২ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ১০:১৭

আরো ১৫টি কুইক রেন্টালের জন্যে ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ দাবি

একের পর এক লোকসানের পর আরো রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দিচ্ছে সরকার। শুধু তাই নয় কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করতে তড়িঘড়ি করে বিপুল অংকে ঋণ দিতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। সম্প্রতি একদিনের নোটিশে বৈঠক ডেকে (২১ জুন) কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করার কাজে আগামী ৬ মাসের মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়ার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয় বিদ্যুৎ বিভাগ। তবে এতো অল্পসময়ের মধ্যে এতো কোটি টাকা বিনিয়োগ করা বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা পরিপন্থি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেছেন, বিদ্যুৎ খাতের লুটপাটের সর্বশেষ আয়োজন চলছে। বিদ্যুৎ খাতে কাঙ্খিত ঋণ দিতে হলে ব্যাংক কোম্পানি আইন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা সংশোধনের প্রয়োজন পড়বে। তাছাড়া প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি ছাড়া ভুঁইফোড় কোনো প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিলে ওই বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়ারও আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, আগামী নির্বাচনের আগেই সরকার বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে এমন পরিকল্পনা নিয়েছে।
সূত্র বলছে, বেসরকারি এসব বিদ্যুৎ উৎপাদক কেন্দ্র অর্থ জোগানের অভাবে যাতে প্রকল্প বাস্তবায়নে পিছিয়ে না পড়ে, সেটা নিশ্চিত করতেই ব্যাংকগুলোকে ঋণ প্রদানে চাপ প্রয়োগ করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। কারণ এর আগে বেসরকারি অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ না পাওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়েছে। গৃহীত এসব প্রকল্পের ক্ষেত্রে যাতে তেমনটা না ঘটে, সেজন্য দায়িত্ব নিয়ে বিষয়টি দেখভাল করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, আগামী এক মাসের মধ্যে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে ফাস্ট ট্র্যাক কিছু প্রকল্পের সূচনা করতে যাচ্ছে। এসব প্রকল্প থেকে ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। ব্যাংক ও অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে এসব প্রকল্পে বিনিয়োগ প্রয়োজন। তাই আগামী ছয় মাসের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে এসব প্রকল্পে ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিতে হবে। ব্যাংকের এ বিনিয়োগ যাতে নিরাপদ হয়, সেজন্য প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেন।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খালেদ মাহমুদ বলেন, গ্যাসের প্রাপ্যতা কমে যাওয়া ও কয়েকটি বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে পড়ায় এ উদ্যোগ নিতে হচ্ছে পরিকল্পনা অনুযায়ী ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক দুই হাজার মেগাওয়াটের কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র জরুরি ভিত্তিতে নির্মাণ করা হবে। ঠিক রেন্টাল বা কুইক রেন্টাল না হলেও ১৫ বছরের জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় এ নিয়ে বিব্রত মন্ত্রণালয়। আগামী নির্বাচনের আগেই বিদ্যুতের ঘাটতি মিটিয়ে জনগণের আস্থা পেতে চায় তারা। তাই বাকি দেড় বছরের মধ্যে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক দুই হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার ১৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, দেশের ১২টি স্থানে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। বর্তমানে যেসব রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে, নতুন কেন্দ্রগুলোর অধিকাংশও ওইসব কোম্পানিকেই দেয়া হবে। তা বণ্টন করা হবে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান ছাড়াই দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ (বিশেষ আইন)-২০১০-এর আওতায় দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার ভিত্তিতে। ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলোকে ছয় মাস ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোকে নয় মাসের মধ্যে উৎপাদনে আসার শর্তে চুক্তি করা হবে।
এদিকে হঠাৎ করে এতো কোটি টাকা ঋণ দেয়ার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের চাপ প্রয়োগে বিপাকে পড়ছে ব্যাংকগুলো। একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তার মনে করেন,ছয় মাসের মধ্যে এ পরিমাণ ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যেমন নীতিগত বাধা আছে, একই সঙ্গে ঋণ ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা ও অনিশ্চয়তাগুলোও যাচাই করে দেখতে হবে। বিদ্যুৎ খাতে কাঙ্খিত ঋণ দিতে হলে ব্যাংক কোম্পানি আইন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা সংশোধনের প্রয়োজন পড়বে। তাছাড়া প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি ছাড়া ভুঁইফোড় কোনো প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিলে ওই বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়ারও আশঙ্কা রয়েছে।
আইনগত বাধার কারণে আগামী ছয় মাসের মধ্যে নির্দিষ্ট খাতে ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়ে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, একক ঋণগ্রহীতার সীমার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর জন্য ১৫ শতাংশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ১৫ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ করতে পারবে না। তবে অনেকগুলো ব্যাংক মিলে সিন্ডিকেশন ঋণ দিতে পারে। সেক্ষেত্রেও ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ দেয়া সম্ভব না-ও হতে পারে।
বেসরকারি একটি ব্যাংকে একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণে সরকার জরুরি ভিত্তিতে কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য ব্যাংকগুলোকে ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিতে বলেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তবে এক্ষেত্রে কিছুটা তাড়াহুড়া করা হচ্ছে বলে আমার মনে হয়। বিষয়টি নিয়ে আরো আলোচনার সুযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের পর থেকেই বিশেষ আইনে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ও। ২০১০ সালের মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত বিদ্যুতের দাম প্রায় ৭০ শতাংশ বেড়েছে। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় মূল্য ৩ টাকা ৭৬ পয়সা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ টাকা ৩৩ পয়সায়। নতুন করে আরো ১৫টি রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে গ্রাহকপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম আরো বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদকে জানিয়েছেন, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারের সময়ে দেশে মোট ১৩ হাজার ৫৯৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে, যার মধ্যে গত আট বছরেই উৎপাদন ক্ষমতা আট হাজার ৩৪০ মেগাওয়াট বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রী জানান, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থাপিত ক্ষমতা বর্তমানে (ক্যাপটিভসহ) ১৫ হাজার ৩৫১ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। কিছু পুরোনো কেন্দ্র বিভিন্ন সময়ে বাতিল হওয়ায় বর্তমানে ১৩ হাজার ১৭৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে।

http://www.dailysangram.com/post/289870