৩ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ১:০৩

সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে অর্থের উৎস জানাতে হবে

পরিবার ও পেনশনার সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমছে না; সুদের হার কমবে ৫ বছর ও ৩ মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের; দুই ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার হতে পারে ৭ থেকে ৮%

সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কঠিন করে দেয়া হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে আগামীতে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে হলে অর্থের উৎস জানাতে হবে। বর্তমানে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে এ ধরনের কোনো শর্ত নেই। শুধু তা-ই নয়, সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগে আর দু’টি পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এর একটি হচ্ছেÑ পরিবার সঞ্চয়পত্র ও পেনশনার সঞ্চয়পত্র। এ দুই ধরনের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সীমা বেঁধে দেয়া হবে। দুই. পরিবার ও পেনশনার সঞ্চয়পত্র ছাড়া বাজারে থাকা আরো দুই ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে দেয়া হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংক আমানতের চেয়ে সঞ্চয়পত্রে সুদের হার বেশি হওয়ায় বেশ কয়েক বছর ধরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ বেড়ে গেছে। গত এক বছর সঞ্চয়পত্র বিক্রি যে হারে বেড়েছে তা সরকারের পক্ষ থেকে ‘উদ্বেগজনক’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। যেমন সদ্য সমাপ্ত গত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) জুলাই-এপ্রিল পর্যন্ত সর্বমোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৬০ হাজার ৫১৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, যা কিনা বিগত অর্থবছরের (২০১৫-১৬) একই সময়ে চেয়ে ৪০ দশমিক ৩৯ ভাগ বেশি। এ সময় সরকারের সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ গ্রহণের পরিমাণ ছিল ৪২ হাজার ৯৯ কোটি টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে একই সময়ে (জুলাই-এপ্রিল) যা ছিল ২৬ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা। অন্য দিকে গত অর্থবছরে এ খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রাই ছিল ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। এ পরিস্থিতিতে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমাতে সরকারের পক্ষ থেকে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে। অর্থ বিভাগের এক অতিরিক্ত সচিব এটি প্রণয়ন করছেন। নীতিমালার খসড়াটি বর্তমানে প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ মাসের কোনো এক সময় তা অনুমোদনের জন্য অর্থমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, সঞ্চয়পত্র বিক্রি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সরকারের সুদের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। কারণ সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়া সবচেয়ে ব্যয়বহুল। এ ক্ষেত্রে সুদের হার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেয়া ঋণের চেয়ে অনেক বেশি। তাই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরুৎসায়িত করার জন্য আগামীতে বেশ কয়েকটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এর একটি হচ্ছেÑ এ খাতে বিনিয়োগ করতে হলে অর্থের উৎস প্রকাশ করতে হবে। কারণ মনে করা হচ্ছেÑ সঞ্চয়পত্রে কালো টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে। একে প্রতিরোধ করার জন্যই এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। একই সাথে পরিবার সঞ্চয়পত্র ও অবসরভোগীদের জন্য পেনশনার সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে সীমা আরোপ করা হবে। শুধু তা-ই নয়, বাজারে থাকা ৫ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্র ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হবে।
জানা গেছে, বর্তমানে ৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মেয়াদান্তে সুদের হার হচ্ছে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। এ মধ্যে প্রথম বছরে সুদ দেয়া হয় ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ, দ্বিতীয় বছরে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ, তৃতীয় বছরে ১০ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং চতুর্থ বছরে সুদের হার হচ্ছে ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
অন্য দিকে ৩ মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদের হার হচ্ছে মেয়াদান্তে ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। এই দুই সঞ্চয়পত্র এক নামে ৩০ লাখ ও যুগ্ম নামে ৬০ লাখ কেনা যায়। অন্য দিকে পরিবার সঞ্চয়পত্র একক নামে সর্বোচ্চ ৪৫ লাখ এবং পেনশনার সঞ্চয়পত্র একক নামে ৫০ লাখ টাকা কেনা যায়।
সূত্র জানায়, সামাজিক সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে আগামীতে পরিবার ও পেনশনার সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হবে না। তবে এই সুদের হার সর্বোচ্চ ৫০ লাখ পর্যন্ত বিনিয়োগে কার্যকর থাকবে। অর্থাৎ একক বা যুক্ত নামে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সুদের হারের কোনো পরিবর্তন হবে না। এর বেশি কেউ বিনিয়োগ করলেও ৫০ লাখ টাকার ওপরে বিনিয়োগকৃত সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ৫ বছর ও ৩ মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদের হারের অনুরূপ হবে। আগামীতে ৫ বছর ও ৩ মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে ৭ থেকে ৮ শতাংশ করা হবে।
অর্থমন্ত্রী গত ২৮ জুন অর্থবিল পাসের সময় জাতীয় সংসদে বলেছেন, মূলত ব্যাংক ব্যবস্থায় সুদের হার কমার কারণে সঞ্চয়পত্রের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ল্যমাত্রার চেয়ে সঞ্চয়পত্র হতে অধিক ঋণ গ্রহণ করতে হচ্ছে। ফলে সুদ বাবদ ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সরকারের ব্যয় ব্যবস্থাপনার ওপর একটি বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে। এ বাস্তবতার বিষয়টি আমি বিভিন্ন ফোরামে উত্থাপন করেছি। জাতীয় সঞ্চয়পত্রের সুদের হার নির্ধারণের কারণে কোনো পেনশনভোগী, নি¤œ মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত কেউ যাতে উল্লেখযোগ্যভাবে তিগ্রস্ত না হয় সে বিষয়টি আমাদের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে।
অর্থমন্ত্রী আরো বলেছেন, ‘সুদের হারের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে, মূল্যস্ফীতি বাড়লে সুদের হার বাড়ে আর মূল্যস্ফীতি কমলে সুদের হার কমে। বিষয়টি তাই আমাদের পুনর্বিবেচনা করতে হবে। তবে আমরা চাচ্ছি সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে যে সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে তা যেন সঠিক ব্যক্তিরা পায়। এ জন্য আমরা এর একটি পূর্ণাঙ্গ তথ্যভাণ্ডার তৈরি করব যেখানে ক্রেতার জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যের সাথে সঞ্চয়পত্রের তথ্যকে সম্পৃক্ত করা হবে।’
২০১৫ সালের ১০ মে বাজারে চালু সব ধরনের সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমিয়ে দেয়া হয়। বাজারে চালু ৫ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের সুদের হার রয়েছে ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ থেকে প্রায় দুই ভাগ কমিয়ে করা হয় ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ। তিন বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ। অন্যান্য সঞ্চয়পত্রের সুদের হারও দেড় শতাংশ কমানো হয়েছে।
আগে পাঁচ বছর মেয়াদি এক লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনলে মাসে এক হাজার ৭০ টাকা মুনাফা পাওয়া যেত। ২০১৫ সালে সুদ হার কমানোর পর এখন পাওয়া যাচ্ছে ৯১২ টাকা।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/232558