পানিবন্দী সিলেটের ওসমানীনগর এলাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়
৪ জুলাই ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:২১

সিলেটের ৭ উপজেলায় বন্যা

পাহাড়ী ঢলে ও অব্যাহত বর্ষণের ফলে প্রবাসী অধ্যুষিত ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ, বিয়ানীবাজারসহ সিলেটের ৭টি উপজেলায় দীর্ঘমেয়াদী বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে এসব উপজেলার প্রায় সকল রাস্তাঘাট ও বাড়িঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদরাসা ও মন্দিরসহ ক্ষেতের বহু জমি-জমা। এমনকি কয়েকটি উপজেলা পরিষদও বন্যার পানিতে তলিয়ে রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদী বন্যায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে অপ্রতুল ত্রাণ সামগ্রী থাকায় হাহাকার আর হাহাকার। দুর্ভোগ চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ১৭৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্যার পানির কারণে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ৩ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গিয়েছে, মসজিদে মানুষ নামাজ পড়তে পারছে না। জনপ্রতিনিধিদের উপর ক্ষুব্ধ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণ। বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সও পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় পানিবন্দী মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ। ফলে পানিবন্দী মানুষ ত্রাণের জন্য করছেন হাহাকার। 

সিলেটের বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, জকিগঞ্জ ও কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা বন্যার পানিতে তলিয়ে রয়েছে। টানা বর্ষণ ও ভারতের পাহাড়ি এলাকা থেকে নেমে আসা ঢলে এসব উপজেলার কোথাও এক মাস ধরে, কোথাও দুই সপ্তাহ ধরে বন্যা দেখা দিয়েছে। ফলে এসব এলাকার কয়েক লাখ মানুষ হয়ে পড়েছেন পানিবন্দী। বন্যা দীর্ঘমেয়াদী হওয়ায় চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন বন্যাদুর্গত মানুষ। এরকম অবস্থায় পর্যাপ্ত ত্রাণ না মিলায় তাদের হাহাকার আরো দীর্ঘায়িত হয়েছে।
সরেজমিনে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় গিয়ে দেখা যায়, গত প্রায় এক মাস ধরে এ উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের বেশিরভাগ এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে রয়েছে। ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার তলিয়ে রয়েছে পানির নিচে। ফেঞ্চুগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ও তলিয়ে গেছে বন্যার পানিতে।
ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল মুনিম বলেন, ‘রাস্তাঘাট ও ইউপি পরিষদ কার্যালয় তলিয়ে যাওয়ায় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সেবা প্রদান করা দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ জরুরী প্রয়োজন ছাড়া ইউপি পরিষদ কার্যালয়ে আসছেন না।’
সরেজমিনে বালাগঞ্জ উপজেলায় গিয়ে দেখা যায়, এ উপজেলায় গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে বন্যা দেখা দিয়েছে। কুশিয়ারা নদীর পানি উপচে ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ উপজেলায় বন্যা দেখা দেয়। এ নদীর পানি না কমায় এ দুই উপজেলায় বন্যাও কমছে না। বালাগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের প্রতিটি কক্ষে পানি ঢুকে পড়েছে। এ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বারান্দা পর্যন্ত পানি রয়েছে। বালাগঞ্জ সদর ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয় ও উপজেলা ডাকবাংলোও রয়েছে পানির নিচে। পানির মধ্যেই কোনরকমে উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়।
বালাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রদীপ সিংহ জানান, বন্যার পানি না কমায় পানিবন্দী অবস্থায় অফিস করতে হচ্ছে। এতে উপজেলার কর্মকর্তারা এবং সেবাগ্রহীতারাও দুর্ভোগের স্বীকার হচ্ছেন।
বালাগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান আবদাল মিয়া বলেন, ‘উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নের ৮০ ভাগ এলাকা বন্যাদুর্গত। সরকার থেকে যে ত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে, তা খুবই অপ্রতুল।’ তিনি সরকারের কাছে আরো বেশি ত্রাণ দাবি করেন। একইসাথে বন্যাদুর্গতদের সহায়তায় সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।
