৩ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ১২:৪৫

বাড়ছে অযৌক্তিক ব্যয়ের প্রবণতা

দুর্নীতি ও অনিয়মই লক্ষ্য * অপচয় ও লাগামহীন ব্যয়ের বহিঃপ্রকাশ -ড. শামসুল আলম

নির্বাচিত বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ বা উন্নয়ন প্রকল্পে চারটি জিপ, একটি মাইক্রোবাস এবং ৮০টি মোটরসাইকেল কেনার প্রস্তাব করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ প্রস্তাবে আপত্তি জানায় পরিকল্পনা কমিশন। এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় একটি জিপ, একটি মাইক্রোবাস ও ২০টি মোটরসাইকেল কেনার সিদ্ধান্ত হয়। ফলে সরকারের কয়েক কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। সৌর প্যানেল মূল্য ধরা হয়েছে ৫ লাখ টাকা। এটি প্রচলিত বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি বলে মনে করে পরিকল্পনা কমিশন। এক্ষেত্রে ব্যয় কমাতে বলা হয়েছে। এছাড়া চামড়া শিল্পনগরী ঢাকা শীর্ষক প্রকল্প, যমুনা নদীর ভাঙন থেকে সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার খুদবান্দি, সিংড়াবাড়ী ও শুভগাছা এলাকা সংরক্ষণ প্রকল্প এবং পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়ায় আনুষঙ্গিক সুবিধাদিসহ নদীবন্দর আধুনিকায়নসহ বিভিন্ন প্রকল্পেও একই প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। দুর্নীতির উদ্দেশ্যেই শুরুতে অযৌক্তিকভাবে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে দেয়া হয়। কমিশন কাটছাঁটের পর যা বরাদ্দ দেয়া হয় তা-ও প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি। এ অতিরিক্ত অর্থ বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগবাটোয়ারা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।


এর আগে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি বলেছে, বাংলাদেশে অবকাঠামো নির্মাণ সংক্রান্ত প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ অত্যন্ত বেশি। বিশ্বে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে প্রতি কিলোমিটার রাস্তা তৈরিতে অনেক বেশি ব্যয় হয়। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ভারত, চীন, এবং ইউরোপের তুলনায় বাংলাদেশে চার লেন হাইওয়ে নির্মানে বেশি খরচ হয়। সাধারণত ভূমির অবস্থা এবং প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও দুর্নীতির কারণে এমনটি হয়ে থাকে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা মনে করেন, উন্নয়ন প্রকল্পে অযৌক্তিক ও অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রবণতা বেড়েছে। বিভিন্ন খাতের অহেতুক খরচসহ প্রকল্পের মোট ব্যয় বেশি দেখানো হচ্ছে এ সংক্রান্ত প্রস্তাবনায়। পরবর্তী সময়ে কমিশনের আপত্তির মুখে সেগুলো কমানো হয়। কিছু ক্ষেত্রে নানা পর্যায়ের চাপে আপত্তি থাকার পরও প্রকল্প অনুমোদনের সুপারিশ করতে বাধ্য হচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন।

জানা গেছে, প্রকল্প প্রস্তাব পাওয়ার পরই তা পর্যালোচনা করা হয়। সেক্ষেত্রে অযৌক্তিক কিংবা অতিরিক্ত ব্যয় পাওয়া গেলেই তা প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) উত্থাপন করা হয়। সেখানে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরাসহ সব পক্ষের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে কখনও কখনও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের অজুহাতে এসব বিষয় না দেখার ভান করতে হয়। পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব বিষয় জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যুগান্তরকে বলেন, অনেক সময় প্রকল্পের প্রস্তাবনায় অতিরিক্ত ও অযৌক্তিক ব্যয়ের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সেজন্যই পরিকল্পনা কমিশন কাজ করছে। এ বিষয়ে দেখার দায়িত্ব পরিকল্পনা কমিশনের। তবে প্রকল্পে অতিরিক্ত এবং অযৌক্তিক ব্যয় কাম্য নয়।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বৃহস্পতিবার বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পে লাগামহীন অপচয় ও ব্যয়ের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। করের টাকা এভাবে খরচ অবশ্যই পরিহার করতে হবে। কেননা এমনিতেই মোট দেশজ আয়ের তুলনায় আমাদের দেশের বাজেট ছোট। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায়ও বাংলাদেশের বাজেটের আকার কম। সেই টাকা যদি অপচয় হয়, তাহলে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে যাওয়া বাধাগ্রস্ত হবে। এজন্য সরকারি তহবিল ব্যয়ের দক্ষতা বাড়ানো উচিত।

