২ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ৯:৫৫

প্রতিকূল পরিবেশ সত্ত্বেও ইসলাম রাজনীতির কেন্দ্র বিন্দুতে এসেছে

ধর্মনিরপেক্ষতার নামে বাংলাদেশের সেক্যুলার শিবির যে ধর্মের বিরোধিতা, বিশেষ করে ইসলামের বিরোধিতা করছে সেটি আর এখন বিএনপি, জামায়াত বা অন্যান্য ইসলামী দলকে বলতে হচ্ছে না। এখন সেই কথাটি খোদ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদেরই আরেকটি অংশ জোরেশোরে বলছেন। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ওরা যে শুধু ধর্মহীনতাকে প্রমোট করছে তাই নয়, এ ব্যাপারে পাক-ভারত চ্যাম্পিয়ান্স ক্রিকেট খেলায় ভারত যে চরম সাম্প্রদায়িকতা এবং মুসলিম বিদ্বেষ দেখিয়েছে সেটাও সেক্যুলার শিবিরেরই একটি বিবেকবান অংশ তুলে ধরছেন। ধর্মনিরপেক্ষ বলে পরিচিত বাংলাদেশের একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা এ সম্পর্কে ফলাও করে যে সংবাদ ছেপেছে তার শিরোনাম দিয়েছে, ‘Don’t treat cricket as a test for Indian Muslims’ patriotism’ অর্থাৎ ভারতীয় মুসলামানদের দেশপ্রেমের পরীক্ষাকে ক্রিকেট দিয়ে বিচার করো না। খবরে বলা হয়, যখন পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে ক্রিকেট খেলা হয় তখন তার উত্তাপ এবং উত্তেজনা শুধুমাত্র মাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। যে দল হেরে যায় সেই দলের সমর্থকরা মনে করে যে আমাদের দেশ বা জাতি হেরে গেল। আর যে দল জয় লাভ করে সেই দলের সমর্থকরা মনে করে যে আমাদের দেশ বা জাতি জয়লাভ করেছে। কয়েক দিন আগে ইংল্যান্ডের মাটিতে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যে ফাইনাল খেলা হয়ে গেল সেটিও ছিল অত্যন্ত উত্তেজনাকর। এখানেও যে হার-জিত হয়েছে সেখানেও নিজ নিজ দলের সমর্থকদের মধ্যে ওপরে উল্লেখিত প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু ভারতীয় মিডিয়ার একটি বড় অংশের মধ্যে একটি অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। তারা এটিকে সম্প্রদায় বিশেষের দেশপ্রেমিকতার পরীক্ষা হিসাবে বিবেচনা করেছে। ভারতের রিপাবলিক টিভি নামের চ্যানেলটির এ্যাংকর অর্ণব গোস্বামী তো তার প্রাইম টাইম শো’তে ঘোষণাই করে দিলেন যে, আজ এই খেলাতে সকলকেই ভারতকে সমর্থন করতে হবে। যারা এর অন্যথা করবে তাদেরকে পাকিস্তান চলে যেতে হবে। পত্রিকাটি ইংরেজিতে বলছে, “This warning” was primarily targeted at separatists in Kashmir.” অর্থাৎ কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতা বাদীদেরকে লক্ষ্য করেই এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে।

এখানে একটি কথা অত্যন্ত স্পষ্ট বলা দরকার। কাশ্মীরের মানুষদেরকে যদি ভারতীয় বলা হয় তাহলে অত্যন্ত ভুল করা হবে। কাশ্মীর আজও একটি বিরোধীয় এলাকা। তাই যদি না হবে তাহলে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান কাশ্মীর বিরোধে মধ্যস্থতা করতে চান কেন? কেন সেদিনও মোদি এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা হলো? আজও কেন কাশ্মীরে আন্দোলন হয় এবং আইন-শৃংখলা বাহিনীর গুলিতে অসংখ্য লোক মারা যায়?
