৩০ জুন ২০১৭, শুক্রবার, ১১:৪০

ভ্যাট আইনে শুভঙ্করের ফাঁকি থাকছেই

ভ্যাট আইনে শুভাঙ্কের ফাঁকি থাকছেই। সারা বছর জুড়ে একজন ভোক্তা ভ্যাট দিয়ে থাকলেও তার নামে তা যুক্ত না হয়ে ক্রেডিট হচ্ছে কোম্পানির। দেশের ১৬ কোটি মানুষ ট্যাক্স, ভ্যাট দিয়ে থাকলেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তালিকায় নেই। জনগণের পরিশোধিত এসব ভ্যাট ট্যাক্স যায় কোথায়? সংশ্লিষ্ট কোম্পানি গ্রাহকের কাছ থেকে নেয়া ভ্যাট সঠিকভাবে পরিশোধ করে কিনা তাও জানেনা সংশ্লিষ্ট ভ্যাট প্রদানকারি। অথচ এ নিয়ে সরকারের কোন মাথা ব্যথা নেই। যদি প্রতিটি ব্যক্তির নামে ভ্যাট আইডি থাকতো তাহলে প্রতিদিনের কেনাকাটায় দেয়া ভ্যাট তার নামেই যুক্ত হতে পারতো। কিন্তু ভ্যাট আইনে এ ধরনের কোন নিয়ম নেই।
ব্যবসায়ী এবং জনগণের দাবির মুখে নতুন ভ্যাট আইন স্থগিত করলো সরকার। কিন্তু ভ্যাট আইনের এসব ফাঁকি সংশোধন করবে কি না তা বলা যাচ্ছে না। ভ্যাট আইনের এসব ব্যাড (খারাপ) দিক রেখেই যদি আইন পাস হয় তাহলে জনগণের প্রাপ্তি হবে শূন্য।
জানা গেছে, প্রতিটি পণ্য ক্রয়ে সরকারকে ভ্যাট নিতে হচ্ছে একজন ভোক্তা থেকে। একইভাবে একজন মোবাইল গ্রাহককে প্রতিদিনই রিচার্জের জন্য ভ্যাট নিতে হচ্ছে। কিন্তু ব্যক্তি ভ্যাট দিলেও তা তার নামে যুক্ত না হয়ে কোম্পানির নামে যুক্ত হচ্ছে।
কর আইনজীবীরা বলছেন, এটি ভ্যাট আইনে যুক্ত করা খুবই সহজ। এতে করে প্রতিটি ব্যক্তির ট্যাক্স ভ্যাটদাতা হিসেবে স্বীকৃতি পেতো। এতে করে দেশের জনগণ ট্যাক্স ভ্যাট আদায়ে আরও উৎসাহিত হতো। প্রতিটি নাগরিকই জানতে পারতো তিনি দেশের উন্নয়নে কত টাকা দিয়েছেন। দেশ গঠনে তার কি পরিমাণ অবদান রয়েছে। আর তিনি রাষ্ট্র থেকে কি নিয়েছেন।
জানা গেছে প্রতি বছর দেশের বহুজাতিক কোম্পানি থেকে শুরু করে সব কোম্পানিই ভ্যাটের নামে গ্রাহকের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা কেটে নিচ্ছে। অথচ বছর শেষে তারা সে টাকা জমা দিতে গিয়ে ফাঁকি দিচ্ছে। অর্থাৎ একজন গ্রাহক যদি জানতে পারতো তিনি কত টাকা ভ্যাট দিয়েছেন তার সে টাকা সরকার পেয়েছে কি না। ব্যক্তির নামে ভ্যাটযুক্ত হলে কোম্পানিগুলো আর ভ্যাট ফাঁকি দিতে পারতো না। এতে করে সরকারের রাজস্ব আদায় আরও বাড়তো।
সব ধরনের ব্যবসাকে করের আওতায় আনতে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এমনকি সারা দেশেই বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন কোম্পানির পণ্য সরবরাহে এজেন্সি বা শো-রুম কেন্দ্রিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও এই কর নেটের আওতায় আসছে। এর অংশ হিসেবে আগামী অর্থবছর থেকে সব ধরনের আর্থিক সেবায় ইলেকট্রনিক কর শনাক্তকারী নম্বর (ই-টিআইএন) বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। ই-টিআইএন ছাড়া প্রতিষ্ঠানের কমিশন ব্যয় গ্রহণ করবে না এনবিআর।
আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর ১৮৪(এ) ধারা সংশোধন করে আর্থিক সেবা ও কমিশন ব্যবসায় ১২ অংকের ই-টিআইএন নম্বর নেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এনবিআরের একজন ডেপুটি কমিশনার পদমর্যাদার কর্মকর্তার কাছ থেকে এ সনদ নিতে হবে। তবে সনদ নিলেও করযোগ্য আয় না হলে প্রতি বছর রিটার্ন জমা দেয়ার প্রয়োজন হবে না। মূলত করজাল বিস্তৃতি ও আর্থিক সেবাকে কমপ্লায়েন্সের মধ্যে আনতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানান এনবিআর কর্মকর্তারা।
এনবিআরের প্রথম সচিব (করনীতি) শব্বির আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে জনসংখ্যার অনুপাতে টিআইএনধারীর সংখ্যা অনেক কম। চলতি অর্থবছর স্থায়ী চাকরিজীবীদের জন্য এটা বাধ্যতামূলক করায় এখন পর্যন্ত নতুন করদাতার সংখ্যা ১১ লাখ ছাড়িয়েছে। করদাতার সংখ্যা বাড়ানোর পাসাপাশি আর্থিক সেবা খাতকে কমপ্লায়েন্সের মধ্যে আনতেই ই-টিআইএন নেয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। নতুন এ বিধানের মাধ্যমে করের পরিধি অনেক বাড়বে বলে আমাদের বিশ্বাস।
তিনি বলেন, বিশে^র অধিকাংশ দেশেই টিন নম্বর এবং ভ্যাট আইডি করার পরেই কেবল ব্যবসা শুরু করতে পারেন কোন একজন উদ্যোক্তা। কিন্তু বাংলাদেশে ছিল এর ভিন্ন নিয়ম। কেউ ব্যবসা করলে সফল হলে এবং করে আদায়ের উপযোগি হলেই তিনি টিন করতেন। এতে করে কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এখন থেকে আর এ নিয়ম চলবে না। ভ্যাট এবং টিন নম্বর করেই কোন উদ্যোক্তাকে ব্যবসা শুরু করতে হবে।
