২ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ১০:০২

ভ্যাট আতঙ্ক কাটছে না

ফাঁকিবাজ ধরতে চিরুনি অভিযানে নামছে এনবিআর

ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সামনে মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছিল ‘মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন-২০১২’। তীব্র আপত্তির মুখে ভোটের রাজনীতিকে মাথায় রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত গণবিরোধী এ আইনের বাস্তবায়ন দুই বছরের জন্য স্থগিত করেছেন। কিন্তু তাতেও আতঙ্কমুক্ত হতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। তাদের আশঙ্কা, সরকার অন্য কোনো উপায়ে বিশাল অঙ্কের এই করের বোঝা তাদের ওপর চাপিয়ে দেবে। জাতীয় সংসদে অর্থ বিল পাস করার সময় আইনটি স্থগিত করা হলেও এ উৎস থেকে ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রায় কোনো পরিবর্তন না আনায় এ আতঙ্ক তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
বাজেট পর্যালোচনায় দেখা যায়, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নকে সামনে রেখে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট খাতে সর্বোচ্চ ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকার ল্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার। কিন্তু সদ্য পাস হওয়া বাজেটে ভ্যাট আইন স্থগিত করলেও ভ্যাট থেকে আয়ের ল্যমাত্রায় কোনো ধরনের কাটছাঁট করা হয়নি। তার ওপর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ বেশির ভাগ পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ভ্যাট খাতের বিশাল আকৃতির এই ল্যমাত্রা পূরণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) কোনো দিকনির্দেশনা দেয়া হয়নি। তবে নতুন ল্যমাত্রা পূরণে কাজ শুরু করেছে এনবিআর। ভ্যাটের ল্যমাত্রা অর্জনে সংস্থাটি নতুন উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
ভোটের কথা মাথায় রেখে নেয়া পরিবর্তিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জাতীয় সংসদে অর্থ বিল পাসের আগে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বহু বিতর্কিত ভ্যাট আইনের বাস্তবায়ন আরো দুই বছর পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যাংক আমানতে আবগারি শুল্ক কমানো হয়েছে। কম্পিউটার, সেলুলার ফোন এবং এর যন্ত্রাংশ এখন দেশে তৈরি হচ্ছে বলে এগুলো ভ্যাটমুক্ত করা হয়েছে। মোটরসাইকেল শিল্পের ওপর স্থানীয় উৎপাদনপর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহার হয়েছে। মাইক্রোসফট বাংলাদেশ যেসব পণ্য বিনা আমদানি শুল্কে আনে, সেসব পণ্য ভ্যাটমুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশে রেফ্রিজারেটর উৎপাদনকারীদের ওপর সম্পূরক শুল্কহার কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। প্লাস্টিক ও গ্লাস ফাইবার নির্মিত এলপিজি কনটেইনারের আমদানিপর্যায়ে কোনো ভ্যাট রাখা হয়নি। মোটরসাইকেলের সব যন্ত্রপাতি উৎপাদনে বর্ধিত শুল্ক করাদি মওকুফ হবে। প্রয়োজনীয় উপকরণ আমদানিপর্যায়ে শুল্ক হ্রাস হবে। সোলার প্যানেলের ওপর যে আমদানি শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল, তা আর নেই। তৈরী পোশাক খাতে উৎসে কর ১ শতাংশ বহাল থাকবে। সবুজ কারখানার েেত্র আয়কর হার ১০ শতাংশ এবং অন্যদের েেত্র ১২ শতাংশ হবে। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনকে একটি সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম হিসেবে বিবেচনা করে ধ্যান বা যোগ সাধনা আগামী দুই বছর ভ্যাটমুক্ত রাখার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন উঠেছে ছাড় দেয়া এসব রাজস্ব পূরণ হবে কিভাবে? জবাবে এনবিআর সূত্র জানায়, এনবিআরের হিসাবে দেশে ৫০ লাখের বেশি ভ্যাটযোগ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র আট লাখ ৮৪ হাজার প্রতিষ্ঠান ভ্যাট নিবন্ধন নিয়েছে। নিয়মিত ভ্যাট রিটার্ন জমা দিচ্ছে মাত্র ৩৪ হাজার প্রতিষ্ঠান। ভ্যাটের বিশাল এই ল্যমাত্রা পূরণে এবার ভ্যাট আওতার বাইরে থাকা নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে নজর দেয়া হবে। এসব প্রতিষ্ঠানকে ধরতে রাজধানী থেকে গ্রাম পর্যন্ত দেশের প্রতিটি প্রান্তে ভ্যাট অভিযান চালানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, সরকারের পক্ষ থেকে দিকনির্দেশনা না থাকলেও ভ্যাট ল্যমাত্রা পূরণে রূপরেখা তৈরি করছে এনবিআর। জোরদার হচ্ছে জরিপকার্যক্রম। এর মধ্যে রয়েছে ভ্যাটযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে খুঁজে বের করে নিবন্ধনের আওতায় আনা। বার্ষিক বিক্রয়ের পরিমাণ (টার্নওভার) নির্ধারণ এবং প্যাকেজ ভ্যাটের আওতাভুক্ত কি নাÑ তা যাচাই করা হবে। এ জন্য রাজধানী থেকে গ্রাম পর্যন্ত সব মার্কেট ও শপিংমলে অভিযান চালাবেন ভ্যাট কর্মকর্তারা। ভ্যাটযোগ্য নতুন প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করা ভ্যাট বিভাগের রুটিন ওয়ার্ক হলেও এবার রুটিন ওয়ার্ককে স্থায়ী করে দেয়া হচ্ছে। ফাঁকিদাতা প্রতিষ্ঠানের তালিকা করে নজরদারি বাড়ানো হবে। অনেক প্রতিষ্ঠান প্যাকেজ ভ্যাটের দোহাই দিয়ে পার পেতে চায়, তাদের বিষয়েও কঠোর হবে এনবিআর। অডিটের পরিমাণ বাড়ানো হবে। কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হবে মাঠ অফিসকে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে দুই লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকার রাজস্ব ল্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ভ্যাট খাতের ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা ল্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। যেখানে ২০১৬-১৭ অর্থবছর ল্যমাত্রা ছিল ৭২ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। পরে সংশোধন করে ৬৮ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা করা হয়। গত অর্থবছর ভ্যাট খাতে সংশোধিত ল্যমাত্রার সাথে ৩৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে অর্থাৎ অতিরিক্ত ২২ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা ধরা হয়। বর্তমানে ২০টি সেবা খাতে সঙ্কুচিত হারে ভ্যাট আদায় করা হয়। এর মধ্যে আবাসন খাতে দেড় থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ, নির্মাণ সংস্থা ৬ শতাংশ, আসবাবপত্র ৬ ও ৪ শতাংশ, জুয়েলারি ৫ শতাংশ, পরিবহন ঠিকাদার সাড়ে ৪ ও ১০ শতাংশ, বিদ্যুৎ ৫ শতাংশ, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল সাড়ে ৭ শতাংশ হিসাবে ভ্যাট আদায় হয়। অন্য দিকে গুঁড়া দুধ, বিস্কুট, কেক, চাটনি, জুস, নিউজ পেপার, ইট, জেনারেটর, সয়াবিন তেলসহ ১৭৯টি পণ্যে ট্যারিফ ভ্যালুর আওতায় ভ্যাট আদায় করা হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর খড়গ নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ দিকে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সেবার মানোন্নয়ন, অংশীজন ও নাগরিকদের কাছে সেবা পৌঁছানো নিশ্চিত, আয়কর, ভ্যাট, কাস্টমস ও ট্রাইব্যুনালের যার যার েেত্র সর্বোচ্চ কর্মসম্পাদন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরএডি) আওতাধীন দফতর ও সংস্থাগুলোর সাথে রাজস্ব ল্যমাত্রা অর্জনে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) সই হয়েছে গতকাল। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সম্মেলন কে সম্পাদিত এ চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান মো: নজিবুর রহমান। সভায় অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের অধীন সব দফতরের প্রধান, এনবিআরের সদস্য ও অন্যান্য কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। সভায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে গৃহীত প্রধান প্রধান কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান দিকনির্দেশনা দিয়ে বলেন, জাতীয় সংসদ প্রদত্ত নির্দেশনার আলোকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন করতে হবে। ল্যমাত্রাভিত্তিক রাজস্ব আহরণ করতে হবে। বিভিন্ন আইন সংস্কারের মাধ্যমে রাজস্বব্যবস্থাকে অধিকতর করদাতাবান্ধব, ব্যবসাবান্ধব ও গণমুখীকরণ করতে হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/232226