১ জুলাই ২০২৪, সোমবার, ৬:৫৯

চ্যালেঞ্জের মুখে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা

প্রতিদিনের পরিবর্তে সপ্তাহে ২ দিন নগদ টাকার জোগান দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

টাকার সঙ্কট মেটাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সপ্তাহে দুই দিন নগদ টাকার জোগান দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগে প্রতিদিনই টাকা ধার দেয়া হতো। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত গতকালই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন তারা। কারণ, কোনো ব্যাংকের জরুরি টাকার সঙ্কট দেখা দিলে তা পূরণ করা কষ্টকর হবে। আবার আগাম ধারণা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে রাখলে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যাবে।

জানা গেছে, কোনো ব্যাংকের টাকার সঙ্কট দেখা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে নগদ টাকার জোগান দেয়া হয়। ব্যাংকিং ভাষায় এ ধার দেয়াকে রেপো বলা হয়। সাধারণত একদিন থেকে ১৪ দিন মেয়াদে এ অর্থ ধার দেয়া হয়। বিপরীতে ব্যাংকগুলোর কাছে থাকা সরকারি ট্রেজারি বন্ড বন্ধক রাখা হয়। এজন্য ব্যাংকগুলোকে পৌনে ৯ শতাংশ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সুদ গুনতে হয়। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক যদি মনে করে ব্যাংকগুলোর হাতে উদ্বৃত্ত অর্থ রয়েছে তাহলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে টাকা উত্তোলন করে বাংলাদেশ ব্যাংকে রাখা হয়। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে সুদ গুনে থাকে। ব্যাংকিং ভাষায় এ পদ্ধতিতে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে টাকা উত্তোলন করাকে রিভার্স রেপো বলা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সাধারণত তার মুদ্রানীতির বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য এ পদ্ধতিতে ব্যাংকে টাকা ধার ও ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে থাকে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, নানা কারণে ব্যাংকগুলোতে দীর্ঘ দিন ধরে টাকার সঙ্কট রয়েছে। কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপ ও ব্যাংকের পরিচালকরা ব্যাংক থেকে নামে বেনামে ঋণ নিচ্ছেন। কিন্তু এ ঋণের বেশির ভাগ অর্থই পরিশোধ করছেন না। আবার বিভিন্ন সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিসহায়তার মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা ছাড় পেয়ে যান। যেমন, কখনো নাম মাত্র ডাউন পেমেন্ট দিয়ে, আবার কখনো সুদহারে ছাড় পেয়ে ঋণ পরিশোধ না করেই ঋণ নবায়ন করেন। এসব কারণে ব্যাংকগুলোর নগদ আদায় তুলনামূলকভাবে কমে গেছে। বিপরীতভাবে প্রতিটি পণ্যের দাম দ্বিগুন তিনগুণ হয়েছে। কিন্তু এ অনুযায়ী আয় বাড়েনি। বাধ্য হয়ে মানুষ তার ব্যয় নির্বাহের জন্য ব্যাংকের জমানো টাকা তুলে নিচ্ছেন। এসব কারণে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনায় টান পড়ে। বাধ্য হয়ে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলো প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নগদ অর্থ ধার করে চলছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত ২৭ জুন টাকার সঙ্কটে পড়া এমন ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ধার করেছে ১৫ হাজার ৫১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১৮টি ব্যাংক ও তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাত দিন মেয়াদি রেপোর মাধ্যমে সাত হাজার ৯২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা ধার করেছে। ১৪ দিন মেয়াদি রেপোর মাধ্যমে সাতটি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান তিন হাজার ৪২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ধার করেছে। সরকারের ঋণ দিতে বাধ্য এমন আটটি ব্যাংক (যাদেরকে প্রাইমারি ডিলার বা পিডি বলা হয়) একদিন মেয়াদি তহবিল সহায়তার আওতায় দুই হাজার ৫৮১ কোটি টাকা ধার করে। একই দিন ইসলামী ব্যাংক তহবিল সহায়তার আওতায় ২৮ দিনের জন্য দুই হাজার ৩৫ কোটি টাকা ধার নেয়।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ তহবিলসহায়তা দেয়ার ফলে ব্যাংকগুলো যেকোনো অঙ্কের নগদ টাকার সঙ্কট মেটাতে পারছে। কিন্তু প্রতিদিনের পরিবর্তে সপ্তাহে দু’দিন তহবিলসহায়তা করলে ব্যাংকগুলো কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। যেমন, কোনো ব্যাংকের হঠাৎ টাকার প্রয়োজন হলো, যেদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নগদ অর্থের জোগান দেবে না, ওই দিন কিভাবে তাদের প্রয়োজন মেটাবে। আবার আগাম ধারণা অনুযায়ী সাত দিন আগেই টাকা ধার করে রাখলে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যাবে। সবমিলেই ব্যাংকগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাবে।

তবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্তের কারণেই এই পরিবর্তন আনা হয়েছে। অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় বাংলাদেশ ২০২২ সালের জুলাই মাসে আইএমএফের কাছে ঋণ চায়। বাংলাদেশের ঋণ আবেদনের ছয় মাস পর সংস্থাটি গত বছরের ৩০ জানুয়ারি শর্ত সাপেক্ষে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে। ওই সময় রিজার্ভ, রাজস্ব বাড়ানো এবং খেলাপি ঋণ কমানোসহ নানা শর্ত দেয় সংস্থাটি। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেপোর আওতায় ব্যাংকগুলোকে প্রতিদিন ধার দেয়ার পদ্ধতি পরিবর্তন আনার বিষয়ও পরামর্শ দেয়। সংস্থাটির পক্ষ থেকে প্রতিদিনের পরিবর্তে সপ্তাহে একদিন রেপোর মাধ্যমে টাকা ধার দিতে বলা হয়। কিন্তু ব্যাংকগুলো চাপে পড়ে যাবে এমন আশঙ্কা থেকে সপ্তাহে দুই দিন অর্থাৎ সোমবার ও বুধবার রেপো নিলাম আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয় হয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতা বাড়বে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/846210