বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া কুলাউড়া-বড়লেখা সড়ক। গতকালের ছবি : নয়া দিগন্ত
৩ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ১২:৫৭

সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি

৬ উপজেলায় লক্ষাধিক লোক পানিবন্দী পর্যাপ্ত ত্রাণ নেই

অব্যাহত ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সিলেটের ছয়টি উপজেলায় লক্ষাধিক লোক পানিবন্দী হয়েছেন। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও বাজার। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন সিলেটের ছয় উপজেলার লাধিক মানুষ। কোনো কোনো স্থানে বন্যার্তদের জন্য নামমাত্র ত্রাণ পৌঁছলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে দাবি করছেন ভুক্তভোগীরা। তবে বন্যাকবলিত বেশির ভাগ এলাকায়ই এখনো ত্রাণ পৌঁছায়নি।
সিলেট জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, উজানে ভারতের মেঘালয় পাহাড়ে টানা বর্ষণে সিলেটের কুশিয়ারা ও সুরমা নদীর পানি বাড়তে থাকে। বর্তমানে দু’টি নদীর সব ক’টি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে কুশিয়ারা নদীর পানি ঢুকে জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, গোলাপগঞ্জ ও জকিগঞ্জ উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। উজানে টানা বর্ষণ হওয়ায় বন্যাপরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে এগোচ্ছে।
সরেজমিনে ফেঞ্চুগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বেশির ভাগ বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, হাট-বাজার, শিাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দিরসহ বিভিন্ন স্থান পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যায় শত শত মাছের খামার পানিতে ভেসে গেছে। বন্যাপরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় নৌকা কিংবা কলার ভেলা বাহন হয়ে উঠেছে। বন্যায় উপজেলার প্রায় সব সড়কে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পানিবন্দী এসব মানুষ জানান, আমাদের দুর্ভোগের শেষ নেই। সন্তানদের নিয়ে কিভাবে খাবো আর দিন কাটাবো তা কিছুই বুঝতে পারছি না। হাকালুকি হাওর সংলগ্ন ঘিলাছড়ার কয়েকজন এলাকাবাসী জানান, আমাদের খামারের মাছ বন্যায় ভেসে গেছে। এর আগে পানিতে ফসল গেছে। আমাদের ক্ষতির ওপরে ক্ষতি। ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ব্রিজের নিচ থেকে বাজারের রাস্তায় পানি থাকায় তাদের ব্যবসাবাণিজ্য স্থবির। রাস্তা ভাঙা থাকায় আরো দুর্ভোগ আরো বেশি।
এ দিকে গত শনিবার বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার বন্যাপ্লাবিত গ্রাম পরিদর্শন করেছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মো: রাহাত আনোয়ার। তিনি গণমাধ্যমকে জানান, নদী তীরবর্তী এলাকার গ্রামগুলো প্লাবিত হয়েছে বেশি। বন্যার্তদের সহায়তায় তাৎণিকভাবে জেলা প্রশাসনের প থেকে ১২৭ মেট্রিক টন চাল ও ২ লাখ ৭৭ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। প্রয়োজনে এ সহায়তা আরো বাড়ানো হবে।
ফেঞ্চুগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম মুরাদ জানান, তার ইউনিয়নের বন্যার্তদের জন্য দুইটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রের বন্যার্তদের মাঝে কিছু ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয় বলে দাবি করেন তিনি।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শহীদুল ইসলাম চৌধুরী জানান, সিলেটের ১৩টি উপজেলার মধ্যে ছয়টি উপজেলা বন্যাকবলিত। জেলা প্রশাসনের প থেকে ইতোমধ্যে বন্যার্তদের জন্য ১২৮ মেট্রিক টন চাল ও প্রায় ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসনের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুদ রয়েছে। বন্যার্তদের জন্য যে পরিমাণ ত্রাণ প্রয়োজন সে পরিমাণ ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হবে। তিনি জানান, ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যে টানা বৃষ্টির কারণে বরাক নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় বরাকের শাখা নদী সুরমা ও কুশিয়ারার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর ও গোয়াইনঘাট উপজেলার অর্ধশতাধিক গ্রাম তিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান তিনি।
গোলাপগঞ্জ উপজেলার অর্ধশত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। রোজা ও ঈদের দীর্ঘ ছুটির শেষে গতকাল রোববার এসব বিদ্যালয়ের শিকেরা উপস্থিত হলেও শিার্থীরা বন্যার কারণে উপস্থিত হতে পারেননি। উপজেলার বেশির ভাগ বিদ্যালয়ের শ্রেণিক হাঁটু পানিতে নিমজ্জিত। বাদেপাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক জানান, বিদ্যালয়েও মাঠে ও শ্রেণিকে পানি থাকায় শিশুরা বিদ্যালয়ে আসতে চায় না। এ ছাড়া বিদ্যালয়গুলোর বাথরুম ও টিউবওয়েল পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে। মীরগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এসএমসির সদস্য মঈন উদ্দিন জানান বন্যার কারণে বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।
