প্রবল বর্ষণে চট্টগ্রাম মহানগরীতে পানিবদ্ধতার চিত্র -সংগ্রাম
৪ জুলাই ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:২৩

চট্টগ্রামে প্রবল বর্ষণ ॥ অধিকাংশ এলাকায় পানিবদ্ধতা ॥ জনজীবনে চরম দুর্ভোগ

মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় গত রোববার থেকে চট্টগ্রামে প্রবল বর্ষণ অব্যাহত আছে। অবিরাম বর্ষণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে মানুষ। প্রবল বর্ষণে চট্টগ্রাম মহানগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে পানিবদ্ধতায় ব্যাপক জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে। গভীর রাত থেকে চট্টগ্রাম মহানগরীর অধিকাংশ এলাকায় পানি জমে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। বাসা বাড়ি দোকানপাট সর্বত্র পানি আর পানি। কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমড় পানি। পানিবদ্ধতার কবলে পড়া বাসা বাড়িতে লোকজন নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে। আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়ায় ব্যাপক ক্ষতির আশংকা করছেন ব্যবসায়ীরা। জোয়ারের ফলে পানিবদ্ধতা আরও বেড়ে যায় বলে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছে। যানবাহন চলাচল সীমিত হয়ে পড়ে। প্রবল বর্ষণে পানির তোড়ে ভেসে গিয়ে এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে।

এদিকে চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রবল বর্ষণে জলাবদ্ধতার বিষয়ে মেয়র আ.জ.ম নাসির বলছেন,পানিবদ্ধতা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত।এটি সমাধানে কাজ চলছে। বিভিন্ন প্রকল্প নেয়া হয়েছে।
এদিকে ভারী বৃষ্টির কারণে পাহাড়ধসের সতর্কবার্তা জারি করেছে আবহাওয়া দপ্তর। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস জানায়, সোমবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম ও আশপাশের এলাকায় ৬৮ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে চট্টগ্রাম ও আশপাশের এলাকায় বৃষ্টি চলছে। একই কারণে আগামী দুই-এক দিন ভারী বৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া পাহাড়ধসের সতর্কবার্তাও রয়েছে।
এদিকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ আশপাশের এলাকায় টানা বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি আর বহির্নোঙ্গরে জাহাজ থেকে খোলা ও বস্তাবন্দী পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে। তবে বন্দরের জেটিতে কন্টেইনার ওঠানামা ও পণ্য খালাস স্বাভাবিক রয়েছে। বন্দর সূত্রে জানা গেছে, মূল জেটিতে ১৭ এবং বহির্নোঙ্গরে ৩৫টি জাহাজ রয়েছে। এসব জাহাজে গম, ডাল, চিনি, ইউরিয়া, পাথর, সিমেন্ট ক্লিংকার, লবণ, গমসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য রয়েছে। বহির্নোঙ্গরে সব জাহাজে কাজ বন্ধ থাকলেও জেটিতে কেবল গমবাহী একটি জাহাজে কাজ বন্ধ রয়েছে। বাকি ১৬ জাহাজে কাজ চলছে। এরমধ্যে ১২টি কন্টেইনারবাহী। বাকি চারটি বাল্ক কার্গোতে গাড়ি ও পাথর রয়েছে।ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের নির্বাহী পরিচালক মাহববু রশিদ জানান, বৃষ্টির কারণে বহির্নোঙ্গরে বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে।
প্রবল বর্ষণের সময় সরেজমিনে চট্টগ্রাম মহানগরীর অধিকাংশ এলাকায় ঘুরে জলাবদ্ধতা লক্ষ্য করা গেছে। বিভিন্ন এলাকায় কোথাও হাঁটু কোথাও কোমড় পর্যন্ত পানি দেখা গেছে। এ সব এলাকার মানুষ চরম দুভোর্গে পড়েছে। বেশী ভাগ এলাকায় পানিতে বিভিন্ন সড়ক, গলিসহ পাড়া মহল্লার বিভিন্ন ভবনের নিচতলার বাসা ডুবে যায়। এতে করে চাকরিজীবী ও সাধারণ মানুষ সকাল থেকেই চরম ভোগান্তিতে পড়ে। বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন সড়কে যানবাহন চলাচল কমে যায়। কোথাও কোথাও সড়কে জমে থাকা পানিতে বাস-অটোরিকশাসহ যানবাহন আটকে গিয়ে ভোগান্তি আরও চরম আকার ধারণ করে। আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকার সড়ক ছাপিয়ে বৃষ্টির পানি দোকানপাট-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও ঢুকে পড়েছে।
