৩০ জুন ২০১৭, শুক্রবার, ১১:৪০

দীর্ঘ হচ্ছে লাশের মিছিল

প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরে যাচ্ছে অনেক মূল্যবান প্রাণ। এছাড়া এসব দুর্ঘটনায় পঙ্গু হচ্ছেন অনেকে। প্রায় প্রতিদিনই লাশের এই তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। বিশেষ করে ঈদের সময় রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত করে। পরিবার পরিজনের সঙ্গে ঈদ করতে তারা শহর এবং কর্মস্থল ছেড়ে গ্রামের দিকে ধাবিত হয়। এজন্য এ সময়টায় পাল্লা দিয়ে বেড়ে যায় সড়ক দুর্ঘটনা এবং সড়কে প্রাণহানি। ঈদের আগে ও পরে কয়েকদিনে বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল বৃহস্পতিবারও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৬ জন। এ নিয়ে শুধু এই ঈদের ৫ দিনে সড়কে ঝরে গেছে অন্তত ৬১ টি তাজা প্রাণ। আহত হয়েছেন কয়েক শত মানুষ। এর মধ্যে সড়ক-মহাসড়কগুলিতে ২৮ জুন ১৯ জন, ২৭ জুন ৪ জন, ঈদের দিন ২৬ জুন ১০ জন, ২৫ জুন ২ জন এবং ২৪ জুন অন্তত ২৬ জন নিহত হন। বলা বাহুল্য এর আগে ২৬ তারিখ ঈদের দিনেও সড়কে প্রাণ যায় অন্তত ১০ জনের।
পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর ঈদকে কেন্দ্র করে সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে গড়ে ১২৫ জন মারা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদ মৌসুমে পরিবহণ চাহিদা বেড়ে যাওয়ার ফলে গাড়ির চাহিদা বাড়ে, পথচারীর সংখ্যা বাড়ে, যাত্রীর সংখ্যা বাড়ে, ছাদের ওপর যাত্রী যায়, আনফিট গাড়ির সংখ্যা বাড়ে, আনফিট ড্রাইভারের সংখ্যাও বাড়ে। এসব কারণে দুর্ঘটনার পরিমাণ বেড়ে যায়। তবে বিশেজ্ঞরা দুর্ঘটনার মূল যেসব কারণ রয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশে রেল ও নৌযোগাযোগ অবহেলিত থাকা এবং মানুষ এখন সড়কপথের ওপর বেশী নির্ভরশীল হয়ে পড়ার কথা বলেছেন বাংলাদেশের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক। তার অভিমত যানজট ও দুর্ঘটনা সমানহারে বেড়েছে। তিনি দীর্ঘ মেয়াদে এই দুটি খাতকে শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, স্বল্প মেয়াদে যানবাহনের চালকদের নিয়মিত বিরতিতে বিশ্রাম দেয়া, ছাদে চড়ার প্রবণতা রোধ করা, এবং সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে কিছুটা হলেও সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব।
ঈদে সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধির যত কারণ :
ঈদে পাঁচ কারণে বেড়ে যায় সড়ক দুর্ঘটনা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ সময় ঘরমুখো মানুষের ঢল নামে দেশের সড়ক-মহাসড়কে। বেড়ে যায় গাড়ি চলাচল। ফলে বাড়ে দুর্ঘটনাও। তাতে হতাহত হন অসংখ্য মানুষ। এসব দুর্ঘটনার ৪৪ শতাংশ ঘটে দুই বা ততোধিক যানবাহনের মধ্যে সংঘর্ষজনিত কারণে। এরমধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষে দুর্ঘটনা ঘটে প্রায় ১৭ ভাগ।
পরিসংখ্যান বলছে, বেশিরভাগ দুর্ঘটনার জন্য মূলত দায়ী চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও অদক্ষতা। এ ছাড়াও সড়কের ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। ঈদের আগে ও পরে ঢাকাসহ সাতটি জেলায় দুর্ঘটনার হার বেশি। দুর্ঘটনায় আক্রান্ত যানবাহনগুলোর মধ্যে ৩৫ দশমিক ২৮ শতাংশই যাত্রীবাহী বাস। গত ঈদের আগেও পরে সারা দেশের দুর্ঘটনার চিত্র পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট (এআরআই)।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, রোজার ঈদের আগের সাত দিন, ঈদের দিন ও ঈদের পরের সাত দিন মোট ১৫ দিনে সারা দেশে ২১০টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে সড়কে ৩১৪ জন নিহত ও ১ হাজার ২১ জন যাত্রী আহত হয়েছেন। শুধু ঈদের দিনেই ২২টি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৩০ জনের আর আহত হয়েছেন ৬৫ জন। ঈদের আগের সাত দিনে ১১০টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ১৬৮ জনের মৃত্যু ও ৬৮১ জন আহত হন। ঈদের পরের সাত দিন ৭৮টি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ১১৬ জনের আর আহত হন ২৭৫ জন।
দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞরা জানান, ঈদে একই সঙ্গে অনেক বেশিসংখ্যক যাত্রী ও গাড়ি সড়কে চলচল করায় পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। এতে দুর্ঘটনা বেশি হয়। গত ঈদের তুলনায় এবার দুর্ঘটনার আশংকা আরও বেশি। কারণ হিসেবে তারা বলেন, কোরবানির ঈদ হওয়ায় একই রাস্তায় যাত্রীবাহী গাড়ির পাশাপাশি পশুবাহী গাড়ির চলাচল রয়েছে। এতে রাস্তায় গাড়ি চলাচলের সংখ্যা বেড়ে গেছে। এছাড়াও বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। বৃষ্টির মধ্যে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালানো ঝুঁকিপূর্ণ। সাম্প্রতিক বৃষ্টির ফলে সড়কের বিভিন্ন স্থানে ভাঙাচোরার সৃষ্টি হয়েছে- যা সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। তারা আরও বলেন, দ্রুত গতিতে গাড়ি চালানো দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হলেও এ বিষয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ১০ আগস্ট সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল বৈঠকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে মহাসড়কগুলোতে যানবাহনভেদে মোটরযানের সর্বোচ্চ গতি ৮০ কিলোমিটার ও ঢাকাসহ অন্যান্য সিটি এলাকায় ৪০ কিলোমিটার নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এ সংক্রান্ত কোনো গেজেট প্রকাশ করা হয়নি। এছাড়া গাড়িতে গতি নিয়ন্ত্রক মেশিন বসাতে সরকারের উদ্যোগ দেখা যায়নি।
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, ঈদের সময় গাড়িতে দক্ষ চালক থাকে না। এছাড়া ঢাকা শহরের গাড়িগুলো অপরিচিত দূরপাল্লার রুটে চলাচল করে। ওই পথের সম্পর্কে চালকদের ধারণা থাকে না। এ কারণে দুর্ঘটনা বাড়ে। তিনি আরও বলেন, ঈদের সময়ে বেশি ট্রিপ দিতে চালকেরা নিয়ম মেনে গাড়ি চালান না। মালিকদের মধ্যেও অতি মুনাফার প্রবণতা থাকে। ঈদের পর অনেক বাসের মূল চালক ছুটিতে থাকে এবং হেলপার গাড়ি চালায়। এ কারণে ঈদের পরও দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে হলে সংশ্লিষ্টদের আরও তৎপর হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি আরও বলেন, মন্ত্রী-এমপিদের নেতৃত্বে জেলা পর্যায়ে সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের কার্যক্রম জোরদার ও স্বেচ্ছাসেবী টিম গড়ে তোলা হলে দুর্ঘটনা কমে আসবে। এ সময়ে সড়ক ও মহাসড়কের কাছাকাছি হাসপাতালগুলোতে ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসক রাখা ও পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের তৎপর থাকার ওপর জোর দেন তিনি।
এআরআইর রিপোর্টে ঈদে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ার জন্য মূলত পাঁচটি কারণ তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দুর্ঘটনার ৪৪ দশমিক ৩০ শতাংশ ঘটে এক বা একাধিক গাড়ির মধ্যে সংঘর্ষজনিত কারণে। এর মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষের হার ১৬ দশমিক ৭০ ভাগ। পথচারীদের অসচেতনতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ২৭ দশমিক ১০ ভাগ, গাড়ির ওপর চালকের নিয়ন্ত্রণ হারানোর কারণে ১২ দশমিক ৯০ ভাগ, সড়কের ত্র“টিজনিত কারণে ৪ দশমিক ৩০ ভাগ এবং সড়কের গাছসহ নানা প্রতিবন্ধকতাসহ অন্যান্য কারণে ১১ দশমিক ৪০ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটেছে।

http://www.dailysangram.com/post/289661-