৩ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ১২:৩৪

এমপিওতে বিরাট দুর্নীতি

বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতনের সরকারি অংশের প্রাপ্যতা ও বণ্টন নিয়ে বড় ধরনের দুর্নীতি ধরা পড়েছে। মান্থলি পে অর্ডার বা এমপিও নামে পরিচালিত এ কার্যক্রমে বছরের পর বছর এই দুর্নীতি চলছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে ২৬৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আড়াই হাজার শিক্ষকের নামে বাড়তি টাকা তোলায় গত ১১ বছরে সরকারের প্রায় ৯ কোটি টাকা ক্ষতির বিষয় উদ্ঘাটিত হয়েছে। তবে জাল আরও বিস্তৃত। আরও তদন্ত হচ্ছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমাগত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। এই পটভূমিতে গত মার্চে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে এই তথ্য প্রকাশ করেছিলেন যে, কিছু শিক্ষক প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদেও তিনি শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির সমস্যা প্রসঙ্গে বলেন, 'কিছু শিক্ষকের নৈতিকতার সমস্যা আছে।'


তদন্তে জানা গেছে, জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে অযোগ্য শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্ত করেছে 'ইএমআইএস' (এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) সেল। তাদের সঙ্গে জড়িত মাউশির এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীও।

মাউশির চার সদস্যের তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানে মোট ছয় ধরনের জালিয়াতির কথা জানা গেছে। এগুলো হলো- জাল সনদে চাকরিপ্রাপ্তদের এমপিওভুক্তি, গোপনে প্রতিষ্ঠান অথবা বেতন স্কেলের কোড পরিবর্তন, অবৈধভাবে নিয়োগ অথবা নিয়োগ পরীক্ষায় ফেল থাকার পরও এমপিওভুক্তি, যোগ্যতা অর্জন না করলেও সহকারী অধ্যাপকের স্কেল প্রদান, অবৈধভাবে উচ্চতর বেতন স্কেল প্রদান, চাকরির মেয়াদ শেষ হলেও নাম-বয়স সংশোধন করে জালিয়াতির মাধ্যমে চাকরিতে বহাল রাখা ইত্যাদি।

তদন্ত শেষে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে রাজধানীর শাহবাগ থানায় মামলা হয়েছে। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। দুদক পৃথক তদন্ত করছে।

মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. এসএম ওয়াহিদুজ্জামান সমকালকে বলেন, 'মোবাইল ফোনের এসএমএস এবং বিকাশে টাকা পাঠানোর সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের আগস্টের দিকে আমরা চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করি। কমিটি বেশ কিছু তথ্য উদ্ঘাটন করেছে। এর ভিত্তিতে শাহবাগ থানায় মামলা এবং দুদকের তদন্ত কাজ অব্যাহত আছে। ৪০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়েও পাঠানো হয়েছে।'

তদন্ত কমিটির প্রধান মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক এলিয়াছ হোসেন সমকালকে বলেন, তাদের তদন্তে ৮৯৪টি কোড অবৈধভাবে পরিবর্তনের তথা বেতন উচ্চতর স্কেলে রূপান্তরের ঘটনা চিহ্নিত হয়েছে। এসব কেস এমপিও প্রদান-সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় কমিটি অনুমোদন করেনি। কিন্তু ওয়েবসাইটে তাদের বেতন বৃদ্ধির তথ্য আপলোড করা হয়েছে এবং তাদের বাড়তি বেতন-ভাতা দেওয়া হয়েছে।

স্তর ও স্কেল জালিয়াতি :রংপুর পীরগঞ্জের সহকারী শিক্ষক শহীদুল্লাহর বেতন জাতীয় বেতন স্কেলের দশম গ্রেডে হওয়ার কথা। কিন্তু নিয়মবহির্ভূতভাবে কোড পরিবর্তন করে নবম গ্রেডে বেতন তুলছেন তিনি। এভাবে চার বছর ধরে প্রাপ্যতার বাইরে প্রায় ৬ লাখ টাকা বেশি তুলেছেন। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) তার বেতন স্কেল পরীক্ষা করার সময় এ জালিয়াতি ধরা পড়ে। তদন্তে জানা যায়, আড়াই লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে মাউশির ইএমআইএস সেল থেকে তিনি এ গ্রেড পরিবর্তন করিয়েছেন।