জিইসি থেকে মুরাদপুর পর্যন্ত সড়কে যান চলাচল সোমবার সকাল ১০টা থেকে বন্ধ হয়ে যায়। আগ্রাবাদ এক্সেস সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয় সকাল আটটা থেকে। এ ছাড়া প্রবর্তক মোড় বহদ্দারহাট মোড় ও চান্দগাঁও এলাকায় যান চলাচল বন্ধ রয়েছে বলে জানা গেছে। ষোলোশহর মোড়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসা একটি বাস আটকা পড়ে। বাসের চালক আনোয়ার হোসেন দুপুর ১২টায় বলেন, ‘সকাল সাতটায় এই মোড়ে আটকা পড়েছি। জিইসি থেকে এদিকে এসে এক কিলোমিটার এলাকায় যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এসপি অফিসের সামনে পানির কারণে আর যেতে পারিনি। মুরাদপুর দিয়েও যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায় পড়ে।
ষোলোশহর এসপি কার্যালয়ের সামনে কোমরসমান পানি ডিঙিয়ে মানুষ পার হচ্ছিলেন ভ্যানে চড়ে। প্রতিজনের কাছ থেকে ১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা জানান,ভারী বৃষ্টির সঙ্গে জোয়ার থাকায় পানি নামতে না পারায় নিম্নাঞ্চলে জলজট দেখা দিয়েছে। ভাটা শুরু হলে পানি নেমে যাবে।
এদিকে ৫ থেকে ৬ লাখ লোকের বাস চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ, হালিশহর এলাকার বাসিন্দাদের দু:খ হিসাবে পরিচিত মহেশখাল বাঁধটি অপসারণ হলেও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মেলেনি । প্রতিদিন জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে এসব এলাকা। সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নাজমুল হক ডিউক বলেন, বাধে প্রচুর পরিমাণে ময়লা জমার কারণে এবং যে কয়টি পাইপ ছিলো সেগুলো দিয়ে পানি যথেষ্ট পরিমাণে যাচ্ছিলো না। অস্থায়ী বাঁধটি ভাঙ্গার ফলে দীর্ঘমেয়াদী পানিবদ্ধতার হাত থেকে মুক্তি পেলেও জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হওয়া থেকে রেহাই পায়নি এলাকাবাসী। আর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন জানালেন, মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পেলেই সবার পরামর্শ নিয়েই সুইচ গেইট নির্মাণ করা হবে। তিনি বলেন, 'সুইচ গেইট নির্মাণের চেয়ে সেটা পরিচালনা করা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করাটা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। আমাদের তো সেই এক্সপার্টিজ নেই। আমরা অর্থায়ন করতে পারবো সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে।
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তার মৃত্যু-চট্টগ্রামে প্রবল বর্ষণে ড্রেনে পড়ে শীলব্রত বড়ুয়া নামে সাবেক এক সরকারি কর্মকর্তার মৃত্যু হয়েছে। রোববার মধ্যরাতে দামপাড়া মোহাম্মদ আলী রোডে ড্রেনের পানিতে ভেসে যাওয়ার অন্তত ১২ ঘণ্টা পর বাকলিয়া থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। মৃত শীলব্রত বড়ুয়া হাটহাজারী উপজেলার সাবেক হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা ছিলেন। পুলিশ জানায়, একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চট্টগ্রামে আসেন তিনি। রাত একটার দিকে দামপাড়া মোহাম্মদ আলী রোডের রয়েল গার্ডেন কমিউনিটি সেন্টার থেকে বের হয়ে বাসে উঠার সময় পা পিছলে রাস্তার পাশে ড্রেনে পড়ে যান। প্রবল বর্ষণের কারণে পানির পরিমাণ বেশি থাকায় তিনি ভেসে যান বলে জানায় স্বজনরা। পরে ঘটনাস্থল থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে বাকলিয়া এলাকার মিয়াখান নগর খাল থেকে সোমবার সকালে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
