২ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ১০:১৬

১০ বছরে পাচার হয়েছে ৬ লাখ কোটি টাকা

গত ১০ বছরে টাকা পাচার বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ না থাকায় বিদেশে অর্থ পাচার বাড়ছে বলে মনে করেন দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা। শেয়ার বাজার, ব্যাংক, ডেসডিনি আর যুবকের লুট হওয়া অধৈক টাকাই সুইস ব্যাংকে যাচ্ছে। এর বাইরেও গত ১০ বছরে বিদেশে পাচার হয়েছে ৬ লাখ কোটি টাকা। অর্থপাচারের দিক থেকে ভঙ্গুর রাজনীতির দেশ পাকিস্তানকেও বহু ধাপ পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। সুইস ব্যাংকের টাকা নিয়ে রাজনৈতিকভাবে হৈ চৈ হলেও পাচার হওয়া ৬ লাখ কোটি টাকা নিয়ে কোন আলোচনা নেই।
দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাও অর্থ পাচার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। টাকা পাচার বন্ধে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠনের সুপারিশ করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এই দেশে থেকে অর্থ পাচারের জন্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের অভাব অন্যতম কারণ। এ ছাড়া দেশের ভেতরে নিরাপত্তার অভাববোধও অরেকটি কারণ। বিদেশে অর্থ পাচাররোধে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি, অপরাধীদের দৃশ্যমান শাস্তি, ঋণ খেলাপিদের ক্ষেত্রে বিদেশে টাকা পাঠাতে না দেওয়া ও শেয়ারবাজার থেকে টাকা সংগ্রহের পর তার সঠিক ব্যবহার নিয়ে যথাযথ তদারকির প্রয়োজন বলে মনে করেন দেশের এই অর্থনীতিবিদ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেন, বাংলাদেশে অনেকে টাকা রাখতে ভয় পান। তাই বিদেশে টাকা পাচার করেন। শুধু করের হার কমালেই টাকা পাচার বন্ধ হবে না। টাকা পাচার বন্ধে তিনি একটি স্থায়ী আইনি কাঠামো তৈরির সুপারিশ করেন। তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা এনবিআর একা টাকা পাচার বন্ধ করতে পারবে না। এ জন্য একটি স্বতন্ত্র অফিস তৈরি করা উচিত, গুরুতর অপরাধ দমন অফিসের মতো। এটা হওয়া উচিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে। এ অফিসে পুলিশ, অর্থনীতিবিদ ও সমাজতাত্ত্বিকেরা থাকতে পারেন। তবে সুইস ব্যাংকের যে টাকা রাখা হয়েছে তা শুধু রাজনীতিবিদদেরই। সামনে নির্বাচন তাই সুইস ব্যাংকে টাকা বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্বনর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, বিনিয়োগের সুযোগের অপ্রতুলতার কারণেই মূলত টাকা পাচার হয়, এতে কোনও সন্দেহ নেই। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ থাকলে এত টাকা পাচার হতো না। তার মতে, রাজনৈতিক অস্বস্তির কারণেও টাকা পাচার হয়। নির্বাচনের বছর ২০০৮ সালে যে টাকা পাচার হয়েছে, তা আগের বছরের চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি। আর ২০১৩ সালে যে অর্থ পাচার হয়েছে, তা আগের বছরের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি। নির্বাচন এলেই টাকা পাচার হয়। এ জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়ন প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। অর্থ পাচারে বিনিয়োগবান্ধব প্রতিকূলতাও অন্যতম কারণ বলে মনে করেন বাংলাদেশের এই অর্থনীতিবিদ।
সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কয়েকটি বিষয়ে কাজ করলে অর্থ পাচাররোধ সম্ভব। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তি উন্নত ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, পাচার হওয়া অর্থের চেয়ে পাচার রোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বিনিয়োগ নিঃস্ব একটি দেশ এখন ক্রমান্বয়ে পুঁজি রফতানিকারক দেশে পরিণত হচ্ছে। এর মতো বৈপরীত্য আর কিছু দেখি না। যে দেশে বিনিয়োগের জন্য পুঁজি আসছে না, সেই দেশ থেকে পুঁজি পাচার হয়ে যাচ্ছে।
গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই) প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে সিপিডির গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, বাংলাদেশ থেকে ক্রমান্বয়ে বিদেশে অর্থ পাচার বেড়েছে। ২০১৩ সালে ৯৬৬ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। অর্থপাচারের দিক থেকে শীর্ষ ১০০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪০। গত ১০ বছরের হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ৫৫৮ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যার ৮৮ শতাংশই হয়েছে আমদানি ও রফতানিতে মিথ্যা মূল্য ঘোষণা দিয়ে।
দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা বছরে মোট যত টাকা বিনিয়োগ করেন, প্রায় তত টাকাই পাচার হয় বাংলাদেশ থেকে। একসময় ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা অর্থ পাচার না করে দেশেই বিনিয়োগের কথা ভাবতেন। শুধু রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ বিদেশে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে রাখতেন। কিন্তু এখন দেশের ভেতরে বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকা ও বিনিয়োগ সুরক্ষার অভাব আর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে মাঝারি ও ছোট ব্যবসায়ীরাও বিদেশে অর্থ পাচার করে বাড়ি বানাচ্ছেন, জমি কিনছেন, কারখানা গড়ছেন। ব্যবসায়ীরা দেদার অর্থ পাচার করছেন আমদানি-রপ্তানির আড়ালে, আমদানি পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে