ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদরের সড়ক ও কুশিয়ারা নদী বন্যার পানিতে একাকার। পাশাপাশি চলছে নৌকা ও গাড়ি -যুগান্তর
৩ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ১২:৪৯

পাঁচ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

মৌলভীবাজার ও সিলেটে বন্ধ ৩৪২ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

রংপুর, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামে তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপরে * ত্রাণের জন্য পানিবন্দি মানুষের হাহাকার * দুর্গত এলাকায় শিক্ষামন্ত্রী ও আ’লীগ প্রতিনিধি দল

সিলেট, মৌলভীবাজার, রংপুর, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পানি ঢুকে পড়ায় সিলেট ও মৌলভীবাজারে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ৩৪২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এতে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। রোববার সিলেটে বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। অন্যদিকে হাকালুকি হাওরপারের বন্যাকবলিত কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা এলাকা পরিদর্শন শেষে ত্রাণ বিতরণ করেছে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল। তবে বানভাসি মানুষের অভিযোগ, সরকারি-বেসরকারি পর্যাপ্ত ত্রাণ নেই। খাবারের অভাবে পানিবন্দি লোকজনের মাঝে হাহাকার দেখা দিয়েছে।


এদিকে রংপুর, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামে তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নদী তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। যুগান্তর ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

সিলেট : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে স্কুল-কলেজ, ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট ও হাট-বাজার। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ৬ উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ। এসব উপজেলায় রোববার পর্যন্ত ১৭৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬১টি প্রাথমিক ও ১৩টি মাধ্যমিক স্কুল রয়েছে। রোববার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির এক সভায় জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার এসব তথ্য জানান। তিনি জানান, বন্যাকবলিত মানুষের জন্য ৬ উপজেলায় ৯টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয় কেন্দে ৮৯টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।

জেলা প্রশাসক জানান, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে বন্যার্তদের জন্য ১২৮ মেট্রিক টন চাল ও নগদ প্রায় ২ লাখ ৭৭ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, উজানে ভারতের মেঘালয় পাহাড়ে টানা বর্ষণে সিলেটের কুশিয়ারা ও সুরমা নদীর পানি বাড়তে থাকে। বর্তমানে দুটি নদীর সব ক’টি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে কুশিয়ারা নদীর পানি ঢুকে জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, গোলাপগঞ্জ ও জকিগঞ্জ উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে।

ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদরের বেশিরভাগ জায়গা পানিতে তলিয়ে গেছে। ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারে চলাচল করছে নৌকা। ব্যবসায়ীরা মাচা বেঁধে দোকানের ভেতর মালপত্র রেখেছেন। ভুক্তভোগীরা জানান, প্রায় ২০ দিন ধরে তাদের দোকানে পানি জমে আছে।

বিয়ানীবাজার উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, উপজেলার ১৫৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ১৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভেতরে পানি প্রবেশ করেছে। এছাড়া বিদ্যালয়ে যাতায়াত সড়ক ও মাঠ তলিয়ে গেছে আরও ২৭টির। যার কারণে ৪০টি বিদ্যালয় সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে সেগুলোতে বন্যার কারণে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম রয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মু. আসাদুজ্জামান বলেন, দুর্গত এলাকায় শনিবার থেকে ত্রাণ বিতরণ শুরু হয়েছে।

জকিগঞ্জের বিভিন্ন ইউনিয়নে অকাল বন্যার কারণে মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বিরশ্রী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের মানুষও পানিবন্দি। উপজেলার কাজী আবদুল খালিক উচ্চ বিদ্যালয়সহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্যার পানির কারণে ক্লাস নেয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। শ্রেণীকক্ষে পানি ঢুকে বিদ্যালয় প্লাবিত হয়েছে। জকিগঞ্জের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে আগামী বৃহস্পতিবার থেকে অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা শুরু হবে। কিন্তু বন্যার মাঝে পরীক্ষা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন অনেক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।

গোলাপগঞ্জে শিক্ষামন্ত্রী : শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বন্যাকবলিত লোকদের উদ্দেশে বলেছেন, আপনারা ধৈর্য সহকারে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা করুন। ধৈর্যহারা হলে চলবে না। অতীতেও যে কোনো পরিস্থিতি আপনারা ধৈর্য সহকারে মোকাবেলা করেছেন, এবারও করবেন। আমরা আপনাদের দুর্যোগে পাশে আছি, থাকব। রোববার দুপুরে সিলেটের গোলাপগঞ্জের বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন শেষে বিভিন্ন স্থানে সংক্ষিপ্ত পথসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ শফিকুর রহমান এমপি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিক আহমদ, পৌর মেয়র সিরাজুল জব্বার চৌধুরী প্রমুখ। মন্ত্রী বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের মধ্যে ১৮ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বরাদ্দের ঘোষণা দেন।

