৩ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ১২:৫৮

টাকা পাচারে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে বিনিয়োগ থেকে

দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়ার দাবি বিশ্লেষকদের

দেশ থেকে প্রতি বছরই টাকা পাচার বাড়ছে। কিন্তু তা ফেরত আনার তেমন কোনোই উদ্যোগ নেই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। বরং একের পর এক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হচ্ছে বিভিন্ন দেশের সাথে। বলা হচ্ছে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে মাত্র ২১ কোটি টাকা ফেরত এসেছে এ পর্যন্ত। তাও আবার ২০০৬ সালের আগে পাচার হওয়া টাকা থেকে। এর পরে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদন অনুসারে ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আট বছরে প্রায় চার লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে দেশ থেকে। এর পর গত বৃহস্পতিবার সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে (সুইস ব্যাংক) এক বছরে বাংলাদেশী সঞ্চয় ১৯ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশীদের সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৬ কোটি ১৯ লাখ ফ্রাংক, যা স্থানীয় মুদ্রায় ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা (প্রতি সুইস ফ্রাংক ৮৫ টাকা হিসাবে)। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে তা ছিল ৪ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। এ হিসাবে এক বছরে বেড়েছে ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা।
বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, টাকা পাচার বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। এটা অব্যাহত থাকলে কাক্সিক্ষত হারে দেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধি হবে না। জনসংখ্যা বৃদ্ধির চেয়ে কাক্সিক্ষত হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। বাড়বে বেকারত্বের হার। দেশের চাহিদা পূরণে বিদেশের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যাবে, যা দেশের জন্য মোটেও সুখকর হবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
টাকা পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ পর্যন্ত প্রায় তিন ডজন দেশের সাথে চুক্তি করেছে। টাকা পাচারের তথ্য আদান প্রদান করার জন্যই মূলত এ চুক্তি করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। কিন্তু টাকা পাচার থেমে নেই, বরং বেড়েই চলছে। এ পর্যন্ত পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার বিষয়ে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।
শুধু ২০১২ ও ২০১৩ সালে তিন কিস্তিতে সিঙ্গাপুর থেকে পাচার হওয়া ২১ কোটি টাকা ফেরত আনা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে সিঙ্গাপুরের আদালতে আবেদন করে। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুদকের পক্ষে রায় আসে। এরই ভিত্তিতে এ টাকা ফেরত আসে।
দেশ থেকে টাকা পাচার বেড়ে যাওয়ার প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশ থেকে টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার অর্থই হলো দেশকে বঞ্চিত করা। কেননা যে টাকা পাচার হচ্ছে ওই টাকা দেশে বিনিয়োগ করলে কর্মসংস্থান বাড়ত। এসব বিনিয়োগ থেকে উৎপাদিত পণ্য দিয়ে বর্ধিত হারে দেশের চাহিদা মেটানো যেত। কিন্তু টাকা পাচার হয়ে যাওয়ায় এখন ওই হারে বিনিয়োগ হচ্ছে না। সৃষ্টি হচ্ছে না কর্মসংস্থানের। তিনি বলেন, এমনিতেই দেশের সম্পদের অপ্রতুলতা রয়েছে। বেড়ে যাচ্ছে বাজেট ঘাটতি। এ মুহূর্তে দেশ থেকে টাকা পাচার বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো দেশ বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
টাকা পাচার বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর মনে করেন, আস্থার সঙ্কট যখন দেখা দেয় তখন দেশে বিনিয়োগ করতে ভয় পান বিনিয়োগকারীরা। আর এ কারণেই তাদের মূলধন বিদেশে নিয়ে যান অনৈতিক পন্থায়। এ ছাড়া নানা দুর্নীতির মাধ্যমে যে অর্থ মানুষ আয় করছে তা নিরাপত্তার স্বার্থে দেশ থেকে পাচার করছে। পাচার ঠেকানোর জন্য, দুদকসহ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু তেমন কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। ফলে গত কয়েক বছরে দেশ থেকে টাকা পাচার বেড়ে যাওয়াও এটি একটি কারণ বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, এটা চলতে থাকলে দেশের সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করবে।
পাচারকৃত টাকা ফেরত আনা জটিল প্রক্রিয়া : বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা খুবই জটিল প্রক্রিয়া। মূলত দুই প্রক্রিয়ায় পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। প্রথমত, অর্থ পাচারের ব্যাপারে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেতে হবে। ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে দেশের আদালতে রাষ্ট্রপক্ষ মামলা করতে হবে। স্থানীয় আদালতের পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার পক্ষে রায় দিতে হবে। আদালতের এ রায়ের কপি অ্যাটার্নি জেনারেলের অফিস থেকে যে দেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে ওই দেশের অ্যাটার্নি জেনারেলের অফিসকে অবহিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট দেশের অ্যাটার্নি জেনারেল অফিস অর্থ ফেরত দেয়া যায় কি না তা ওই দেশের আদালতে মামলা করবে। সংশ্লিষ্ট দেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত দেয়ার ব্যাপারে আইনি জলিতা রয়েছে কি না তা যাচাই-বাছাই করবে। পাচারকৃত অর্থ ফেরত দেয়ার ব্যাপারে আইনি জটিলতা না থাকলে সংশ্লিষ্ট দেশের আদালত থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত দেয়ার বিষয়ে রায় প্রদান করবে। এর পরেই কেবল পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সবকিছু অনুকূলে থাকলে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে অর্থ ফেরত আনতে ৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। সুতরাং পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে কথাবার্তা বলা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা ছাড়া বৈ অন্য কিছু নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা।
দ্বিতীয়ত, মামলা করা ছাড়াও পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা যায়, যদি সংশ্লিষ্ট দেশের আইনি কোনো জটিলতা না থাকে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশকে আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন সংস্থা এগমন্ড গ্রুপের সদস্য হতে হবে। যেমন বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র এগমন্ড গ্রুপের সদস্য। এ ক্ষেত্রে এক দেশের অ্যাটার্নি জেনারেলের অফিসকে অন্য দেশের অ্যাটার্নি জেনারেলের অফিসকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পাসপোর্ট নম্বরসহ সুনির্দিষ্ট তথ্য সরবরাহ করতে হবে। ওই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির তথ্য যাচাই-বাছাই করবে। যাচাই-বাছাইয়ে তথ্য গড়মিল না পেলে কেবল পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা সম্ভব। তবে এ প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করতে কয়েক বছর লেগে যাবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/232526