৩ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ১২:৫০

শুরুতেই বড় ঝুঁকিতে বাজেট

এডিপি, রাজস্ব আয় কাটছাঁট হবে : বাড়তে পারে ব্যাংক ঋণনির্ভরতা

শুরুতেই বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে চলতি (২০১৭-১৮) অর্থবছরের বাজেট। শেষ মুহূর্তে ভ্যাট আইন কার্যকর থেকে সরে আসায় এই ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ভ্যাট থেকে অর্থের জোগান অনেক কমে আসার সঙ্গে বিশাল অঙ্কের ব্যয়ে কাটছাঁট না করায় আয়-ব্যয়ের ভারসাম্যহীনতা আরও বৃদ্ধি পাবে। শেষ সময়ে ভ্যাটের ধাক্কায় বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ আরও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে বড় ধরনের চাপের মুখে পড়তে যাচ্ছে রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়া। বর্তমান সরকারের আমলে এর আগে ৮টি বাজেট দেয়া হলেও এমন অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হল এই প্রথম। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে সরকারের ভেতরেও। সংশ্লিষ্টরা বলছে, বাজেট বাস্তবায়ন ঝুঁকিতে পড়ায় করদাতাদের ওপর খড়গ নেমে আসার সঙ্গে উন্নয়ন বাজেটেও বড় ধরনের কাটছাঁট হতে পারে। বিদ্যমান বাস্তবতায় এরই মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিজ নিজ অবস্থান থেকে নতুন করে হিসাব মেলানোর কাজে নেমে পড়েছেন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে শেষ মুহূর্তে সরকারের পিছু হটার বিষয়টি বাজেটের বিশ্বাসযোগ্যতাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। আইনটি বাস্তবায়ন হলে ভ্যাট ছাড়াও আয়কর আদায়ে গতি বাড়ত। যদিও জনগণের ওপর করের বোঝা বাড়িয়ে রাজস্ব আদায়ে উল্লম্ফন হবে এমন আশার কথা বলেছিলেন এনবিআরের নীতিনির্ধারকরা। এ হিসাব মাথায় নিয়েই অর্থমন্ত্রী আয়-ব্যয়ের প্রাক্কলন করেন। ব্যাপক সমালোচনার মুখে শেষ মুহূর্তে সেখান থেকে হঠাৎ সরে আসায় রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের হোঁচট খাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়েছে। আনুপাতিক হারে ব্যয় না কমালে বাজেট ঘাটতিও আশঙ্কাজনকভাবে বাড়বে। ভ্যাট আইন স্থগিত করলেও বাজেট বাস্তবায়নে ঘাটতির এ বাড়তি অর্থ কোথা থেকে আসবে তা স্পষ্ট করেননি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, নতুন বাজেট বাস্তবায়নই হবে একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ ব্যয়ের আকার ঠিক রেখে আয় কমানো হয়েছে। তিনি বলেন, ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না করা, ব্যাংকের আবগারি শুল্ক ও চাল আমদানিতে শুল্ক কমানো হয়েছে। কিন্তু এসব খাতে আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল পরবর্তী সময়ে কোন খাত থেকে তা সমন্বয় করা হবে বাজেটে তা পরিষ্কার করা হয়নি।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ যুগান্তরকে বলেন, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না হওয়ায় রাজস্ব আদায়ে সামান্য বিশৃঙ্খলা হতে পারে, এটা স্বাভাবিক। ভ্যাট খাত থেকে যে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল, তা আদায় কিছুটা কমবে। যার প্রভাব পড়বে বাজেট ব্যবস্থাপনায়। এ জন্য ব্যয়ের সমন্বয় দরকার। এতে উন্নয়ন বাজেট কাটছাঁট করতে হবে। তা না করলে ব্যাংক ব্যবস্থা বা অন্য উৎস থেকে ঋণ নিয়ে বাজেট বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি বলেন, পুরনো ভ্যাট আইনেও রাজস্ব আদায় সম্ভব। এ জন্য এনবিআরকে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করার পরামর্শ দেন তিনি।
নতুন বাজেট প্রণয়নের শুরুতে ৩৩ শতাংশ রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়। ভ্যাট খাত থেকেই ৯১ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য স্থির করা হয়, যা গত অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা বেশি। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না হওয়ায় অর্থ সংকটের মুখে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। অপরদিকে রয়েছে বিশাল অংকের ব্যয়। ভারসাম্যহীন এ বাজেট বাস্তবায়নে কয়েকটি কৌশল হতে নিতে যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে উন্নয়ন ব্যয় (এডিপি) কাটছাঁট, ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র খাত থেকে বেশি মাত্রায় ঋণ সংগ্রহ, রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা কমানো এবং করের আওতা বৃদ্ধি।