জাতিসংঘের হিসাব মোতাবেক কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনে এ পর্যন্ত ১ লক্ষ মানুষ শাহাদাৎবরণ করেছেন। সুতরাং তারা ভারতীয় এটা ধরে নেয়া ঠিক নয়। ঐ রিপোর্ট মোতাবেক খেলার পর ভারতের মধ্য প্রদেশ থেকে ১৫ জন মুসলমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ইংল্যান্ডের ফাইনাল ম্যাচকে কেন্দ্র করে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ আনা হয়েছে। ভারতের একজন রাজনৈতিক ভাষ্যকর বলেছেন যে, এই ধরনের এ্যাকশন ভারতীয় বিচার ব্যবস্থা বিশেষ করে উচ্চ আদালতের অনেক নির্দেশনার বিরোধী। এই বক্তব্যের সপক্ষে বলা হয়েছে যে, As early as in 1962, the Supreme Court in Kedarnath vs State of Bihar categorically said that mere speeches or slogans cannot come under such a grave offence, which is considered just short of treason.
বাংলা অনুবাদঃ ১৯৬২ সালে বিহার রাজ্যে কেদার নাথ বনাম রাষ্ট্র মামলায় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছে যে, শুধুমাত্র বক্তৃতা বা স্লোগান রাষ্ট্রদ্রোহের মতো এমন মারাত্মক অপরাধের পর্যায় পড়ে না। রায়ে আরো বলা হয়, রাষ্ট্রদ্রোহ বা দেশদ্রোহীতার সপক্ষে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকতে হবে। আলোচ্য ক্ষেত্রে একজন গ্রামবাসীর অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ ক্ষিপ্র গতিতে এ্যাকশনে যায়। এর ফলে সন্দেহ হয় যে, এই এ্যাকশনের পেছনে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে কি না?
॥দুই॥
ঐ ইংরেজি পত্রিকাটির রিপোর্ট মোতাবেক বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা যখন ইসলাম এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে কথা বলে তখন একটা কথা তারা ভুলে যায়। পত্রিকাটির রিপোর্ট মোতাবেক, সেটি হলো, এদেশের সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ৮৭ শতাংশই হলো মুসলমান। (এখানে পরিসংখ্যানগত ভ্রম রয়েছে। মুসলমানদের সংখ্যা ৮৭ শতাংশ নয়, ৯০ শতাংশ। অবশ্য সেটি মূল আলোচ্য বিষয় নয়।) তারা আরো একটি কথা ভুলে যায় যে, বাংলাদেশ ওআইসির একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র। ওআইসির যে ৫৭টি সদস্য রাষ্ট্র রয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ জনসংখ্যার দিক দিয়ে ৩য় বৃহত্তম। এদেশে মুসলমানরা তাদের ধর্মকে সম্মান করে, একই সাথে তারা সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিষয়ে উদার মনোভাব পোষণ করে।
ঐ ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকাটিতে এই লেখাটি যিনি লিখেছেন তার নাম সিরাজুল ইসলাম। তিনি ছিলেন একজন ক্যারিয়ার এ্যাম্বাসেডর। এই মুহূর্তে তিনি আমেরিকাতে আছেন। পরবর্তী ঘটনাবলী তার জবানিতেই শুনুন,“আমি বেশির ভাগ সময় আমেরিকাতেই থাকি, বাংলাদেশ সম্পর্কে টেলিভিশন এবং ইন্টারনেট থেকে জানার চেষ্টা করি। একদিন টেলিভিশনের একটি টক’শো দেখছিলাম। মুখ্য আলোচক ছিলেন সেক্যুলার ঘরানার অন্যতম শীর্ষ নেতা। আলোচনা শুনে আমার ধারণা হলো যে বাংলাদেশের সেক্যুলাররা দেশের ইসলামী পটভূমিকে সম্মান করাতো দূরের কথা, সেটিকে গ্রহণ করতেও পারেনি।”