হাকালুকি পাড়ের শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ : কুলাউড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতিতে কুলাউড়া উপজেলার ৫২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। বড়লেখা উপজেলার ৮৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্যার কারণে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৮টি প্রাইমারি স্কুল, ১৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২টি কলেজ ও ২টি মাদ্রাসা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান ১০ জুলাই পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জুড়ী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার রাজন কুমার সাহা জানান, তার উপজেলায় ২৮ প্রাইমারি স্কুল বন্যার কারণে বন্ধ রয়েছে। এ নিয়ে মৌলভীবাজারের তিন উপজেলায় ১৬৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অকাল বন্যার কারণে বন্ধ রয়েছে।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার সমীর কান্তি দেব জানান, ঈদের ছুটি শেষ হলেও ১৫-২০ দিন ধরে ভারি বর্ষণে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। এতে হাওরপারের ২০টি প্রতিষ্ঠান তলিয়ে গেছে।

প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার জালাল উদ্দিন জানান, উপজেলার ৬৮ প্রাইমারি স্কুলে বন্যার পানি ঢুকেছে। এর মধ্যে ১৫টি স্কুলের শ্রেণীকক্ষ ও অফিস কক্ষে ৫-৭ ফুট, ৫৩টি স্কুলের রাস্তা, মাঠ ও শ্রেণীকক্ষ ৩-৪ ফুট পানির নিচে।

কুলাউড়ায় গম নিয়ে বিড়ম্বনায় বানভাসি মানুষ : ত্রাণ হিসেবে বানভাসি মানুষের মাঝে চালের পরিবর্তে গম দেয়া হচ্ছে। এই গম নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছেন বানভাসি মানুষ। থৈথৈ পানি, গম শুকানোর মতো জায়গা কিংবা রোদ কোনোটাই নেই। না পারছেন ফেলতে, না খেতে। উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, কুলাউড়া উপজেলার বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য সর্বশেষ ত্রাণ হিসেবে বরাদ্দ এসেছে ৬৯ মেট্রিক টন গম। উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় দুর্গত মানুষের মধ্যে এই গম বিতরণ করা হয়। গম শুকানো ও ভাঙানো বাড়তি ঝামেলা বলে স্বীকার করেছেন ভকুশিমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আজিজুর রহমান মনির।

বন্যাকবলিত এলাকায় আ’লীগ প্রতিনিধি দল : হাকালুকি হাওরপারের বন্যাকবলিত কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা এলাকা পরিদর্শন শেষে ত্রাণ বিতরণ করেছে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল। রোববার দুপুরে হাওর তীরের জয়চন্ডী ইউনিয়নের পুশাইনগর চৌমোহনী চত্বরে ত্রাণ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন প্রতিনিধি দলের প্রধান ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন।

স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আবদুল মতিনের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম রেনুর পরিচালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, সাবেক চিফ হুইপ ও মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন।

বড়লেখায় পানিবন্দি মানুষের হাহাকার : হাকালুকি হাওরপারের হাজার হাজার দুর্গত মানুষের মধ্যে হাহাকার চলছে। ঘরে খাবার নেই, নেই থাকার জায়গা। নৌকা দেখলেই ঘরের হাঁটুপানি ডিঙিয়ে আঙিনায় বেরিয়ে পড়ছেন অসহায় নারী-পুরুষ ও শিশুরা- এই বুঝি কেউ ত্রাণ নিয়ে আসছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ অপ্রতুল বলে অভিযোগ উঠেছে। রোববার জাতীয় সংসদের হুইপ শাহাব উদ্দিন এমপি সুজানগরে দুর্গতদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন। এ সময় বানভাসি মানুষ হুমড়ি খেয়ে জড়ো হলেও পরিমাণ কম থাকায় সবাই ত্রাণ পায়নি।

রংপুর : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অব্যাহত বৃষ্টিতে শুক্রবার রাত থেকে রোববার সকাল পর্যন্ত রংপুরের গঙ্গাচড়ায় তিস্তার পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। রোববার সকাল ৮টা থেকে তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে উপজেলার নোহালী, আলমবিদিতর, কোলকোন্দ, লক্ষ্মীটারী, গজঘণ্টা ও মর্ণেয়া ইউনিয়নের প্রায় ৩ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তিস্তাপারের মানুষ।

এদিকে পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আলমবিদিতর ইউনিয়নের পাইকান দোলাপাড়া, হাজীপাড়া ও কোলকোন্দ ইউনিয়নের সাউদপাড়া এলাকায় নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। আলমবিদিতর ইউপি চেয়ারম্যান আফতাবুজ্জামান জানান, এক সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকান দোলাপাড়ায় ১০টি পরিবার নদী ভাঙনের শিকার হয়ে তাদের ঘরবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে।

ডিমলা (নীলফামারী) : রোববার সকাল ৬টা থেকে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার (৫২ দশমিক ৪০ মিটার) ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।

কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামের ১৬টি নদ-নদীতে পানি বাড়ছে। এতে নদী ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। সরকারি হিসাবে জুন মাসে ৫০টি পরিবার গৃহহীন হয়েছে এবং ৪৯টি দোকান ঘর নদীতে বিলীন হয়েছে। পানি বাড়ার কারণে জেলার সাড়ে চার শতাধিক চরাঞ্চলের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/07/03/136240/