১ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ১০:৫৩

সবচেয়ে বিতর্কিত বাজেটে বিপর্যয়ের মুখে অর্থনীতি

রাজনীতির কাছে অর্থনীতি যখন পরাজিত তখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বাজেট বাস্তবায়ন হবে তো? এটি ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত বাজেট বলছেন দেশের সচেতন জনগণ। দিক নির্দেশনাহীন এই মেগা বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় আরো ঘনিভূত হলো। ভ্যাট এবং আবগারি শুল্ক বাড়িয়ে যে আয় বাজেটে যুক্ত করা হয়েছিল তা বাদ দেয়া হলেও বাজেটে তা সমন্বয় করা হয়নি। কোন খাত থেকে আয় আসবে তার কোনো নির্দেশনা নেই। বাজেট বাস্তবায়নে জটিলতা বেড়েছে। এখনও পুরনো ভ্যাট আইন বিদ্যমান থাকায় আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়বে এমন আশঙ্কা প্রবল হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, কর পরিশোধ করার পর বৈধ টাকা রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু রক্ষার পরিবর্তে আবগারি শুল্কের নামে জোর করে টাকা কেটে নেয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রের এই অধিকার নেই, এটা অবৈধ, সংবিধানেরও পরিপন্থী। এটি বৈধ সম্পত্তি আত্মসাৎ করার মতো ঘটনাই। এটি অবশ্যই বেআইনি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজেট বাস্তবায়ন হবে বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থ বিল বাদ দিয়ে বাজেট বিল পাশ এটাই প্রথম। এতে করে ঝুঁকিতে পারতে পারে দেশের অর্থনীতি। এর আগে বাজেট নিয়ে সরকারি দলের এমপিরা এত বির্তক করেননি। ভ্যাট এবং আবগারি শুল্কের মত বিতর্কিত দুটি বিষয় বাদ দেয়ায় বাজেট বাস্তবায়ন লক্ষ্যচ্যুত হতে যাচ্ছে।
নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নকে সামনে রেখে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট খাতে সর্বোচ্চ ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার। কিন্তু ‘মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২’ দুই বছরের জন্য স্থগিত হওয়ায় ভ্যাটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, ভ্যাট থেকে এনবিআরের আয় হয় ৬৪ হাজার কোটি টাকা। ভ্যাট আইন পরিবর্তন করে লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৯১ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু নতুন ভ্যাট আইন স্থগিত করলেও লক্ষ্যমাত্রা ঠিক রাখা হয়েছে। এতে করে বাস্তবায়ন নিয়ে আরও জটিলতা বেড়েছে। অর্থাৎ শুধু নতুন ভ্যাট আইন স্থগিত করার কারণেই এনবিআরের আয় কমবে ২৭ হাজার কোটি টাকা। বর্ধিত আবগারি শুল্ক থেকে আয় হওয়ার কথা ছিল হাজার কোটি টাকা।
সদ্য পাস হওয়া বাজেটে ভ্যাট আইন স্থগিত করলেও ভ্যাটের লক্ষ্যমাত্রায় কোনো ধরনের কাটছাট করা হয়নি। তার ওপর নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসহ বেশিরভাগ পণ্যে ভ্যাট অব্যহতি দেয়া হয়েছে।
ভ্যাট খাতের বিশাল আকৃতির এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) কোনো দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়নি। তবে নতুন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কাজ শুরু করেছে এনবিআর। ভ্যাটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নতুন উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সংস্থাটি।
রাজধানী থেকে গ্রাম পর্যন্ত দেশের প্রতিটি প্রান্তে ভ্যাট অভিযান চালানোর কথা জানিয়েছেন এনবিআর কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, ভ্যাটের বিশাল এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এবার ভ্যাট আওতার বাইরে থাকা নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে নজর দেয়া হবে। ভ্যাট সংগ্রহে দেশের প্রতিটি প্রান্তে চিরুনি অভিযান চালানো হবে।
এনবিআরের হিসেবে, দেশে ৫০ লাখের বেশি ভ্যাট যোগ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৮ লাখ ৮৪ হাজার প্রতিষ্ঠান ভ্যাট নিবন্ধন নিয়েছে। মাত্র ৩৪ হাজার প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ভ্যাট রিটার্ন জমা দিচ্ছে।