ঐ নেতাটি টেলিভিশনের পর্দায় একটি বই দেখাচ্ছিলেন। ভাব করছিলেন, যেন তিনি বাচ্চাদেরকে বর্ণমালা শেখাচ্ছেন। কিন্তু একটু পরেই পরিষ্কার হয়ে গেল যে, এই বর্ণমালা শেখানোর পেছনে একটি বদ মতলব রয়েছে। তিনি ইংগিত করলেন যে, ইসলাম ধর্মে কতগুলো শব্দ আছে। এগুলো হলো ‘অজু,’ ‘নামাজ’, ‘রোজা’ ইত্যাদি। এসব শব্দ ব্যবহার করা হয় কচি মনে ইসলামের প্রভাব রাখতে। তিনি বললেন যে, ‘অ’তে অজু না শিখিয়ে বাংলার অজগর শেখানো হচ্ছে না কেন? ব্যাপারটি এতই আপত্তিকর, কুৎসিত এবং নোংরা যে, অবশিষ্ট শব্দগুলো নিয়ে আলোচনা করার কোনো প্রবৃত্তি আমার হচ্ছে না। ইসলাম বিরোধীতায় এদের মন এতটাই বিদ্বিষ্ট এবং আচ্ছন্ন হয়ে গেছে যে ওরা মনে করে যে, ইসলামী শিক্ষা পেলে এবং ইসলামী শব্দগুলো শিখলে কিশোর এবং তরুণরা নাকি সন্ত্রাসবাদের দিকে ঝুঁকে পড়বে। এই যদি এদের বিদ্যা এবং জ্ঞানের দৌড় হয় তাহলে এদেরকে করুণা করা ছাড়া আর কি বা বলার আছে।
॥তিন॥
ঐ ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট বলছেন যে, বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা কোনো সময়ই জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। তারা কোনো সময়ই তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি। কারণ তাদের আন্দোলন ছিল এলিটিস্ট আন্দোলন। তারা এলিটদের অর্থাৎ অভিজাত বা বড় লোকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তারা আলোচনায় আসে তখনই যখন ক্ষমতাসীন দল তাদেরকে জামায়াত বিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের আন্দোলনে মাঠে নামিয়ে দেয়। তারা যে বিষয়টি ভাবতে পারেনি সেটি হলো এই যে, এখন বাংলাদেশের রাজনীতি অনেকটা ইউ টার্ন নিয়েছে। তারা ভেবেছিল যে, যুদ্ধাপরাধের বিচার ও জামায়াত বিরোধী সেন্টিমেন্ট তারা মানুষের মনে চিরদিনের জন্য প্রোথিত রাখতে সক্ষম হবে এবং সেই আন্দোলনকে সূক্ষ্মভাবে ইসলাম বিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরে সক্ষম হবে। কিন্তু সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো এই যে, এই ক্যারিয়ার এ্যাম্বাসেডর এবং ঐ পত্রিকাটি সেক্যুলার ঘরানার হলেও তারা বলছেন এবং লিখছেন যে, বাতাস ধীরে ধীরে ঘুরে যাচ্ছে। এখন রাজনীতির কেন্দ্র বিন্দুতে চলে এসেছে ইসলাম। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই সেক্যুলাররা তাদের ধর্মনিরপেক্ষতার খোলস কিছুটা ছেড়ে দিয়ে তারা চেহারায় ইসলামী রং লাগানোর চেষ্টা করছে।