চলতি বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ১ লাখ ৬ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা। কিন্তু ভ্যাট থেকে আয় কমে গেলে শেষ পর্যন্ত ঘাটতির পরিমাণ অস্বাভাবিক বৃদ্ধির শঙ্কা রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক রয়েছে। কিন্তু কমছে আয়। এতে বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ২৮ হাজার ২০৩ কোটি টাকা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা বাড়তে পারে। ব্যাংক ঋণ নিয়েই ভ্যাট খাতের ঘাটতি সমন্বয়ের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে এটিই পূর্ণাঙ্গ বাজেট। ফলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাধ্যমে সরকার এ বছর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। দৃশ্যমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমে এক ধরনের ভোট টানার চেষ্টার পরিকল্পনা করেই এ বছর বড় ধরনের এডিপি ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু পুরো উন্নয়নের হিসাব শেষ সময়ে এসে পাল্টে যায়। এখন ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকার এডিপি কাটছাঁটের মাধ্যমে সরকার ব্যয় কমানোর পথে হাঁটার চিন্তা করছে। যদিও সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের এডিপির আকার ছোট করা হয়নি। কিন্তু চলতি বাজেটে এডিপি ঠিক রাখা কঠিন হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চলতি অর্থবছরে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা খরচ করা হবে। বাজেটের ব্যয় মেটাতে ভ্যাট, ট্যাক্স বাবদ আদায় করা হবে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে আয় ও মুনাফার ওপর কর আরোপ করে আদায় করা হবে ৮৫ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) থেকে ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এছাড়া বৈদেশিক ব্যবসা-বাণিজ্য, বিশেষ করে আমদানি শুল্ক থেকে ৩০ হাজার ২৩ কোটি টাকা এবং রফতানি থেকে ৪৪ কোটি টাকা আয় নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি আবগারি শুল্ক থেকে ১ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা, সম্পূরক শুল্ক থেকে ৩৮ হাজার ৪০১ কোটি টাকা এবং অন্যান্য কর ও শুল্ক থেকে আয়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয় ১ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। এছাড়া এনবিআরবহির্ভূত ও কর ছাড়া প্রাপ্তির মাধ্যমে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা হবে।
কিন্তু ভ্যাট থেকে আদায় কমে যাওয়ার শঙ্কায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণে পুরো রাজস্ব আয়ের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে। এই চাপ করদাতাদের ওপর শেষ পর্যন্ত পড়বে। করদাতারাই হবেন বাড়তি টাকা আদায়ের টার্গেট।
জানা গেছে, ভ্যাটদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি, শপিংমলে ইসিআর স্থাপন, ভ্যাটের মামলা নিষ্পত্তি, এডিআর শক্তিশালী, বকেয়া ভ্যাট আদায়, ফাঁকি বন্ধে অডিট ব্যবস্থাপনা, মাঝারি ও বড় প্রতিষ্ঠান প্যাকেজ পদ্ধতিতে ভ্যাট পরিশোধ ও গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদার করার কৌশল নেয়া হচ্ছে।
ইতিমধ্যেই রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বণ্টন করে দেয়া হয়েছে প্রতিটি ভ্যাট কমিশনারেটকে। ভ্যাট প্রদানযোগ্য অথচ ভ্যাটের আওতায় নেই এমন সব প্রতিষ্ঠান শনাক্ত করবেন তারা। বর্তমানে ৮ লাখ নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে দাখিলপত্র জমা দিচ্ছে ৩২ হাজার প্রতিষ্ঠান। এই সংখ্যা আগামীতে ৭০ হাজারে উন্নীত করার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। এছাড়া ভ্যাট খাত থেকে আয় বাড়াতে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে সাড়ে আট লাখ নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানে তদারকি বাড়ানো হচ্ছে। অন্যদিকে নতুন ভ্যাট আইনে যেসব পণ্য ও সেবা খাতকে ভ্যাটমুক্ত ঘোষণা দেয়া হয়েছিল সেগুলোর আদেশ বাতিল করা হয়েছে। ফলে ৫৩৬টি পণ্য ও সেবা ছাড়া উল্লিখিত সব পণ্য ও সেবা ভ্যাটের আওতায় থাকবে।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/07/03/136243/