আর রপ্তানি পণ্যের দাম কম দেখিয়ে। মধ্যম সারির কর্মকর্তা থেকে উচ্চপর্যায়ের আমলা, বেসরকারি চাকরিজীবীরাও নগদ অর্থ পাচার করছেন হুন্ডি করে, ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে, বিদেশে বসে ঘুষের অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে। শুধু ২০১৪ সালেই বাংলাদেশ থেকে আরো প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। ২০১৩ সালে দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার, বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা। এভাবে গত ১০ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে ছয় লাখ ছয় হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। অর্থপাচারের দিক থেকে ভঙ্গুর রাজনীতির দেশ পাকিস্তানকেও বহু ধাপ পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ।
২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ওই বছরে সারা দেশে উন্নয়ন কর্মকা-ের পেছনে সরকারের ব্যয় হওয়া অর্থের প্রায় সমান। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার কোটি টাকা। আবার বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে টাকার অঙ্কে বাংলাদেশে স্থানীয় বিনিয়োগ নিবন্ধনের পরিমাণ ছিল ৯১ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। আর যে পরিমাণ বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধিত হয় তার অনেকাংশই বাস্তবায়ন হয় না। সেই হিসাবে ২০১৪ সালে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা দেশে যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে, পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ (৭৩ হাজার কোটি টাকা) তার প্রায় কাছাকাছি বলেই ধরা হচ্ছে (এক ডলার সমান ৮০ টাকা ধরে এই হিসাব করা হয়েছে)।
জিএফআই’র হিসাবে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশের মোট আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ সাত হাজার ছয় কোটি ৯০ লাখ ডলার। এর ১৩ শতাংশ অর্থপাচার হয়ে থাকলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬১ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা আমদানি-রপ্তানি পণ্যের দামে হেরফের করে পাচার হয়েছে। বাকি ১১ হাজার ২১২ কোটি টাকা নগদ পাচার হয়েছে। আর সর্বনিম্ন ৯ শতাংশ অর্থপাচার হয়েছে ধরে নিলে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩৯ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা পাচার হয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে। বাকি অর্থ নগদ পাচার হয়েছে।
সংস্থাটির হিসাবে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ ৪৪ হাজার ৬১৫ কোটি ডলার বা ৩৫ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১২ থেকে ১৭ শতাংশ অর্থই বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। সর্বোচ্চ ১৭ শতাংশ অর্থপাচার হয়েছে ধরে নিলে এই ১০ বছরে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ছয় লাখ ছয় হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। তবে সর্বনিম্ন ১২ শতাংশ ধরলে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়াবে চার লাখ ২৮ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলেছিল, ২০০৪-২০১৩ পর্যন্ত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে পাঁচ হাজার ৫৮৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় এর পরিমাণ চার লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকার মতো।
জিএফআই মনে করে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তার সময় ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে আগের ৯ বছরের তুলনায় সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হয়েছে। ওই বছরটিতে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০১২ সালে এর পরিমাণ ছিল ৭২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এর আগে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার অনেক বেড়ে যায়। বছরটিতে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৬৪৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এর আগের অন্যান্য বছরের মধ্যে ২০০৪ সালে ৩৩৫ কোটি ডলার, ২০০৫ সালে ৪২৬ কোটি ডলার, ২০০৬ সালে ৩৩৮ কোটি ডলার, ২০০৭ সালে ৪১০ কোটি ডলার, ২০০৯ সালে ৬১৩ কোটি ডলার, ২০১০ সালে ৫৪১ কোটি ডলার, ২০১১ সালে ৫৯২ কোটি ডলার পাচার হয়েছে।
সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত এক বছরে ১ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা বেড়ে ৫ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ফলে গত বছরের তুলনায় এ আমানত বৃদ্ধি পেয়েছে ১৯ শতাংশ। বৃহস্পতিবার সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী বিষয়টি জানা যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো বাংলাদেশি তার নাগরিকত্ব গোপন করে টাকা জমা রাখলে সেসব তথ্য এই প্রতিবেদনে নেই। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, দেশে বিনিয়োগ না হওয়ায় পুঁজি পাচার হচ্ছে। পাচার করা টাকার একটি অংশ সুইস ব্যাংকগুলোতে জমা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত এ বিষয়ে তদন্ত করে দেখা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে তদন্তের কথা বারবার বলা হলেও বিষয়টি বেশিদূর আগায়নি।

http://www.dailysangram.com/post/289875-