সূত্র জানায়, শিল্প মন্ত্রণালয়ের চামড়া শিল্পনগরী, ঢাকা শীর্ষক প্রকল্পটির তৃতীয় সংশোধনী প্রস্তাব করা হয় পরিকল্পনা কমিশনে। এ প্রস্তাবে নানা ত্রুটি এবং ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। এগুলো হচ্ছে- সরবরাহ ও সেবা খাতের বিভিন্ন উপখাতে ১৪ কোটি ৪০ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতের উপখাতে ২৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। সম্পদ সংগ্রহ খাতের বিভিন্ন উপখাতে ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৮৪ হাজার টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া সৌদি আরবে ৯টি বাংলাদেশি স্কুল নির্মাণ প্রকল্পের প্রস্তাবনায় বিভিন্ন ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পা কমিশন। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- জমি কেনা বাবদ ১২০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা এবং পূর্ত নির্মাণ বাবদ ৪৫০ কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে, যার যথাযথ ভিত্তি নেই বলে পিইসি সভায় উল্লেখ করা হয়। এছাড়া প্রকল্পের ভৌত কাজ ও কনসালটেন্সি সেবা সংগ্রহের প্রক্রিয়া কী হবে, তা স্পষ্ট নয়। প্রকল্পের প্রস্তাবনায় ৩১টি মোটরযান ক্রয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। অথচ স্কুলগুলো দীর্ঘদিন ধরে চলছে এবং বর্তমানে ছাত্রছাত্রীরা যাতায়াত করছে। এ অবস্থায় নতুন করে ৩১টি মোটরযান কেনার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পের বিভিন্ন অঙ্গের ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার তাগিদ দেয় পরিকল্পনা কমিশন। প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভার কার্যপত্র সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এছাড়া যমুনা নদীর ভাঙন থেকে সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার খুদবান্দি, সিংড়াবাড়ী ও শুভগাছা এলাকা সংরক্ষণ প্রকল্পে বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত ব্যয় চিহ্নিত করেছে পরিকল্পনা কমিশন। সম্প্রতি প্রকল্পটির ওপর পরিকল্পনা কমিশনে অনুষ্ঠিত অ্যাপ্রেইজাল সভায় এসব ব্যয়ের বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রকল্পটির উদ্দেশ্য হচ্ছে যমুনা নদীর ভাঙন থেকে ব্রহ্মপুত্রের ডান তীরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এবং প্রকল্প এলাকায় অবস্থিত কাজীপুর সদর উপজেলা কমপ্লেক্স, স্কুল, মসজিদ, বাজার, ইউনিয়ন কমপ্লেক্স, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কৃষিজমি, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ইত্যাদিসহ সরকরি ও বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা ও সম্পদ রক্ষা করা। এছাড়া টেকসই নদী ব্যবস্থাপনার জন্য গভীরতম টেকসই সে াতধারায় নদীর বিন্যাস ও এলাইনমেন্ট বজায় রাখা। নদীর তীর রক্ষার মাধ্যমে প্রকল্প এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্যই প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু এ প্রকল্পের আওতায় অফিস ও আবাসিক ভবন নির্মাণে দুই কোটি টাকা, প্রিন্টিং ও পাবলিকেশন খাতে সাড়ে ছয় লাখ টাকা, ব্যাংক লাইন ও ব্যাথেমেট্রিক সার্ভে খাতে ৩০ লাখ, চার সেট সার্ভে যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৩০ লাখ, অফিস ফার্নিচারে ১০ লাখসহ মোট দুই কোটি ৭৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) থেকে এ পরিমাণ অর্থ বাদ দেয়ার সুপারিশ করেছে পরিকল্পনা কমিশন। এছাড়া প্রকল্পে দুটি জিপ গাড়ির জন্য দেড় কোটি টাকা, দুটি মোটরসাইকেলের জন্য ৫ লাখ টাকার প্রস্তাবের মধ্যে একটি জিপ গাড়ি ক্রয়ে ৭৫ লাখ টাকা ও দুটি মোটরসাইকেলের জন্য তিন লাখ টাকা রেখে বাকি টাকা বাদ দেয়া এবং একটি ডাবল কেবিন পিকআপ ক্রয়ে ৫০ লাখ ও একটি স্পিডবোট ক্রয়ে ১০ লাখ টাকা বাদ দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

অন্যদিকে প্রকল্পের আওতায় চার কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণ কাজ বাবদ ২৪১ কোটি ৭৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা, গ্যাস ও ফুয়েল বাবদ ১৪ লাখ টাকা, পেট্রুল ও লুব্রিকেন্ট বাবদ ১৬ লাখ টাকা, অফিস স্টেশনারি-সিল ও স্টাম্প তৈরির জন্য সাড়ে ছয় লাখ, প্রচার ও বিজ্ঞাপনে তিন লাখ, বিদ্যমান যানবাহন মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে ২০ লাখ, দুই সেট কম্পিউটার ক্রয়ে পাঁচ লাখ, অফিস যন্ত্রপাতিতে চার লাখ এবং বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিতে দুই লাখ টাকার প্রস্তাব যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনতে বলা হয়েছে। এছাড়া আরও বেশ কিছু ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। এদিকে পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়ায় আনুষঙ্গিক সুবিধাদিসহ নদীবন্দর আধুনিকায়ন শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয় পরিকল্পনা কমিশনে। তবে জমি অধিগ্রহণ, প্রকল্পে জনবলের সংস্থান খাতে অ্যালাউন্স হিসেবে বরাদ্দসহ বিভিন্ন ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে পরিকল্পনা কমিশন। গত ২৬ জানুয়ারি প্রকল্পটির ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রকল্পটির আওতায় ১২৭ একর ভূমি অধিগ্রহণের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এজন্য আলোচনা করতে প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণ সংক্রান্ত পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী অধিগ্রহণযোগ্য ভূমির তফসিল, এলাকার বর্ণনা ও গুরুত্ব, সমকালীন বাজার দর ইত্যাদি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস বা রেজিস্ট্রারের অফিস বা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে সংগ্রহ করে ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত করার তাগিদ দেয়া হয়েছিল। এছাড়া উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) জনবলের কোনো সংস্থান না থাকলেও অ্যালাউন্স বাবদ ১৫ লাখ টাকা রাখার প্রস্তাব, প্রকল্পের আওতায় ফার্নিচার বাবদ ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার সংস্থান এবং প্রকল্পের বিভিন্ন অঙ্গের বিবরণ, ব্যয়ের একক নির্ধারণ ভিত্তি সম্পর্কে আলোচনা করার পক্ষে মত দিয়েছিল পরিকল্পনা কমিশন।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/07/03/136246/