৪ জুলাই ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:২০

ফরহাদ মজহার আদাবর থানায়

দেশবরেণ্য কবি, কলামিস্ট ও বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহারকে এখন ঢাকার আদাবর থানায় আনা হয়েছে। তার স্ত্রী ফরিদা আক্তার নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, থানার পক্ষ থেকে তাকে বলা হয়েছে, দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা আসার পর তাকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
এর আগে সোমবার অপহরণের ১৮ ঘণ্টা পর যশোরের নোয়াপাড়া থেকে র্যাব উদ্ধার করে। সোমবার ভোর ৫টার পর তাকে বাসার সামনে থেকে অপহরণ করা হয়। এর পর তিনি স্ত্রীর সাথে টেলিফোনে কয়েকবার কথা বলে জানান, অপহরণকারীরা মুক্তিপণ হিসেবে তার কাছে ৩৫ লাখ টাকা দাবি করছে। তাকে হত্যা করা হবে বলেও তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেন।
দিনভর পরিবারসহ দেশবাসী উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকার পর রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ র্যাব-৬ এর একটি টিম যশোরের নওয়াপাড়ার ভাঙ্গাগেট এলাকা থেকে তাকে উদ্ধার করে খুলনার ফুলতলা থানায় নিয়ে যায়। রাত সোয়া ১টায় এক প্রেস ব্রিফিংয়ে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি দিদার আহমদ ও র্যাব-৫ এর সিও খন্দকার রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, নওয়াপাড়ায় ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনের একটি কোচ থেকে রাত ১১টা ২০ মিনিটে তাকে উদ্ধার করা হয়। তিনি খুলনা থেকে এই কোচে ওঠেন। তারা জানান, ফরহাদ মজহারের সাথে থাকা একটি ব্যাগে কাপড় ছিল। এতে মনে হয় তিনি ট্র্যাভেল করছিলেন। ফরহাদ মজহারকে সাংবাদিকদের সামনে আনা হলেও কোনো কথা বলেননি। রাত দেড়টার পর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কর্মকর্তারা একটি মাইক্রোবাসে করে তাকে ঢাকার উদ্দেশে নিয়ে যান।
সোমবার ভোর ৫টার কিছুক্ষণ পর একটি ফোন পেয়ে তিনি ঢাকার শ্যামলীর ফ্যাট থেকে বের হয়ে গেটের সামনে যান। এরপর তিনি স্ত্রীকে ফোনে জানান যে, তাকে অপহরণ করা হয়েছে এবং অপহরণকারীরা তার কাছ থেকে ৩৫ লাখ টাকা দাবি করছে এবং তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ফরহাদ মজহারের পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনরাসহ দেশবাসী চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে সময় কাটান। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে ধারণা আসে যে, ফরহাদ মজহারকে খুলনার দিকে নেয়া হয়েছে। মোবাইল ট্রাকিংয়ের মাধ্যমে অবস্থান নিশ্চিত হয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করছে। বিশেষ করে খুলনা মহানগরীতে তার অবস্থান নিয়ে বিকেল থেকে রাত অবধি চলে অভিযান।
ভারতে মুসলিম নিধনের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকার ১৬ ঘণ্টা পরে অপহৃত হন ফরহাদ মজহার।
ফরহাদ মজহারের বাসা শ্যামলী রিং রোডের হক গার্ডেনের চতুর্থ তলায়। তার পারিবারিক সূত্র জানায়, ভোর ৫টার কয়েক মিনিট পর বাসা থেকে বের হন ফরহাদ মজহার। স্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে একটি সূত্র বলেছে, সাধারণত ভোর ৪টার দিকেই ফরহাদ মজহার ঘুম থেকে জাগেন। এরপর লেখালেখি করেন। গতকালও তিনি ঘুম থেকে উঠে টেবিলে বসেন। কিছুক্ষণ পরে স্ত্রী ফরিদা আখতার দেখতে পান ফরহাদ মজহার টেবিলে বসা। এর প্রায় আধা ঘণ্টা পরে তাকে টেবিলে না দেখে ফরিদা আখতার ধরে নেন হয়তো তিনি বাথরুমে গেছেন। ভোর ৫টা ২৯ মিনিটে যখন তার কাছে ফরহাদ মজহারের প্রথম ফোন আসে তখন তিনি জানতে পারেন ফরহাদ মজহার বাসায় নেই। তাকে তুলে নেয়া হয়েছে।