একই পন্থায় ব্যক্তির পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোডও পরিবর্তন করে এই জালিয়াত চক্র। তারা নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে সরকারের খাতায় এমপিওভুক্ত থাকা প্রতিষ্ঠানকে মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে দেখিয়ে ওই স্কুলের বাড়তি শিক্ষকদেরও এমপিওভুক্ত করে সরকারি বেতন চালু করে দিয়েছে। বিনিময়ে নিয়েছে লাখ লাখ টাকার ঘুষ। তদন্তে বলা হয়েছে, মাউশি ও ইএমআইএস সেলের একটি শক্তিশালী জালিয়াত চক্র এর সঙ্গে জড়িত।

মাউশির কর্মকর্তারা বলছেন, কোড বদল করে নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলকে মাধ্যমিক এবং

উচ্চ মাধ্যমিক কলেজকে ডিগ্রি কলেজে পরিণত করা হয়েছে। গত ১১ বছরে অবৈধভাবে এভাবে স্তর পরিবর্তন করে এমপিওভুক্ত হয়েছে ২৬৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। জালিয়াতি করে শিক্ষকের বেতনের গ্রেড পরিবর্তন হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার। এ জন্য প্রতি বছর বাজেটে ঘাটতি হচ্ছে। এ নিয়ে অর্থ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দফায় দফায় চিঠি চালাচালি হয়েছে। কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি মাউশি।

জানা গেছে, ইএমআইএস সেলের যেসব কম্পিউটার থেকে জালিয়াতি হয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করতে কম্পিউটারের ডিজিটাল ফরেনসিক পরীক্ষা করার জন্য পুলিশের সহযোগিতা চেয়েছে দুদক।

জালিয়াতির মাধ্যমে এমপিওভুক্তির ঘটনা তদন্ত করতে সর্বশেষ চলতি বছরের ৭ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও অর্থ) অরুণা বিশ্বাসকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এর আগে গত বছর ১২ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব আবু কায়সার খান স্বাক্ষরিত এক পত্রে বলা হয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া নিয়মবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোড পরিবর্তনের ফলে অতিরিক্ত আর্থিক সংকট হয়েছে ৮ কোটি ৮৬ লাখ ১৮ হাজার ৪০৬ টাকার। এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের চাওয়া তথ্যাদি সাত দিনের মধ্যে পাঠানোর জন্য মাউশিকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক মো. এলিয়াছ হোসেন বলেন, 'এটা নিয়ে বেশ বেকায়দায় আছি। বিষয়টি বেশ আগের হওয়ায় সঠিক তথ্য ও কাগজপত্র পাওয়া যাচ্ছে না।'

মাউশি সূত্র জানায়, তাদের কাছে ১৮৫টি স্কুল ও ৭৫টি কলেজের তথ্য চাওয়া হয়েছে। স্কুলগুলো নিম্ন মাধ্যমিক থেকে মাধ্যমিক হয়েছে। আর কলেজগুলো একাদশ-দ্বাদশ থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর আগের জনবল ও কোড পরিবর্তনের ফলে অতিরিক্ত জনবলের তুলনামূলক বিবরণী চাওয়া হয়েছে। প্রায় ৯ কোটি টাকার প্রতিষ্ঠানওয়ারি বিস্তারিত হিসাব বিবরণী ও কোডভিত্তিক সংক্ষিপ্ত বিভাজনও সংগ্রহ করা হচ্ছে।

মাউশির তদন্তে দেখা গেছে, অবৈধভাবে এমপিওভুক্ত হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগই পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, শেরপুর ও সিরাজগঞ্জ জেলায়। অন্যান্য জেলারও দু-একটি করে প্রতিষ্ঠান আছে।

জালিয়াতির মাধ্যমে এমপিওভুক্তির ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৩ সালের জুলাই মাসে ১৭৮ জনের এমপিওভুক্তি বাতিল করেছিল মাউশি।


 

http://bangla.samakal.net/2017/07/03/304747