গত ২৩ মার্চ থেকে অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন শুরু হয়। ২২ জুন পর্যন্ত ৫০ হাজার ১৭১ নিবন্ধন হয়েছে। এর মধ্যে টার্নওভার প্রতিষ্ঠান ১ হাজার ২৭৯ ও ৪৮ হাজার ৮৯২ ভ্যাট নিবন্ধন। নতুন ভ্যাট নিবন্ধন নিয়েছে ১৯ হাজার ৬৯৪টি ও পুনঃনিবন্ধন করেছে ৩০ হাজার ৪৭৭ প্রতিষ্ঠান।
এনবিআর সূত্র জানায়, দিক-নির্দেশনা না থাকলেও ভ্যাট লক্ষ্যমাত্রা পূরণে রূপরেখা তৈরি করছে এনবিআর, জরিপ কার্যক্রম জোরদার হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ভ্যাট যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে খুঁজে বের করে নিবন্ধনের আওতায় আনা। বার্ষিক বিক্রয়ের পরিমাণ (টার্নওভার) নির্ধারণ এবং প্যাকেজ ভ্যাটের আওতাভুক্ত কি না- তা যাচাই করা হবে। রাজধানী থেকে গ্রাম পর্যন্ত সব মার্কেট ও শপিং মলে অভিযান চালাবে ভ্যাট কর্মকর্তারা।
সূত্র আরও জানায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে দুই লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ভ্যাট খাতের ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। যেখানে ২০১৬-১৭ অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭২ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। পরে সংশোধন করে ৬৮ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা করা হয়। গত অর্থবছর ভ্যাট খাতে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার সাথে ৩৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে অর্থাৎ অতিরিক্ত ২২ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা ধরা হয়।
বর্তমানে ২০টি সেবা খাতে সংকুচিত হারে ভ্যাট আদায় করা হয়। এর মধ্যে আবাসন খাতে দেড় থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ, নির্মাণ সংস্থা ৬ শতাংশ, আসবাবপত্র ৬ ও ৪ শতাংশ, জুয়েলারি ৫ শতাংশ, পরিবহন ঠিকাদার সাড়ে ৪ ও ১০ শতাংশ, বিদ্যুৎ ৫ শতাংশ, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল সাড়ে ৭ শতাংশ হিসাবে ভ্যাট আদায় হয়। অন্যদিকে গুঁড়া দুধ, বিস্কুট, কেক, চাটনি, জুস, নিউজপেপার, ইট, জেনারেটর, সয়াবিন তেলসহ ১৭৯টি পণ্যে ট্যারিফ ভ্যালুর আওতায় ভ্যাট আদায় করা হতো।
এনবিআরের একজন সদস্য বলেন, ‘নতুন আইন বাস্তবায়নকে টার্গেট করে ভ্যাটের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই টার্গেট পূরণে একটি গাইডলাইন ছিল। আইন তো বাস্তবায়ন হয়নি। আমাদেরকে কোনো দিক-নির্দেশনাও দেয়া হয়নি। বিশাল এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ চ্যালেঞ্জ হবে। তবে আমরা রূপরেখা তৈরি করছি।’
তিনি বলেন, ‘ভ্যাট যোগ্য নতুন প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করা ভ্যাট বিভাগের রুটিন ওয়ার্ক। এবার রুটিন ওয়ার্ককে স্থায়ী করে দেয়া হচ্ছে। শুধু শহর নয়; গ্রামে পর্যায় পর্যন্ত ভ্যাট কর্মকর্তারা ভ্যাট যোগ্য প্রতিষ্ঠানে হানা দেবে।’
এনবিআরের ওই সদস্য বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠান ভ্যাট ফাঁকি দেয়। এসব প্রতিষ্ঠানের তালিকা করে নজরদারি বাড়ানো হবে। অনেক প্রতিষ্ঠান প্যাকেজ ভ্যাটের দোহাই দিয়ে পার পেতে চায়- তাদের বিষয়েও কঠোর হবো। অডিটের পরিমাণ বাড়ানো হবে। মাঠ অফিসকে কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হবে।
তবে বাজেট প্রস্তাব করার পর ভ্যাট আইন এবং আবগারি শুল্ক নিয়ে বিতর্কের অবসান হলেও জটিলতা অনেক বেড়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ বাজেটে ভালো দিক থাকলেও মন্দ দিক অনেক বেশি। বিশেষ করে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন নিয়ে সরকারের শেষ সময়ের নাটকীয়তা আর সিদ্ধান্তহীনতায় পুরো বাজেটের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলে ভ্যাট ছাড়াও আয়কর আদায় বেড়ে যাবে। জনগণের ওপর করের বোঝা বাড়িয়ে রাজস্ব আদায়ে উল্লম্ফন হবে এমন আশার কথাও শুনিয়েছিলেন এনবিআরের নীতিনির্ধারকরা। এ হিসাব মাথায় নিয়েই অর্থমন্ত্রী আয়-ব্যয়ের প্রাক্কলন করেন। কিন্তু এখন পুরনো ভ্যাট আইন বিদ্যমান থাকায় আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়বে এমন আশঙ্কা প্রবল হয়েছে। কারণ রাজস্ব আদায় স্বাভাবিকভাবেই লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না। প্রাক্কলিত রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি বেড়ে যাবে অস্বাভাবিক হারে। আর একই হারে ব্যয় না কমালে বাজেট ঘাটতিও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাবে। অথচ বাজেটের লক্ষ্যপূরণে ঘাটতির এ বাড়তি অর্থ কোথা থেকে আসবে তা স্পষ্ট করেননি অর্থমন্ত্রী।