৪ জুলাই ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:৫৯

চলতি মাসে দেশের বড় অংশে বন্যার পূর্বাভাস

এপ্রিলে হাওরাঞ্চলের সাত জেলায় ব্যাপক ফসলহানি, মে মাসে ঘূর্ণিঝড় মোরায় আটজনের প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, জুনে ভয়াবহ পাহাড়ধসে ১৫৪ জনের প্রাণহানির পর চলতি মাস জুলাইয়ে দেশের বড় অংশজুড়ে বন্যার পূর্বাভাস পাওয়া গেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সূত্র মতে, উত্তর-পূর্বাঞ্চল সিলেট-মৌলভীবাজারে বিদ্যমান বন্যার মধ্যেই দেশের উত্তরাঞ্চল এবং ধীরে ধীরে মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কিছু জেলায় বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। এরই মধ্যে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রে পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। আগামী তিন দিন যমুনার পানিও বৃদ্ধি পাবে। এ মাসের শেষের দিকে পানি বাড়বে পদ্মায়ও। তবে ধীরে ধীরে সিলেট অঞ্চলের সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি কমতে পারে।

প্রাপ্ত আবহাওয়া উপাত্ত, ঊর্ধ্বাকাশের আবহাওয়াবিন্যাস, বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তরের বিশ্লেষিত আবহাওয়া মানচিত্র, জলবায়ু মডেল, ক্লাইমেট সেন্টারের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এই পূর্বাভাস দিয়েছে সরকারের দুটি সংস্থা। এ ছাড়া আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, বন্যার পাশাপাশি চলতি মাসে বঙ্গোপসাগরে দুটি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে অন্তত একটি নিম্নচাপে রূপ নিতে পারে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য মতে, ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পানিতে এরই মধ্যে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলা সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জে বন্যা দেখা দিয়েছে। কুশিয়ারা নদীতে পানি বাড়ছে। এ ছাড়া দেশের উত্তরাঞ্চলে যমুনা নদীর পানিও বাড়ছে। আগামী ৭২ ঘণ্টায় যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। যমুনার পানি বাড়ার কারণে উত্তরের পাঁচ জেলা কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জে এ মাসে বন্যা হবে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে। ফলে জুলাইয়ের শেষের দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী অঞ্চলেও বন্যা শুরু হবে। মুন্সীগঞ্জ ও রাজবাড়ী জেলায় বন্যা দেখা দিতে পারে চলতি মাসের শেষের দিকে। তবে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হবে কি না তা এখনই বলার সময় হয়নি বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া অধিদপ্তর ও বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা।
জানতে চাইলে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘৩০ জুন থেকে যমুনা নদীতে পানি বাড়তে শুরু করেছে। সেটি এখনো অব্যাহত আছে। তাই আমরা বলছি, উজান থেকে নেমে আসা পানি ও ভারি বর্ষণের কারণে জুলাইয়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে বন্যা হবে। সাজ্জাদ হোসেন আরো বলেন, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জেও বন্যা দেখা দিয়েছে। তবে ধীরে ধীরে কুশিয়ারা ও সুরমা নদীর পানি কমার সম্ভাবনা আছে। আর পদ্মা নদীর পানি এখনো বিপত্সীমার অনেক নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মায় পানি বাড়ছে ধীরে ধীরে। এ মাসের শেষের দিকে পদ্মায় পানি বাড়ার কারণে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি মাসে সুরমা, কুশিয়ারা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকাসহ দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারি বর্ষণের সম্ভাবনা আছে। এ ছাড়া জুলাইয়ে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলায় বন্যার সম্ভাবনা রয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় রয়েছে। মৌসুমি বায়ুর অক্ষ রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত। মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকার কারণে গতকালের ধারাবাহিকতায় আজ মঙ্গলবারও ঢাকা, রংপুর, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের বেশির ভাগ হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত হবে। কোথাও কোথাও ভারি ও অতিভারি বর্ষণ হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
এদিকে ভারি বর্ষণের পাশাপাশি উজানের ঢলও আসতে শুরু করেছে বেশ কিছুদিন আগ থেকে। গত কয়েক দিনে সিলেট, মৌলভীবাজার, লালমনিরহাট ও শরীয়তপুরে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার কারণে পানিবন্দি হয়েছে অনেক পরিবার। বন্যার সঙ্গে ভাঙনও দেখা দিয়েছে হবিগঞ্জ, সিলেট ও মৌলভীবাজারে। উজান থেকে নেমে আসা পানিতে তিস্তার পানি বিপত্সীমার ওপরে উঠে প্লাবিত হয়েছে লালমনিরহাটের কয়েকটি গ্রাম।
প্রথমে হাওরাঞ্চলে আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢল, এরপর ঘূর্ণিঝড় মোরা, তারপর পাহাড়ধস এরপর বন্যা পরপর চারটি দুর্যোগকে কিভাবে দেখছেন, জানতে চাইলে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। দুর্যোগপ্রবণ দেশে এসব দুর্যোগ স্বাভাবিক ব্যাপার। গতবছরও দেশে বন্যা হয়েছে। পাহাড়ধস হয়েছে। আগাম বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু হয়েছে। এ বছরও দুর্যোগ হচ্ছে। তবে গতবারের সঙ্গে এবারের পার্থক্য হলো, এ বছর দুর্যোগের মাত্রাটা বেশি ছিল। একই সঙ্গে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি বেশি ছিল। আইনুন নিশাত বলেন, গত বছর হাওরাঞ্চলে আগাম বন্যা হয়েছিল। তবে গতবার ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা কম হয়েছে। এবার তো কৃষক একটি ধানও ওঠাতে পারেনি। গতবছর পাহাড়ধস হয়েছিল। কিন্তু প্রাণহানি এত হয়নি। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুতেও ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উজান থেকে নেমে আসা পানি ও বৃষ্টির পানিতে গত বছরও বন্যা হয়েছে। গত বছর দেশের ১৬ জেলায় বন্যা হয়েছিল। প্রতি বছরই জুলাই-আগস্ট মাসে ভারি বর্ষণের সঙ্গে পাহাড়ি ঢলে গড়ে দেশের বিভিন্ন জেলা প্লাবিত হয়। এ সময়ে স্বাভাবিক মৌসুমি বন্যা এমনিই হয়। তবে এবারের বন্যা দীর্ঘমেয়াদি হবে কি না সে বিষয়ে এখনই কথা বলার সময় হয়নি বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর ও বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/07/04/515145