মেয়রের সাংবাদিক সম্মেলন : গতকাল সোমবার, দুপুরে নগরভবনের কে বি আবদুচ ছত্তার মিলনায়তনে চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ও সাম্প্রতিক বর্ষণে চট্টগ্রাম মহানগরীর ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মেরামত করণে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের গৃহীত উদ্যোগ ও কার্যক্রম বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন এক সাংবাদিক সম্মেলন বলেন, চট্টগ্রাম নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে অবস্থিত ১৪৪ কি.মি. খাল এবং প্রায় ৬ শত কি.মি. নালা-নর্দমা পরিষ্কার করার জন্য ১৮ কোটি টাকার দরপত্র আহবান করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু কাজ সমাপ্ত হয়েছে। কিছু কাজ চলমান রয়েছে এবং অবশিষ্ট কাজের কার্যাদেশ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়াও শ্রমিক নিয়োগ করে নিজস্ব ও ভাড়াকৃত এস্কেভেটর এর মাধ্যমে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ খাল সমূহে প্রতিনিয়ত মাটি উত্তোলনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
অতিবর্ষণ ও অতি জোয়ারের পানির কারণে নগরীতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় নাগরিক দুর্ভোগের জন্য সাংবাদিক সম্মেলনে দুঃখ প্রকাশ করেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন।
তিনি আরো বলেন, প্রতি বছর বর্ষাকালে পাহাড় থেকে নেমে আসা বালিতে নালা-নর্দমা ভরাট হয়ে পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। ফলে ভরাটকৃত বালি ও ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করার জন্য প্রকল্প নেয়া হয়। গত অর্থবছরেও নালা-নর্দমা পরিষ্কার করার জন্য ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নালা-নর্দমা পরিষ্কার করা হয়েছে। এ ছাড়াও বিমান বন্দর সড়কের সিমেন্ট ক্রসিং থেকে রুবি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি পর্যন্ত রাস্তার অংশে পানিবদ্ধতা দূরীকরণের জন্য ৪ হাজার ৬ শত ফুট ড্রেইন নির্মাণ কাজের জন্য ৬ কোটি ২৪ লক্ষ ৩২ হাজার টাকার দরপত্র আহবান করা হয়েছে।
তিনি বলেন, মহেশখালে বাঁধ নির্মাণের ফলে পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ায় গত জুন মাসে তা অপসারণ করা হয়। মহেশখাল, চাক্তাইখাল সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খালে এস্কেভেটর মাধ্যমে মাটি উত্তোলন ও অপসারণ কাজ চলমান রয়েছে। তা ছাড়াও মহেশখাল থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত একটি ড্রাইভারশান খাল খনন বিষয়ে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যাতে বর্ষণজনিত কারণে সৃষ্ট পানি সহজে বঙ্গোপসাগরে চলে যেতে পারে।
আ জ ম নাছির উদ্দীন সাংবাদিকদের অবগতির জন্য আরো বলেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এবং চীনের সরকারী প্রতিষ্ঠান পাওয়ার চায়নার সাথে পানিবদ্ধতা নিরসনকল্পে ২৭টি স্লুইচ গেইট, বড় খাল সমূহের দু’পাশে রিটেইনিং ওয়াল এবং খাল সমূহের ড্রেজিং এর জন্য ৫ হাজার ৬ শত কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে প্রকল্পটি পিডিপিপি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন হয়েছে এবং প্রকল্পটি জি টু জি এর মাধ্যমে বাস্তবায়নের জন্য ইআরডি-তে প্রেরণ করা হয়েছে। বর্তমানে ডিপিপি প্রস্তুতির কাজ চলছে।
মেয়র বলেন, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড প্রায় ৩ ফুট উচু করে রাস্তার দু’পাশে বৃহৎ আকারের নালা নির্মাণ প্রকল্প এবং পোর্ট কানেকটিং রোডে ৪ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন কাজের টেন্ডার প্রক্রিয়া সমাপ্ত হয়েছে। বর্ষণ বন্ধ হলে এ সকল সড়ক নির্মাণ কাজ শুরু হবে। প্রসঙ্গেক্রমে মেয়র আরো বলেন, মহেশখাল সহ সকল খালের মুখে স্লুইচ গেইট নির্মাণের পরিকল্পনা ও প্রকল্প পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে। মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, এক শ্রেণীর অপশক্তি সুযোগ বুঝে প্রকৃতিগতভাবে সৃষ্ট জনদুর্ভোগকে পুঁজি করে যাতে ফায়দা লুটার চেষ্টা করতে না পারে সেবিষয় গুলো বিবেচনায় আনতে হবে।এসময় উপস্থিত ছিলেন কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব, নাজমুল হক ডিউক, এইচ এম সোহেল, মোহাম্মদ মোরশেদ, চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামসুদ্দোহা, প্রধান প্রকৌশলী লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমদ প্রমুখ।



http://www.dailysangram.com/post/290233-