৫টা ২৯ মিনিটে একটি অজ্ঞাত নম্বর থেকে ফরিদা আখতারের কাছে ফোন আসে। ফোনে ফরহাদ মজহার নিজেই কথা বলেন। তিনি ফরিদা আখতারকে বলেন, ‘ওরা আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’ তখন তিনি বলেন, ‘ওরা আমার কাছে ৩৫ লাখ টাকা চাচ্ছে।’ এর বেশি কিছু বলতে পারেননি ফরহাদ মজহার।
এ দিকে ফরহাদ মজহারকে অপহরণ করা হয়েছে এ খবর জানতে পেরে স্ত্রী ফরিদা আখতার নিচে চলে যান। তিনি দারোয়ানদের জিজ্ঞেস করলে দারোয়ান মো: আলী তাকে জানান, ফরহাদ মজহার ভোরে বাসা থেকে বের হয়ে গেছেন। ভবনের সিসি ফুটেজে দেখা যায় ফরহাদ মজহার ভোর ৫টা ৬ মিনিটে গেট থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। পরে ফরিদা আখতার বিষয়টি ফরহাদ মজহারের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করেন। দুপুরের দিকে বিষয়টি ব্যাপকভাবে জানাজানি হলে মিডিয়াকর্মীরা ওই বাসায় গিয়ে ভিড় জমান।
বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটে ফরহাদ মজহার আবারো অজ্ঞাত নম্বর দিয়ে ফরিদা আখতারের মোবাইলে ফোন করেন। এ সময় তিনি বলেন, তাকে ঢাকার বাইরে নেয়া হচ্ছে। কে বা কারা তাকে অপহরণ করেছে সে সম্পর্কে তিনি কিছুই জানাতে পারেননি। ওই নম্বরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও ফোন দিয়ে কোনো তথ্য জানতে পারেননি। কেননা কথা বলার পরই ফোন বন্ধ করে দেয়া হয়।
এ দিকে গতকাল দুপুরের ওই হক গার্ডেনে গেলে দারোয়ান মো: আলী জানান, ফরহাদ মজহারের বাসায় কোনো লোক নেই। আলী বলেন, ভোরে যখন ফরহাদ মজহার বাসা থেকে বের হচ্ছিলেন তখন তিনিই দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বলেন, বাইরের দিকে তিনি খেয়াল করেননি।
এ দিকে, বিকেলে ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আখতার আদাবর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। ডায়েরিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ফরহাদ মজহার বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তার পরনে সাদা পাঞ্জাবি, চেক লুঙ্গি ও সাদা চাদর ছিল।
থানা পুলিশ বলছে, ঘটনা জানার পর থেকেই ওই এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। গতকাল বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা যায় পুলিশের তিনটি গাড়ি রয়েছে। এ ছাড়া সাদা পোশাকের পুলিশ ও গোয়েন্দা সদস্যদেরও সেখানে দেখা যায়। ঘটনার ব্যাপারে মহানগর পুলিশ মিডিয়া সেলের ডিসি মাসুদুর রহমান বলেন, ঘটনা জানার পর থেকেই পুলিশ ফরহাদ মজহারকে উদ্ধারের চেষ্টা শুরু করে। প্রযুক্তি ব্যবহারে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। একটি সূত্র জানায়, পুলিশের বাইরে অন্যান্য সংস্থাও ফরহাদ মজহারকে উদ্ধারে মাঠে নেমেছে। জানা গেছে, ফরহাদ মজহারকে ঢাকা থেকে যে দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে সেই রুটের কয়েকটি স্থান শনাক্ত করা হয়েছে। সর্বশেষ র্যাব খুলনার একটি এলাকা শনাক্ত করে স্থানটিতে অভিযান শুরু করে।
আমাদের খুলনা ব্যুরো জানায়, ফরহাদ মজহারের সন্ধানে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় খুলনার কেডিএ অ্যাপ্রোস রোডের শিববাড়ি এলাকায় অভিযান শুরু করে র্যাব-৬।