এখন বাম সেক্যুলার ঘরানা হালে আর পানি পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে তারা ফাটা বাঁশে আটকে গেছে। ঐ লেখক এবং তার কলাম যে পত্রিকাটি প্রকাশ করেছে তারা উভয়েই মনে করেন যে, দেশের রাজনীতিতে এখন একটি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা বিরাজ করছে। বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপি এবং জামায়াতকে মাথা তুলতে দেয়া হচ্ছে না। এদের মধ্যে জামায়াতকে কোনো কথা বলতে দেয়া হচ্ছে না। জামায়াত বা শিবিরের কোনো কর্মীকে রাতে তাদের ঘরে ঘুমাতে দেয়া হচ্ছে না। রাস্তাঘাটেও যদি স্বাভাবিক দৈনন্দিন কর্মরত অবস্থায় কোনো জামায়াত বা শিবির নেতাকর্মীকে দেখা যায় তাহলে পুলিশ খপ করে তাকে ধরে প্রথমে রিমান্ডে পাঠাচ্ছে এবং তার পর জেলে পাঠাচ্ছে। উদার নৈতিক গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এই লেখক এবং পত্রিকাটির মতে আজ যদি রাজনৈতিক রেজিমেন্টেশনকে কিছুটা রিল্যাক্স করে দেয়া হয়, যদি বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীকে মিটিং মিছিল করার কিছুটা হলেও সুযোগ দেয়া হয় তাহলে সরকার এবং বাম ঘরানা অবাক দৃষ্টিতে দেখবেন একটি ভিন্ন চিত্র। তারা দেখবেন যে, বিএনপি নেতাদেরকে গ্রেফতার এবং তাদের বিরুদ্ধে আরো কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার পরেও এবং জামায়াত নেতাদের ফাঁসি এবং রিমান্ডে নির্যাতনের পরেও দুটি দলেরই জনপ্রিয়তা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি অনেক মজবুত হয়েছে। সরকার বুঝে গেছে যে, দেশের কোনো ইসলামী শক্তি তাদের সাথে নেই। তাই হেফাজতে ইসলামের সাথে মিত্রতা করার চেষ্টা করছে সরকার। আজ স¦য়ং প্রধান মন্ত্রীও বলছেন যে, তার সমর্থনের ফলেই বাম ও সেক্যুলার ঘরানার লোকরা জিরো থেকে হিরো বনে গেছে। আজ যদি তিনি তাদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন তাহলে আগামী কাল তারা জনরোষ থেকে বাঁচার কোনো জায়গা পাবে না।
তবে এসব কথা তাদের কানে ঢোকেনি। তাই এই ঘরানার অন্যতম নেতা সুলতানা কামাল বলেছেন যে, সুপ্রিম কোর্টে যদি মূর্তি না থাকতে পারে তাহলে দেশে কোনো মসজিদও থাকবে না। তিনিও জনরোষের মুখে পড়তে যাচ্ছিলেন। তবে সরকারের প্রটেকশন তাকে এখনও রক্ষা করছে। ঐ কলামে বলা হয়েছে যে, যখন গণজাগরণ মঞ্চের কয়েকজন ব্লগার পবিত্র কুরআন, রসূলুল্লাহ্ (সঃ) এবং ইসলাম বিরোধী জঘন্য ব্লগ দিয়েছিল তখন যদি সরকার তাদেরকে রক্ষা না করতো তাহলে পরিস্থিতি ভিন্নতর হতো।
আজ খোদ ঢাকা এবং বাংলাদেশের অন্যত্র যদি দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যায় তাহলে দেখা যাবে তরুণী ও যুবতীসহ সব বয়সের মহিলাদের একটি বিশাল অংশ হিজাব করছেন। মসজিদে যুবক ছেলেদের সংখ্যা বিপুলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। উদার নৈতিক ঐ লেখক এবং পত্রিকাগুলোর মতে সরকার বিশেষ করে বাম ও সেক্যুলার ঘরানার লোকজনকে এসব বিষয় বিবেচনার মধ্যে নিতে হবে। যদি তারা সেটি না করে তাহলে যেদিন রাজনীতি তার বন্ধ দুয়ার থেকে কিছুটা মুক্তি পায় তাহলে এই সব ইসলাম বিরোধীরা রাজনৈতিকভাবে এতিমের মতো অসহায়ভাবে ঘোরাফেরা করবে।

http://www.dailysangram.com/post/289861-