তিস্তায় পানি বৃদ্ধি, পানিবন্দী ১০ হাজার পরিবার
লালমনিরহাট সংবাদদাতা জানান, গতকাল থেকে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তা, ধরলা, বুড়িতিস্তা ও সানিয়াজান নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলাসহ জেলার তিস্তা নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলোতে বন্যা দেখা দিয়েছে। তিস্তার পানিতে প্রায় ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। শনিবার সকাল থেকে নদীগুলোর পানি বাড়তে শুরু করে। হাতীবান্ধা উপজেলার ধুবনী গ্রামে শনিবার সকালে দুইটি স্থানে বাঁধ ভেঙে গেছে। এ উপজেলায় অবস্থিত দেশের বৃহত্তর সেচপ্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের দোয়ানী পয়েন্টে শনিবার দুপুরে বিপদ সীমার ১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে।
পাউবো সূত্র জানায়, তিস্তা পাড়ের লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ভারত গজলডোবা ব্যারাজের অধিকাংশ গেট খুলে দেয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যাচ্ছে। প্রচণ্ড গতিতে পানি বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে। আরো কী পরিমাণ পানি আসবে তা ধারণা করা যাচ্ছে না। পানির গতি নিয়ন্ত্রণ করতে তিস্তা ব্যারাজের সবকয়টি গেট খুলে দেয়া হয়েছে। ফলে তিস্তার পানিতে পাটগ্রামের বহুল আলোচিত আঙ্গরপোতা-দহগ্রাম, হাতীবান্ধার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিঙ্গিমারী, সিন্দুর্না, পাটিকাপাড়া ও ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়ন, আদিতমারী ও সদর উপজেলার নদীসংলগ্ন চর এলাকার ১৮ গ্রামের প্রায় ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। কয়েক হাজার একর আমন ধানের বীজতলাসহ অনেক ফসলি তে তিস্তার পানিতে ডুবে গেছে।
হাতীবান্ধা উপজেলার সিঙ্গিমারী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন দুলু জানান, ইতোমধ্যে চর এলাকাগুলোর যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে গেছে। দক্ষিণ ধুবনী গ্রামে বাঁধের দুইটি স্থান ভেঙে গেছে। ফলে ওই এলাকায় বেশ কিছু পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
ঝালকাঠির নি¤œাঞ্চল প্লাবিত
ঝালকাঠি সংবাদদাতা জানান, উজান থেকে নেমে আসা ঢলে ঝলকাঠিতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। গতকাল রোববার সকাল থেকে তলিয়ে গেছে শহর ও নি¤œাঞ্চলের ২০টি গ্রাম। পানি বৃদ্ধির সাথে দুই দিন ধরে টানা বৃষ্টিতে শহরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ জানায়, সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে দুই-তিন ফুট বৃদ্ধি পেয়ে শহর ও গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। স্লুইস গেট অতিক্রম করে পানি ঢুকে পড়েছে গ্রামাঞ্চলের পথে-ঘাটে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ঝালকাঠি সদর, নলছিটি, রাজাপুর ও কাঁঠালিয়া উপজেলার ২০টি গ্রামের বাসিন্দারা। পানি বৃদ্ধিতে নদী তীরবর্তী বাসিন্দাদের ফসলের ক্ষেত তলিয়ে গেছে।
১৭৪টি শিাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ ঘোষণা
সিলেট ব্যুরো জানায়, কয়েক দিনের অব্যাহত ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যার পরিস্থিতি অবনতির ফলে সিলেটে ছয়টি উপজেলার ১৭৪টি শিাপ্রতিষ্ঠানকে অনির্দিষ্টকালের জন্য পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করেছেন জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার।
গতকাল রোববার দুপুরে বন্যাপরিস্থিতি মোকাবেলায় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ডাকা জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্তের কথা জানান তিনি। রাহাত আনোয়ার জানান, পাহাড়ি ঢলে সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি বেড়ে জেলার জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, ওসমানীনগর ও বালাগঞ্জ উপজেলার সার্বিক বন্যাপরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিনি জানান, বিদ্যালয়ে পানি উঠে যাওয়ায় এসব এলাকার ১৬১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১৩টি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া বন্যাকবলিত এলাকায় মেডিক্যাল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, মন্ত্রণালয় থেকে বন্যাকবলিত এলাকায় সব ধরনের সুযোগসুবিধা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। পাশাপাশি ত্রাণসামগ্রী ইতোমধ্যে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এসব এলাকায় ছয়টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ৮৯টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সিলেটের বিভিন্ন উপজেলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা।


http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/232550