইস ব্যাংকে টাকা জমানোর পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে ২০০৯ সালের একেবারে গোড়ায়। এরপর প্রতি বছর সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশীদের আমানতের পরিমাণ বেড়ে গেছে। প্রশ্ন হলো, অন্য কোনো সরকার ক্ষমতায় থাকলে কি সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে এভাবে আমানতের পরিমাণ বাড়ত না? হয়তো বাড়ত কিংবা নাও বাড়তে পারত। বিষয়টি নির্ভর করে অর্থনৈতিক সুশাসন বা টাকা পাচারের সুযোগ কতটা বন্ধ করা যাচ্ছে এর ওপর। বর্তমান সরকারের সময় যেভাবে অভিনব কায়দায় এবং বিপুল পরিমাণে ও বারবার ব্যাংক লুটের ঘটনা ঘটেছে, অতীতে কোনো সরকারের আমলে তা ঘটেনি। প্রথমে লুটপাট হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, এরপর বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে টাকা লোপাটের ঘটনা ঘটেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে টাকা লুটপাটের সময় এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে কারা ছিলেন? এমন কোনো ব্যাংক নেই যে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একাধিক সংসদ সদস্য ছিলেন না। সোনালী ব্যাংকের অর্থ লোপাটের সাথে একজন নারী সংসদ সদস্যসহ ক্ষমতাসীন দলের একাধিক সংসদ সদস্যের নাম জড়িয়ে আছে। একই অবস্থা বেসিক ব্যাংকের ক্ষেত্রেও। অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত নিজে সংসদে এবারের বাজেট অধিবেশনে বলেছেন, দেশের ব্যাংকগুলোর অবস্থা নাজুক। তবে এই নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য তিনি কম দায়ী নন। কারণ সোনালী ব্যাংক থেকে চার হাজার কোটি টাকা লোপাটের পর তিনি বলেছিলেন, এই টাকা খুবই সামান্য।
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য প্রকাশের আগে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে তুলনামূলক বেশি অর্থ পাচার হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। জিএফআইয়ের তথ্য বলছে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯১১ কোটি ডলার বা প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে। পাচার হওয়া এ অর্থ দিয়ে বাংলাদেশে দু’টি পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব। একই সময়ে বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল সাত হাজার কোটি ডলারের বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যিক লেনদেনের গড়ে ১০ শতাংশের বেশি অর্থ পাচার হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় সাত হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার বা ছয় লাখ ছয় হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। এই অর্থ দিয়ে এ দেশের অর্থমন্ত্রী প্রায় দুই অর্থবছরের বাজেট তৈরি করতে পারতেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতি বছর এই যে বিপুলসংখ্যক টাকা পাচার হচ্ছে তার সাথে কারা জড়িত? বিপুল অর্থবিত্তের মালিক ছাড়া তো বিদেশে টাকা পাচার করার সুযোগ নেই। গত দশ বছরে কারা এভাবে অর্থের মালিক হয়েছেন? ওবায়দুুল কাদেরের মতে, এই টাকা বিএনপির নেতাদের। ২০০৮ সালের পর থেকে বিএনপি নেতারা দৌড়ের ওপর আছেন। জিয়াউর রহমানের নামে প্রতিষ্ঠিত একটি এতিমখানার জন্য নেয়া মাত্র দুই কোটি টাকার হিসাবের গরমিলের কারণে বেগম খালেদা জিয়াকে আদালতের বারান্দায় দৌড়াতে হচ্ছে বারবার। বিএনপির প্রথম সারির বহু নেতার নামে একাধিক মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এমনকি ফ্যাটের দাম কম দেখিয়ে ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া হয়েছে কি না সে জন্য একজন ভিন্নমতাবলম্বী সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। অথচ হাজার হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার হয়ে গেল; তবুও দুদক, রাজস্ব বোর্ড কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুই টের পাচ্ছে না কেন? বিএনপি নেতারা যদি এভাবে টাকা পাচারের সাথে জড়িত থাকেন, তাহলে সরকার সহজেই মানিলন্ডারিং মামলায় আটক করতে পারে। এমন সুযোগ কেন ক্ষমতাসীন দল হাতছাড়া করছে? ক্ষমতাসীন দলের নেতারা দেশে যেকোনো ঘটনার জন্য বিএনপি বা বিরোধী দলের ওপর দায় চাপাচ্ছেন। এমনকি চট্টগ্রাম পাহাড়ধসের ঘটনার সাথে বিএনপি জড়িত বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। অথচ ব্যাংক থেকে অর্থ লোপাটের ঘটনার কোনো সুষ্ঠু তদন্ত পর্যন্ত হয়নি। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা চুরির ঘটনার পর যে তদন্ত করা হয়েছিল তার রিপোর্ট পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি।

ক্ষমতাসীন দলের নেতারা কিভাবে পাঁচ বছরের মধ্যে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়ে গেছেন, তার কিছু চিত্র পাওয়া গেছে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে দেয়া সম্পদের বিবরণীতে। ২০০৮ সালে যেসব মন্ত্রী-এমপির কৃষিজমি কিংবা ছোট কোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ছাড়া কিছু ছিল না তারা ২০১৪ সালে রাজধানীতে একাধিক প্লট, ফ্যাট, গ্রামে চিংড়ির ঘের কিংবা একাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক বনে গেছেন। এরপর আরো তিন বছর চলে গেছে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে আরো বিপুল পরিমাণ টাকা লুটপাট হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত এসব টাকার একটি অংশ হয়তো চলে গেছে সুইজারল্যান্ডের কোনো ব্যাংকে।

প্রকৃতপক্ষে লুটপাটের কারণেই দেশের অর্থনীতি এখন বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকার অর্থনৈতিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। বিরোধী দলের ওপর দায় চাপালে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে না। সরকারের উচিত টাকা পাচারের ঘটনার অবিলম্বে সুষ্ঠু তদন্ত করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরির তদন্ত রিপোর্ট গোপন করার কৌশল না নিয়ে পাচারকারীদের পরিচয় তুলে ধরতে হবে। প্রয়োজনে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার চেষ্টা করতে হবে। অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে জনগণের দৃষ্টির আড়াল করা যাবে না। সাধারণ মানুষ জানে, কিভাবে রাজনৈতিক প্রভাবে ব্যাংক লুটপাটের মাধ্যমে এ দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
alfazanambd@yahoo.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/233036