উপজেলা চেয়ারম্যান আবদাল মিয়া আরো বলেন, ‘কুশিয়ারা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি নামতে পারছে না। এজন্য দীর্ঘমেয়াদী বন্যায় দেখা দিয়েছে। এর সমাধানের জন্য কুশিয়ারা খনন করতে হবে।’
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক আনিসুর রহমান জানান, বন্যার পর থেকে এলাকায় ডায়রিয়া, জ্বর ও নিউমোনিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। কিন্তু হাসপাতালের চারদিকের রাস্তা ডুবে থাকায় মানুষ চিকিৎসাসেবা নিতে হাসপাতালে আসা লোকজনকে মারাত্মক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
এদিকে, বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষ এখন ত্রাণের জন্য হাহাকার করছেন। বন্যাদুর্গত বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে অল্প সংখ্যক মানুষ ত্রাণ পেলেও সিংহভাগ মানুষের কাছেই ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না। ফলে এসব মানুষ রয়েছেন চরম দুর্ভোগের মধ্যে। বন্যাদুর্গত কিছু এলাকায় মানুষের কাছে ত্রাণের চাল পৌঁছালেও আগুন জ্বালিয়ে চাল সিদ্ধ করার সুযোগ না থাকায় অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের। ত্রাণ হিসেবে শুকনো খাবার প্রদানের দাবি তাদের।
এদিকে, রোববার সিলেট জেলা প্রশাসনের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জানানো হয়, বন্যার কারণে সিলেটের ১৭৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। তন্মধ্যে ১৬১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। বন্যায় নষ্ট হয়েছে ৩ হাজার হেক্টর আউশ ও আমনের ফসল। এছাড়া বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য ৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ৮৯টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষ এখন ত্রাণের জন্য হাহাকার করছেন। বন্যাদুর্গত বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে অল্প সংখ্যক মানুষ ত্রাণ পেলেও সিংহভাগ মানুষের কাছেই ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না। ফলে এসব মানুষ রয়েছেন চরম দুর্ভোগের মধ্যে। বন্যাদুর্গত কিছু এলাকায় মানুষের কাছে ত্রাণের চাল পৌঁছালেও আগুন জ্বালিয়ে চাল সিদ্ধ করার সুযোগ না থাকায় অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের। ত্রাণ হিসেবে শুকনো খাবার প্রদানের দাবি তাদের।
ফেঞ্চুগঞ্জের পিটাইটিকর গ্রামের ছমিরন বেগম জানান, প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে তিনি পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ পাননি।
ফেঞ্চুগঞ্জ সদরের বাসিন্দা দিনমজুর রফিকুল ইসলাম জানান, বাড়িতে পানি ওঠে যাওয়ায় বাড়ি ছেড়ে আত্মীয়ের বাড়িতে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যার পরে কোনো ত্রাণ তিনি পাননি। উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কাজও মিলছে না। ফলে বেকার অবস্থায় পরিবার নিয়ে দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছেন।
বালাগঞ্জের সুনামপুর এলাকার কৃষক আবদুর রহিম জানান, গেল বন্যায় তার বোরো ফসল তলিয়ে যায়। এবার আউশ ফসল তলিয়ে গেছে। তার বাড়িতও পানি ওঠেছে। এখন অসহায় অবস্থায় আছেন। কোনো ত্রাণ তার কাছে পৌঁছায়নি।
ফেঞ্চুগঞ্জ সদরের প্রতিমা রাণী বিশ্বাস জানান, এক মাস ধরে তার ঘরে পানি রয়েছে। ঘরের মধ্যে মাচা বেঁধে তার আসবাবপত্র রেখেছেন। পানিবন্দী অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করলেও তাদের খোঁজ নিতে কেউ আসেনি।
ত্রাণের বিষয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ সদর ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল মুনিম জানান, তার ইউনিয়নে বন্যাদুর্গতদের জন্য আড়াই মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পেয়েছেন। এই চাল দিয়ে আড়াইশ’ লোককে হয়তো ত্রাণ দেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু তার ইউনিয়নে কয়েক হাজার বন্যার্ত পরিবার ত্রাণের অপেক্ষায় রয়েছেন।
সিলেটের জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার জানান, জেলার বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষের জন্য ১৩৭ মেট্রিক টন চাল এবং নগদ ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ত্রাণের কোনো অভাব নেই। প্রয়োজনে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আরো ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হবে।


http://www.dailysangram.com/post/290237-