নতুন বিধান অনুযায়ী, মোবাইল ফোনে রিচার্জ থেকে কমিশন নেন, এমন ব্যবসায়ীদের আগামী অর্থবছর থেকে বাধ্যতামূলকভাবে ই-টিআইএন নিতে হবে। যারা মোবাইল ব্যাংকিং বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে অর্থ লেনদেন করেন, তাদের জন্যও ই-টিআইএন বাধ্যতামূলক। সারা দেশে নিজেদের পণ্য বিক্রির জন্য কোম্পানির পক্ষ থেকে কোনো ডিস্ট্রিবিউটর বা এজেন্ট নিয়োগ দেয়া হলে তাদের ক্ষেত্রেও ই-টিআইএন প্রদর্শন করতে হবে। একজন ব্যক্তি যদি কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে পরামর্শ ফি গ্রহণ করেন, সেক্ষেত্রেও ই-টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ই-টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে খাবার সরবরাহ, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টসেবা, জনবল সরবরাহ ও নিরাপত্তাসেবা (সিকিউরিটি সার্ভিস) দানের ক্ষেত্রেও।
আইন সংশোধন করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের পাসাপাশি সব ধরনের মোবাইল রিচার্জের এজেন্টদেরও ই-টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একই সঙ্গে অন্য যেকোনো ধরনের ইলেকট্রনিকস ডিভাইসের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ই-টিআইএন নেয়া। পাড়ামহল্লার এসব ছোট ছোট ব্যবসায়ী ও এজেন্টের ই-টিআইএন বাধ্যতামূলক করাকে নিজেদের জন্য হয়রানি হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী ও সেলফোন অপারেটররা একে দেখছেন ইতিবাচক হিসেবেই।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান বিকাশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল কাদির বলেন, ডিজিটালাইজেশনের অংশ হিসেবে বিকাশসহ সব ধরনের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্টদের ই-টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হলে তাদের স্বচ্ছতা অনেক বাড়বে। ই-টিআইএন নিলেও করযোগ্য আয় না হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ীকেই আয়কর রিটার্ন জমা দেয়ার প্রয়োজন পড়বে না। তাই ব্যবসায়ীদের এতে আশঙ্কার কিছু নেই।
ই-টিআইএন বাধ্যতামূলক হলে স্বচ্ছতা আরো বাড়বে বলে মনে করেন এসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের (এমটব) মহাসচিব টিআইএম নুরুল কবির। তিনি বলেন, আমরাও চাই, একটি উন্নত পরিপালন ব্যবস্থার মধ্যে মোবাইল লেনদেন পরিচালিত হোক। এক্ষেত্রে এজেন্টদের প্রতি আমাদের সমর্থন থাকবে।
আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর ১৮৪ (এ) ধারায় আগে থেকেই বাস, ট্রাক, প্রাইম মুভার ও লরির নিবন্ধন, মালিকানা পরিবর্তন বা ফিটনেস সনদ নবায়নের জন্য ই-টিআইএন বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু নতুন আইনে মোটরসাইকেলও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এর বাইরে অধিকাংশ ব্যবসা বা সেবায় পেশাজীবীদের ই-টিআইএন গ্রহণ আগে থেকেই বাধ্যতামূলক। ঋণপত্র স্থাপন, রফতানি নিবন্ধন সনদ, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা থেকে ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ বা পুনর্নিবন্ধন, দরপত্র জমা ও অভিজাত ক্লাবের সদস্যপদ গ্রহণ এর মধ্যে অন্যতম। এছাড়া বীমা জরিপ প্রতিষ্ঠান, জমি, ভবন ও ফ্ল্যাট নিবন্ধন, কোম্পানির পরিচালক ও উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার, বিয়ে নিবন্ধনকারী ও ড্রাগ লাইসেন্সের ক্ষেত্রেও ই-টিআইএন বর্তমানে বাধ্যতামূলক। বিদ্যমান আইনে বাধ্যতামূলকভাবে ই-টিআইএন নিতে হয় চিকিত্সক, প্রকৌশলী, হিসাববিদসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যদেরও।
সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এলাকায় বাণিজ্যিক গ্যাস ও বিদ্যুত্ সংযোগ নিলে এবং এসব এলাকায় অবস্থিত কোনো ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে সন্তানদের পড়াতে চাইলে ই-টিআইএন নিতে হয়। আর চলতি অর্থবছর এ তালিকায় যুক্ত করা হয় সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ১৬ হাজার টাকার বেশি বেতন পাওয়া কর্মকর্তাদের। ই-টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যেকোনো স্থায়ী কর্মকর্তার ক্ষেত্রেও।

http://www.dailysangram.com/post/289658-