পরিবারের সংবাদ সম্মেলন : এ দিকে ফরহাদ মজহারের মুক্তি দাবি করে গতকাল রাত ১০টায় তার পরিবারের সদস্যরা এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ফরহাদ মজহারের বাসায়। সংবাদ সম্মেলনে তার স্ত্রী ফরিদা আখতার বলেন, ১৮ ঘণ্টা চলে গেলেও এখনো ফরহাদ মজহারের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি অসুস্থ উচ্চ রক্তচাপসহ কিছু অসুখের নিয়মিত ওষুধ খান। এখন তিনি কোথায় কিভাবে আছেন তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। তিনি জানান, পুলিশের কাছে তার অপহরণের পর থেকে সব তথ্য জানানো হয়েছে। এ পর্যন্ত তিনি ছয়বার ফোন করেছেন। প্রথম বারেই তিনি বলেছেন, তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং বলেছেন ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করছে বলে আমাদের জানানো হয়েছে। আমরা এ ব্যাপারে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করছি। ফরিদা আখতার বলেন, আমরা জানতে পেরেছি তার মোবাইল ফোন নজরদারি করে অনুসন্ধান করে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে, কিন্তু রাত হওয়ায় আমরা উদ্বিগ্ন।
সংবাদ সম্মেলনে ফরহাদ মজহারের মেয়ে সমতলী হক বলেন, আমি আমার বাবাকে ফেরত চাই। তিনি একজন লেখক, দার্শনিক। তার মতো একজন ব্যক্তি যখন অপহরণ হয় তখন তা দেশের মানুষের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি বলেন, ফরহাদ মজহারকে কেন অপহরণ করা হয়েছে সে সম্পর্কে আমরা কোনো অনুমান করে কথা বলতে চাই না। তিনি অপহৃত হয়েছেন তাকে আমরা ফিরে পেতে চাই। এ জন্য তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনী ও সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
সংবাদ সম্মেলনে ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে বলেন, বিষয়টি তিনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন। আশা করি, এ ব্যাপারে তিনি পদক্ষেপ নেবেন। ফরহাদ মজহার অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তাকে অপহরণ করা একটি ভুল কাজ।
খালেদা জিয়ার টুইট : কবি ও প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহারকে অবিলম্বে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গতকাল সোমবার রাতে দেয়া এক টুইট বার্তায় বলেন, ‘ফরহাদ মজহারকে এখনই তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে, অন্যথায় এর দায় সরকারকে নিতে হবে। এটি শাসকচক্রের আরেকটি নিষ্ঠুর কর্ম।’
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল : অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল বলেছে, বিশিষ্ট লেখক ফরহাদ মজহার কোথায় আছেন বিষয়টি শনাক্তকরণ এবং তাকে উদ্ধারে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশিষ্ট কলামিস্ট, কবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফরহাদ মজহারকে গতকাল আনুমানিক ভোর ৫টায় অজ্ঞাত কিছু লোক তার বাসার বাইরে থেকে অপহরণ করে।
এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন : এদিকে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি) এক বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল ভোরে ঢাকা থেকে কবি ও কলামিস্ট ফরহাদ মজহার অপহরণের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। সংস্থাটি জানায়, বাংলাদেশী এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষের উচিত নিখোঁজ বাংলাদেশী কবি ফরহাদ মজহার কোথায় আছেন বিষয়টি চিহ্নিত করা এবং তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।


http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/232851