৪ জুলাই ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:৫৮

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে জালিয়াতি!

টাকা জোগাড় করতে না পারায় চুক্তি সইয়ের ছয় বছরেও এগোয়নি ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইটালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেডের (ইটাল-থাই) দাবি, গত ২৯ ডিসেম্বর চীনের ইনভেস্টমেন্ট গ্গ্নোবাল ফাউন্ডেশনের সঙ্গে ঋণচুক্তি হয়েছে। বারবার তাগিদ দিলেও ছয় মাসেও চুক্তির সত্যায়িত কপি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে (বিবিএ) দেয়নি ইটাল-থাই। তাই ঋণচুক্তির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সন্দেহ করা হচ্ছে ইটাল-থাই কাজ ধরে রাখতে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজ ঠিকঠাক না করলেও প্রতিষ্ঠানটি সরকারের অগ্রাধিকার (ফাস্ট ট্র্যাক) প্রকল্প মেট্রো রেলের দুটি প্যাকেজের কাজ পেয়েছে, যা সমালোচনার সৃষ্টি করেছে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে আগামীকাল বুধবার বৈঠকে বসছে সেতু কর্তৃপক্ষ। ইটাল-থাইয়ের প্রেসিডেন্ট প্রেমচাই কামাসুতা এবং ফাস্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের (এফডিইই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মনচাই মুশিকাতুদকে বৈঠকে উপস্থিত থাকার জন্য চিঠি দিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ। গত ১৫ জানুয়ারি প্রকল্প পরিচালক কাজী মোহাম্মদ ফেরদৌস এ চিঠি দেন। চিঠিতে


আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, এসব দলিল এবং দ্রুত বিনিয়োগ না পাওয়া গেলে

প্রকল্প বাস্তবায়নে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

চিঠির সূত্রে জানা গেছে, ইটাল-থাই গত ২ জানুয়ারি সেতু কর্তৃপক্ষকে জানায়, চীনের ইনভেস্টমেন্ট গ্গ্নোবাল ফাউন্ডেশনের সঙ্গে ঋণচুক্তি হয়েছে। চীনা ভাষায় লেখা ওই ঋণচুক্তির দলিলও পাঠায় তারা। সেতু কর্তৃপক্ষ দলিলটি ইংরেজিতে অনুবাদসহ ঋণচুক্তির সত্যায়িত কপি পাঠানোর অনুরোধ জানায়। একই সঙ্গে ব্যাংকের ঋণ অনুমোদনের কাগজ, অ্যাকাউন্ট নম্বর, ঋণের কিস্তির পরিমাণ ও অন্যান্য দলিলের সত্যায়িত কপিও পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু ছয় মাসেও ইটাল-থাই এ অনুরোধে সাড়া দেয়নি।

গত এপ্রিলে কাজী মোহাম্মদ ফেরদৌস সমকালকে জানিয়েছিলেন, ঋণচুক্তির ইংরেজি কপি পাওয়ার পর চুক্তির বিস্তারিত দলিলের সত্যায়িত কপি চাওয়া হয়েছে। গত মাসে তিনি একই কথা জানান। তবে গত ১৫ জানুয়ারি পাঠানো চিঠির বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে দফায় দফায় চেষ্টা করেও ঋণচুক্তির বিষয়ে ইটাল-থাই কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। চার বার বিমানবন্দর এলাকায় স্থাপিত তাদের সাইট অফিসে গিয়ে কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলা যায়নি। গুলশানে এফডিইইর কার্যালয়ে গিয়েও কারও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। এফডিইইর এমডি মনচাই মুশিকাতুদকে টেলিফোনে বারবার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।

সেতু কর্তৃপক্ষের একজন প্রকৌশলী সমকালকে জানান, তাদের সন্দেহ ইটাল-থাই ঋণচুক্তি করতে পারেনি, অর্থাৎ প্রকল্পের টাকা জোগাড় করতে পারেনি। কারণ, তারা যদি চুক্তি করত, তাহলে বড় অঙ্কের টাকা প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে পারত। প্রকল্পের কাজও দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেত। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত গতিতে কাজ হচ্ছে না। ইটাল-থাইকে বাদ দিয়ে কাজ শেষ করার পথ খোঁজা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

বিদ্যমান রেললাইনের ওপর দিয়ে রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল সড়ক (এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে) নির্মাণে ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি ইটাল-থাইয়ের সঙ্গে চুক্তি করে সরকার। ওই বছরের ৩০ এপ্রিল প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৪ সালে। প্রকল্প সময়সীমার তিন বছর পরও মূল অবকাঠামো নির্মাণ অগ্রগতি মাত্র সাত ভাগ।

সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, উড়াল সড়ক নির্মাণে ইটাল-থাইয়ের সঙ্গে ৮ হাজার ৭০৩ কোটি টাকার চুক্তি হয়েছিল। নকশা পরিবর্তন ও মূল্যস্ফীতির কথা বলে প্রায় তিন বছর পর ব্যয় বাড়িয়ে পুনরায় ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকার চুক্তি করে সরকার। ২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর এ চুক্তি হয়। পিপিপির অধীনে প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ায় চুক্তি অনুসারে, মূল অবকাঠামো নির্মাণে ইটাল-থাইকে ৬ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। সরকার দেবে দুই হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। প্রকল্পের সময়সীমা ২০২০ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হলেও সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের মধ্যে বিমানবন্দর থেকে বনানী রেলস্টেশন পর্যন্ত সাত কিলোমিটার উড়াল সড়ক যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে।

উড়াল সড়ক প্রকল্পের সহযোগী হিসেবে সরকার 'সাপোর্ট টু এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে' নামে আরেকটি প্রকল্প নিয়েছে। যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের অধীনে জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা ও নানা কেনাকাটা রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রকল্প ব্যয় ১৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা।

চুক্তি অনুযায়ী, ইটাল-থাইকে ৬ হাজার ৫২৭ কোটি জোগান দিতে হবে। এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পর ২২ বছর টোল আদায় করে এ খরচ ও মুনাফা তুলে নেবে তারা। কিন্তু চুক্তি সইয়ের ছয় বছরেও টাকা জোগাড় করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৫ সালের আগস্টে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের উড়াল সড়কের মূল অবকাঠামো নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। গত এপ্রিলে তিনি একাধিক অনুষ্ঠানে বলেছেন, চীনা ঋণদাতার সঙ্গে চুক্তি করেছে ইটাল-থাই। শিগগির টাকা আসবে। কিন্তু গত এপ্রিল পর্যন্ত বিমানবন্দর থেকে খিলক্ষেত পর্যন্ত ৬৮৭টি পাইল, দুটি কলাম নির্মাণ এবং আটটি কলামের কিছু কাজ ছাড়া এ প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি নেই।

http://bangla.samakal.net/2017/07/04/305039