৩ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ১২:১১

ঈদ-পরবর্তী রাজনীতির স্বরূপ

দেখা অদেখা

|| সালাহউদ্দিন বাবর ||


ঈদ-পরবর্তী জাতীয় রাজনীতির স্বরূপ কী হবে, এই ভাবনা এখন বিভিন্ন মহলের। ঈদের পরপরই রাজনীতি সরব হয়ে উঠবে তা হয়তো নয়। কারণ ঈদের জের, বর্ষা ঋতুর মধ্যভাগের প্রভাব প্রভৃতি কারণে এখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড জমবে বলে মনে হয় না। হয়তো জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে রাজনৈতিক অঙ্গন সরগরম হয়ে উঠতে পারে। এ দিকে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বলছে, ঈদের পরই তাদের ভিশন-২০৩০ নিয়ে তারা তৎপর হবে। বর্ষা শেষে এবং কোরবানির ঈদের পরই প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক অঙ্গনে পুরোপুরি তৎপরতা শুরু হবে। এ সময় যে বিষয়গুলো রাজনীতিতে প্রাধান্য পাবে, তার মধ্যে সংসদ নির্বাচন, নির্বাচনকালীন সরকার, নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং এর পরিবেশ সৃষ্টি ইত্যাদি প্রধান। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, নির্বাচনটা কেমন হবে। আগামী নির্বাচন নিয়ে দেশেই শুধু নয়, আন্তর্জাতিক বলয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন তথা সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, অবাধে সবাই যাতে নির্বাচনী প্রচারে ভূমিকা রাখতে পারে, ভোটদানে বিপত্তি না ঘটে, ভোট গণনায় স্বচ্ছতা, ফল নিয়ে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি না হওয়া ইত্যাদি মুখ্য।
অতীতে ১০টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে, ভবিষ্যতে আরো হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব নির্বাচন কেমন হয়েছে এবং আগামীতে কেমন হবে? বাংলাদেশে এখন যে প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে তাতে সর্বপ্রথম, শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ অপরিহার্য। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য এটা খুবই জরুরি বিষয়।
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ গণতন্ত্র নিয়ে জটিলতার মধ্যে রয়েছে। বারবার গণতন্ত্রের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটেছে। এর ফলে গণতন্ত্রের যে স্বাভাবিক বিকাশ, তা ব্যাহত হয়েছে। কখনো একদলীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, কখনো সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের অধীনে দেশ পরিচালিত হয়েছে, কখনো সংসদীয় ব্যবস্থার নামে চলে অগণতান্ত্রিক শাসন। আবার কখনো কায়েম হয়েছে সামরিক শাসন। একটি সুষ্ঠু শাসনপদ্ধতি কায়েম হয়নি এবং স্থায়িত্ব লাভ করেনি। দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে ওঠেনি কিংবা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর হয়ে উঠতে পারেনি। এতে সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রকাঠামো সুগঠিত হয়ে উঠতে পারেনি। সর্বত্র একটি ভঙ্গুর অবস্থা বিরাজ করছে।
একটি স্বাভাবিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকারের জবাবদিহিতার যে অনুশীলন হয়ে থাকে, বাংলাদেশে এ ব্যবস্থাটি কখনো ছিল না; এখনো নেই। রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হচ্ছে আইন বিভাগ বা সংসদ। এই বিভাগের মুখ্য কাজ প্রয়োজনীয় বিধিবিধান-আইনকানুন পাস করা এবং সরকারের জবাবদিহি নেয়া। এ দেশে সংসদ তথা আইনসভা কখনোই সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারেনি। বহুকাল ধরেই বাংলাদেশে এই জবাবদিহিতা নেই। প্রায় ১০ বছর আইনসভার কাছে সরকারের ন্যূনতম জবাবদিহিতাও নেই। সংসদে বা আইনসভায় কোনো কার্যকর বিরোধী দল না থাকায় সরকারকে কোথাও কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। ফলে দেশে এখন প্রতিষ্ঠিত রয়েছে একটি লাগামছাড়া প্রশাসন। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা দিয়েছে দুর্নীতিগ্রস্ত একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পৃথিবীতে যেসব রাষ্ট্র তালিকাভুক্ত, বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। গণতন্ত্রের সুষ্ঠু চর্চার অভাবে এখানে জবাবদিহিতা না থাকার জের হিসেবে দুর্নীতি অক্টোপাসের মতো সব কিছুকে গিলে খাচ্ছে। সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার হচ্ছে, দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে সরকারি-বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিরাট আকারে তহবিল তসরুফ হচ্ছে। এসব অনিয়ম ঘটছে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের মদদেই। দেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে রয়েছে সরকারি সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই সংস্থাটি অনেক ক্ষেত্রে ভালো কাজ করছে বটে; কিন্তু রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা লাভের ক্ষেত্রে অভাব রয়েছে। সেই সাথে কাঠামোগত অবস্থা এবং দুর্নীতির ব্যাপকতার কারণে দুদকের পক্ষে সব কিছু সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় এখনো দেড় বছর বাকি রয়েছে। তবে দলগুলোর প্রস্তুতির জন্য এ সময়টা খুব বেশি নয়। তাই বেশ আগে থেকে তারা নির্বাচনের জন্য সব কাজ গুছিয়ে নিতে শুরু করেছেন। দেশের বৃহৎ দুই দলের নেতৃত্বে যে দুটো জোট রয়েছে, তারা নির্বাচনে প্রার্থী তালিকা বাছাইয়ের জন্য কাজ করে চলেছে। দুই বৃহৎ দলের মধ্যে রয়েছে দ্বন্দ্ব-কলহ। তাই উভয় দলের প্রার্থী হওয়া নিয়ে সর্বস্তরে গ্রুপিং, দ্বন্দ্ব, প্রতিযোগিতা ও লবিং চলছে। এ অবস্থায় প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করার বিষয়টি কষ্টসাধ্য ব্যাপার। উভয় দলে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে যে ভিড় রয়েছে তা থেকে যোগ্যতা, দলের প্রতি বিশ্বস্ততা এবং নিজ এলাকায় জনপ্রিয়তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। সংসদে গিয়ে আইন প্রণয়নের কাজে ভূমিকা রাখা, ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দলের সদস্য হিসেবে সংসদে গিয়ে যুক্তিতর্কে বিভিন্নমুখী সমালোচনার জবাব দেয়া, নিজ নিজ এলাকায় নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের তদারকি করাÑ এসব যোগ্যতার বিচারও করা হবে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে। তা ছাড়া অতীতে এমপি ছিলেন, কিন্তু সে ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা ও অভিজ্ঞতাও বিবেচনায় আনা হবে। এবারের নির্বাচনকে উভয় দলই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলকভাবে নিয়েছে। তাই সংসদীয় নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই খুবই সতর্কতার সাথে করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলে যারা এখন এমপি, তাদের সবাইকেই মনোনয়ন দেয়া হবে না। তাদের অনেকেরই একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে অংশ নেয়ার অভিজ্ঞতা নেই। সরকারি দল ভাবছে, নির্বাচন কঠিন ও প্রতিযোগিতামূলক হবে। তাদের বর্তমান এমপিরা সংসদে এবং নিজ এলাকায় কতটা ভূমিকা রেখেছেন তা যাচাই-বাছাই করা হবে। এদিকে, প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিএনপির কিছু সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, বিগত প্রায় ১১ বছর বিএনপি সংসদে নেই। দলের আগের পরীক্ষিত সংসদ সদস্যরা এখন বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন। সাবেক কিছু এমপি ‘সংস্কারপন্থী’ হয়ে উঠেছিলেন। তাই বিএনপিতে নবীন ও অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের প্রার্থী করতে হবে অনেক ক্ষেত্রে। তা ছাড়া এখন নির্বাচনে অংশ নেয়া ব্যয়বহুল একটি ব্যাপার। অর্থশালী প্রার্থী পাওয়া সরকারি দলের জন্য সহজ হলেও বিরোধী দলের জন্য তা কিছুটা সমস্যা বটে। এমপি হওয়ার সব দিকে যোগ্য প্রার্থী খুঁজে পাওয়া কঠিন। সব দলের জন্য আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া লোকের অভাব হবে না, কিন্তু যোগ্য প্রার্থী পাওয়া আসলেই সহজ নয়।
বিগত দু’টি সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ছিল না। অথচ একদলীয় নির্বাচন গণতান্ত্রিক বিবেচনায় কোনো নির্বাচনই নয়। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে তথা বর্তমান সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি সংসদ সদস্য ‘বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতা’য় নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি আসনগুলোতে নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছে। তাই দেশের ভেতর ও বাইরে কারো কাছে এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি। গণতন্ত্রের প্রাণ হচ্ছে নির্বাচন। সে নির্বাচন যখন নানা দোষে দুষ্ট, তা বস্তুত গণতন্ত্রকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। দেশ তা থেকে কোনো উপকার পায় না, বরং রাজনৈতিক অঙ্গনে অবিশ্বাস দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাত বাড়িয়ে তোলে। এর ফলে সৃষ্ট অস্থিরতায় দেশের আর্থ-সামাজিক জীবনে সৃষ্টি হয়ে থাকে নানা সঙ্কট। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনে গণতন্ত্র হেরে যায়, বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ। তারা বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে বটে, কিন্তু এতে গৌরব বা আত্মতৃপ্তি নেই। এখন একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন। অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার যৌথ দায়িত্ব ক্ষমতাসীন সরকার ও নির্বাচন কমিশনের। তাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ন্যূনতম গাফিলতিও জাতির জন্য ডেকে আনবে মারাত্মক পরিণতি। নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার অর্থ, কমিশনে নিবন্ধনকৃত দলগুলো যাতে বাধামুক্তভাবে অংশ নিতে পারে, তার ব্যবস্থা করা। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব সরকারের।
কোনো বিষয়ে সঙ্কট দূর করতে হলে প্রয়োজন, খোলা মন নিয়ে এগিয়ে যাওয়া এবং সঙ্কট নিরসনে যে অন্তরায়গুলো রয়েছে তা চিহ্নিত করা। নিজ নিজ অবস্থানে অনড় না থেকে সব পক্ষকেই ছাড় দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হতে হবে। শুধু জেতা নয়, জাতীয় স্বার্থে একমত হওয়ার মানসিকতা প্রদর্শন করতে হবে। বাংলাদেশে জনগণের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দরকার একটি নির্বাচনসহায়ক সরকার। দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তার অভিজ্ঞতা থেকে নির্বাচনসহায়ক সরকারের দাবিতে অবস্থান স্পষ্ট করেছে। পক্ষান্তরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিজেদের অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ নির্বাচনের প্রশ্নে দুই দলের অবস্থান বিপরীত। অথচ অতীত অভিজ্ঞতা হচ্ছে, এ দেশে দলীয় সরকারের অধীনে কখনোই নির্বাচন অবাধ নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয়নি। পক্ষান্তরে নির্বাচনসহায়ক দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে। তাই আগামী নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ তথা সুষ্ঠু করার স্বার্থে এ বিষয়টি সুরাহা করা দরকার, যাতে নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা দূর হয়। এই প্রশ্নে প্রধান দুই পক্ষের মাঝে কথা চালাচালি হচ্ছে। আওয়ামী লীগ তাদের অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন করেছে মনে হতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা তাদের বক্তব্যে ফাঁক রয়েছে বলে মনে করেন। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রীরা পরিষ্কার বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই নির্বাচন হবে। পক্ষান্তরে বর্তমান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলছেন, নির্বাচন কমিশনের অধীনেই নির্বাচন হবে। এটা নতুন কোনো বক্তব্য নয়। বস্তুত এটা সব সময়ই হয়ে থাকে। তাত্ত্বিকভাবে দলীয় সরকারই সহায়ক সরকার হিসেবে অভিহিত হয়ে থাকে। কিন্তু এমন সরকারের অধীনে কখনোই কোনো অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়নি। পক্ষান্তরে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে সেগুলো অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে। বিএনপি এমন ধরনের নির্বাচনসহায়ক সরকারের দাবি করে আসছে। শিগগিরই তারা এমন সরকারের একটি রূপরেখা প্রকাশ করবেন। এখন দেখা যাক, এই দাবির সুরাহা আওয়ামী লীগ কিভাবে করে। আসলে বিষয়টি এখন উপেক্ষা করার মতো অবস্থায় নেই। এ ব্যাপারে সংবিধানের বাধার কথা হয়তো আসবে। কিন্তু ক্রান্তিলগ্নে জাতীয় প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। জাতির স্বার্থেই সংবিধান।
