৪ জুলাই ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:১৩

ব্যাংক মুনাফায় শুভঙ্করের ফাঁকি

পরিচালন মুনাফায় প্রকৃত তথ্য আসে না, এখানে ফাঁকি থাকে’

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফায় শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে বলে মনে করেন ব্যাংকিং খাতসংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, অধিকাংশ ব্যাংকই পরিচালন মুনাফা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে স্থগিত সুদ হিসাবকে আয় হিসাবে দেখানো এবং খেলাপি ঋণকে নিয়মিত ঋণ হিসাবে দেখিয়ে এ কাজ করেছে বলে মনে করেন তারা। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন যুগান্তরকে বলেন, পরিচালন মুনাফায় প্রকৃত তথ্য আসে না। এখানে কিছুটা শুভঙ্করের ফাঁকি থাকে। ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা হল নিট মুনাফা।


প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে সোনালী ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে ২৫০ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৩৫০ কোটি টাকা লোকসান। জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ যুগান্তরকে বলেন, গতবারের ৩৫০ কোটি লোকসান কাটিয়ে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ২৫০ কোটি পরিচালন মুনাফা করা হয়েছে। সে হিসাবে সোনালী ব্যাংক ৬০০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে বলে দাবি করেন তিনি। এছাড়া চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে অগ্রণী ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে ৩০১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১০৫ কোটি টাকা। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস উল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, অনেক পরিশ্রম করে গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় ২০০ কোটি টাকা বেশি পরিচালন মুনাফা করেছি। রূপালী ব্যাংকের এমডি আতাউর রহমান প্রধান যুগান্তরকে বলেন, এবার রূপালী ব্যাংক ২০২ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে, যা গেল বছরের একই সময়ে ছিল ৩২ কোটি টাকা। বেসিক ব্যাংক সূত্র জানায়, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বেসিক ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। তবে গত বছরের একই সময়ে ব্যাংকটি ৪৬ কোটি টাকা লোকসানে ছিল। এর বাইরে অন্যান্য সরকারি ব্যাংকেরও পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফায় শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের কারণ এসব ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। ব্যবসা পরিচালনা করতে পারছে না। সরকার ব্যাংকগুলোকে সাধারণ মানুষের করের টাকায় মূলধন জোগান দিচ্ছে। তাহলে কী করে তারা পরিচালন মুনাফা বাড়ায়? একই চিত্র বেসরকারি ৩৯টি ব্যাংকেও দেখা গেছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরকারি ব্যাংকগুলোকে বাজেট থেকে ২ হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বেসিক ব্যাংক একাই পেয়েছে ১ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া সোনালী ৩০০ কোটি, রূপালী ১০০ কোটি, কৃষি ব্যাংক ১৬৪ কোটি, বাংলাদেশ হাউসবিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন ১৫০ কোটি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক পেয়েছে ১০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় প্রকৃত চিত্র আসে না। এখানে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। নিট মুনাফায় ব্যাংকগুলো ঠিকই লোকসানে থাকবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ বিতরণ করতে পারছে না বললেই চলে। যার কারণে দিন দিনই বাড়ছে অলস টাকার পরিমাণ। এমন অবস্থায় ব্যাংকগুলো দৈনন্দিন ব্যয় মিটিয়ে মুনাফা করতে নতুন নতুন কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে।

বছরের ছয় মাস বা পুরো বছরের হিসাব শেষে ব্যাংকগুলো সংবাদমাধ্যমকে যে তথ্য সরবরাহ করে, সেটার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে পরে কাগজে-কলমে মিল থাকে না। আবার একই ব্যাংকের ভিন্ন ভিন্ন মুনাফার তথ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এতে মুনাফা নিয়ে পাঠক, শেয়ারহোল্ডার ও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কারণ ব্যাংকের মুনাফা দেখেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এজন্য সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এ ধরনের স্পর্শকাতর তথ্য সঠিক ও যাচাই-বাছাইয়ের পরই প্রকাশ করা উচিত। কিংবা এ ধরনের তথ্য প্রকাশে বাংলাদেশ ব্যাংকের করণীয় ঠিক করা উচিত।

কয়েকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা বলেন, বছরের প্রথম ছয় মাসে পরিকল্পনা অনুযায়ী ঋণ বিতরণ হয়নি। তবে অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রবণতা অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সহায়তা ও ব্যাংকগুলোর নিজস্ব কৌশলের কারণেই মূলত মুনাফা বেড়েছে।

পরিচালন মুনাফা ব্যাংকের নিট মুনাফা নয়। পরিচালন মুনাফা থেকে ঋণের বিপরীতে নির্ধারিত হারে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ এবং নির্ধারিত হারে কর্পোরেট কর (পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তদের ৪০ শতাংশ এবং তালিকাবহির্ভূতদের সাড়ে ৪২ শতাংশ) পরিশোধের পর ব্যাংকগুলোর নিট মুনাফার হিসাব হয়। নিট মুনাফার ওপর ভিত্তি করে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো লভ্যাংশ দিয়ে থাকে।

অবশ্য লভ্যাংশ ঘোষণার আগে নিট মুনাফা থেকে একটি অংশ বিধিবদ্ধ রিজার্ভ হিসেবে মূলধনে নিতে হয়। দেশের বেসরকারি ব্যাংকের অধিকাংশই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মধ্যে রূপালী ব্যাংক তালিকাভুক্ত। তালিকাভুক্ত

ব্যাংকের মুনাফা নিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারী ও সংশ্লিষ্টদের আগ্রহ বেশি।

http://www.jugantor.com/industry-trade/2017/07/04/136648/