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, কর আদায়ের ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত অর্থবিল পাসের সময় যে দুটি বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে, তাকে স্বাগত জানাচ্ছি। তবে বড় কথা হচ্ছে এর ফলে রাজস্ব আদায়ে কী পরিবর্তন আসবে? সংসদে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে বাজেটের আকার ও বরাদ্দে কোনো পরিবর্তনের কথা শুনিনি। তবে এটা নিশ্চিত, এই পরিবর্তনে রাজস্ব আদায় কমবে। রাজস্ব আহরণ ঠিক রাখতে ভ্যাট ও আয়কর সম্প্রসারণের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, করের আওতা বাড়িয়ে ও আদায়ের সক্ষমতা তৈরি করে আহরণে যে হ্রাস হচ্ছে, তা পূরণ করতে হবে। এ ছাড়া দুই বছর পর যখন থেকে এই আইন কার্যকর করা হবে, তখন আগে থেকে ঠিক করে নিতে হবে একক হারে এটা বাস্তবায়ন হবে কি না।
নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন দুই বছর পিছিয়ে দেওয়া সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ায় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের কাছে নতি স্বীকার করল সরকার। যে বড় সংস্কারের লক্ষ্য ছিল, তা সাহসের সঙ্গে এগিয়ে নিতে পারল না। এটা সরকারের ব্যর্থতা।
এ ঘটনাকে রাজনীতির কাছে সরকারের হার হিসেবে অভিহিত করে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, এই বাজেটে চমক বলতে ভ্যাট আইনটিই ছিল। রাজস্ব আদায় এই পরিবর্তনের জন্য কমে যাবে। সরকার এখন কোন দিকে সমঝোতা করবে, এটা ঠিক করতে হবে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে কী সমঝোতা হবে? ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে এ পরিবর্তন অর্থনীতির জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভোটের জন্য এমনটা করার প্রয়োজন হলে সরকার তা আগেই ভাবতে পারত। তাহলে নতি স্বীকার করে পরিবর্তন করতে হয়েছে এমনটা মনে হতো না। এর ফলে রাজনীতির কাছে অর্থমন্ত্রী নতজানু হলেন অর্থনীতির পরাজয় হলো।
আবার ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না করায় এলোমেলো পরিস্থিতিতে বাজেট কাঠামো থেকে যাবে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, বাজেটের ঘাটতিজনিত প্রতিক্রিয়ার সমন্বয় এখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল। বাজেটে রাজস্ব আদায়ে আয়কর থেকে ৩৬ শতাংশ ও ভ্যাট থেকে ৩৩ শতাংশ লক্ষ্য রাখা হয়েছিল। এই জায়গায় এখন একটা চাপ তৈরি হবে। তিনি আরো বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাট অনেক কিছুর ওপর রাখা হয়নি। প্রচলিত উৎসের ওপর নির্ভর করেই ছিল। বাস্তবায়ন না হলে এখন ঘাটতির চাপ পড়বে। এখন সরকারকে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থায়ন করতে হবে। যা অর্থনীতির জন্য দুর্বলতা তৈরি করবে।
তিনি আরও বলেন, এতদিন বিষয়টি নজরে আসেনি। কারণ আগে হিসাবে টাকা থাকলে কিছু সুদ পাওয়া যেত। এখন সুদের হার কম, এই টাকা কাটা হলে আসল টাকাও কমে যাবে। তাই ব্যাংকের হিসাবের ওপর কোনো ধরনের আবগারি শুল্ক কাটা বৈধ হবে না।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, এটি ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত বাজেট। এই বাজেটে জনগণের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। এটি আসলেই লুটপাটের বাজেট। এই বাজেটে আয় ব্যয়ের কোনো সমন্বয় নেই। সরকার নির্বাচনী বৈরিতা পার করতেই এই লুটপাটের বাজেট পেশ করেছে।

http://www.dailysangram.com/post/289788-