নির্বাচন খুব বেশি দূর না হলেও অনুকূল পরিবেশ এখনো তৈরির উদ্যোগ নেই। নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। নির্বাচনে সবাইকে সমান সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। কোনো দল নির্বাচনী প্রচারে যাতে কোনো চাপ বা বৈরিতার সম্মুখীন না হয়, তার পথ করে দিতে হবে। নির্বাচনে যাতে সবাই সমান সরকারি সুযোগ-সুবিধা পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু সে সবের আভাস ইঙ্গিত কিন্তু এখনো পরিলক্ষিত হচ্ছে না। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি পদে পদে নিগৃহীত হচ্ছে সরকারের কাছ থেকে। তাদের সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। নির্বাচনে তাহলে তারা প্রচারাভিযান চালাবেন কিভাবে? এটা না হবে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি, না হবে সমান সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার নিশ্চয়তা। সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিবের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল রাঙ্গামাটিতে যাচ্ছিল পাহাড়ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সমবেদনা জানাতে। কিন্তু পথে হামলা চালিয়ে তাদের আহত করেছে সরকারি দলের লোকজন। স্বাভাবিক সময়ে এমন অমানবিক হামলা হয়েছে। তাই এটা আশঙ্কার বিষয়, নির্বাচনের সময় পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? বিএনপির চেয়ারপারসনসহ দলের বহু নেতাকর্মীর নামে শত শত হয়রানিমূলক মামলা দেয়া হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন তাদের পেছন পেছন ছুটছে। নির্বাচনে তাদের অবস্থা আরো নাজুক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ভোটের দিন ভোটাররা যাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ পান এবং মাস্তানির মুখোমুখি না হতে হয়, তারা যাতে অবাধে ভোট দিতে পারেন, ভোট অঙ্গনে যাতে কোনো চাপ ও অর্থের ছড়াছড়ি না হয়, সে জন্য নির্বাচন কমিশনকে ব্যবস্থা নিতে হবে। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করার জন্য আমাদের সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে। তা প্রয়োগ করে সব মহলের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ রুখতে হবে। বিভিন্ন প্রশাসন নির্বাচনে পক্ষপাতিত্ব করে যদি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ কারণেও নির্বাচনের সময়ে সহায়ক সরকারের দাবিটির যৌক্তিকতা রয়েছে। উপযুক্ত পরিবেশে ভোট গণনার ব্যবস্থা করা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য। অতীতে বহুবার বহু স্থানে এ নিয়ে সমস্যা হয়েছে। তাই এ বিষয়টি নির্বাচন কমিশনকে দেখতে হবে। নির্বাচন পরিচালনাকারী কর্মকর্তারা যাতে নিরপেক্ষভাবে ভূমিকা রাখেন তা নিশ্চিত করা চাই। কমিশন এবার বিনা কারণে একটি প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। তারা ভোটগ্রহণের ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক পদ্ধতি চালুর বিষয় উল্লেখ করেছে। অথচ এটা ভোটগ্রহণের ক্ষেত্রে অপ্রচলিত একটি ব্যাপার। দেশের জনগণের প্রযুক্তিগত সক্ষমতার অভাব রয়েছে। তাই এই পদ্ধতি চালু করা যাবে না। এই পদ্ধতি চালুর ক্ষেত্রে ঘোর আপত্তি রয়েছে বিভিন্ন দলের। অবশ্য সরকারি দল এই পদ্ধতি চালুর ব্যাপারে হ্যাঁ সূচক মত দিয়েছে। কমিশন বলেছে, কেউ না চাইলে তারা এই পদ্ধতি চালু করবেন না। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচন অবাধ নিরপেক্ষ করা হবে কি না এ বক্তব্যের ব্যাপারে কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো কথা আসেনি। প্রযুক্তি প্রয়োগ করে ভোটদানের এই চিন্তাটা কেন এলো? বিভিন্ন দেশ এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভোটগ্রহণের ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে তা পরিত্যক্ত হয়েছে। এই তথ্য হাতে থাকার পরও কেন এই চিন্তা কার্যকর করার প্রস্তাব এলো তা বোধগম্য নয়।
আগামী নির্বাচনের ওপর দেশের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও আর্থ-সামাজিক জীবনে অগ্রগতি নির্ভর করছে। দেশের রাজনীতি পেশিতন্ত্রের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টির জন্য অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন জরুরি। জনগণকে তাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের অধিকার নিজেদের হাতে তুলে দেয়া দরকার।
রাজনীতির আদল পাল্টানোর সময় এসে গেছে। রাজনীতি নিছক রাজনীতিনির্ভর হওয়া উচিত নয়। জনকল্যাণ ও দেশের উন্নয়নই হওয়া উচিত প্রতিটি দলের কর্মসূচি। স্বস্তির বিষয়, আমাদের দেশের প্রধান দুই দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দেশ ও জনগণের উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গিয়ে তারা এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে।
উভয় দলের দিকদর্শনের সূচনা হবে আগামী নির্বাচনের পর। সে নির্বাচন স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু হওয়ার মাধ্যমেই প্রকৃত অর্থে সেই দিকদর্শনের প্রতিফলন ঘটবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/232448