খন্দকার মাহবুব ; জয়নুল আবেদীন ; মনজিল মোরসেদ
৩০ জুন ২০১৭, শুক্রবার, ১১:৩৭

মোবাইল কোর্ট নিয়ে আইন বিশেষজ্ঞদের অভিমত

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক ক্ষমতা সংবিধান পরিপন্থী

নির্বাহি ম্যাজিস্ট্রেটদের হাতে বিচারিকক্ষমতা প্রদান সংবিধান পরিপন্থী। বিচারিক ক্ষমতা অবশ্যই থাকতে হবে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের হাতে। এর ব্যতিক্রম হলে তা হবে মাসদার হোসেন মামলা ও সংবিধানের মূল চেতনারবিরোধী। সম্প্রতি মোবাইল কোর্ট অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায় সম্পর্কে আইনবিশেষজ্ঞরা এ অভিমত ব্যক্ত করেন। 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি প্রবীণ আইনবিদ খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা ঢালাওভাবে যেভাবে বিভিন্ন অভিযোগে আসামিদের সাজা দিচ্ছেন তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী। কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া তারা ঢালাওভাবে সাজা দিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে যেহেতু বেশির ভাগ অপরাধ আমলযোগ্য, তাই থানায় দিলে বিচারিক আদালত তাৎক্ষণিকভাবে বিচার করে সাজা দেয়ার এখতিয়ার রয়েছে। কোনো অপরাধ সংগঠিত হলে অভিযোগের বিচারের জন্য আদালতে প্রেরণ করা হয়। আদালত বিচার প্রক্রিয়ার যেসব নিয়ম-কানুন রয়েছে তা পালন করে আসামির বিচার করেন। সে ক্ষেত্রে বিচারিক আদালতের বিচারকদের তাৎক্ষণিকভাবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আসামিদের সাজা দেয়ার এখতিয়ার রয়েছে। মোট কথা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক ক্ষমতা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী। তাই হাইকোর্ট বিভাগ যে রায় দিয়েছেন তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার কোনো অবকাশ আছে বলে আমি মনে করি না। সরকারের উচিত হাইকোর্টের রায় সমর্থন করা।
খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, রাষ্ট্রের প্রশাসনিক বিভাগ কখনো বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা মেনে নিতে পারে না। বিশেষ করে নি¤œ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটদের ওপর তাদের যে কর্তৃত্ব ছিল সেই কর্তৃত্ব কোনো অবস্থায় খর্ব করতে ইচ্ছুক নয় তারা। মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর প্রশাসনিক আওতামুক্ত হয়ে বিচার বিভাগ বর্তমানে স্বাধীনভাবে বিচারিক কার্যাবলি পালন করছেন বিশেষ করে নি¤œ আদালতের বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটরা বর্তমানে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আখ্যায়িত এবং দায়িত্ব পালনের ফলে তাদের ওপর প্রশাসনিক কর্তৃত্ব এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তারপরও নি¤œ আদালতের বদলি, পদায়ন, শৃঙ্খলাবিধি বিভিন্ন বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছে। বারবার সুপ্রিম কোর্ট থেকে তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও এখনো নি¤œ আদালতের বিচারকদের ওই বিষয়গুলোর ওপর বিধি প্রণয়ন করা হচ্ছে না।
তিনি বলেন, বিচারিক কর্মকাণ্ড যেখানে বিধান মোতাবেক জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরা করবেন সেই ক্ষেত্রে মোবাইল কোর্টের আওতায় ঢালাওভাবে কথিত ফৌজদারি অপরাধে গ্রেফতার সাজা এমনকি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটরা বর্তমানে করছিলেন। হাইকোর্ট বিভাগ তা বেআইনি ঘোষণা করেছেন।
তিনি আরো বলেন, আমরা মনে করি খাদ্যদ্রব্য ভেজালসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনস্বার্থের খাতিরে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। কিন্তু কোনো অবস্থায় তা স্বাধীন বিচারব্যবস্থার পরিপন্থী হতে পারে না। তাই মেট্রোপলিটন মোবাইল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেটরা যেসব বিচারিককার্য করেন ওইগুলো জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরা করতে পারেন, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। মোবাইল কোর্টের বিচারিকক্ষমতা অবশ্যই জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে অর্পণ করতে হবে, যাতে বিচারিক ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা অুণœ থাকে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর বিচার বিভাগ একটি স্বাধীন সংস্থা। এজন্য মোবাইল কোর্ট জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়ে পরিচালনা করা উচিত। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে বিচারিক ক্ষমতা দেয়া হলে সেখানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব হয়। নির্বাহী বিভাগ সমাজে আইন প্রয়োগে সহায়তা করবে। আইন তাদের হাতে নিবে না। সংবিধান অনুযায়ী তিনটি বিভাগের এখতিয়ার নির্ধারণ করা আছে। এ ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক বিচারিক ক্ষমতার প্রয়োগ সংবিধানের বিপরীত।
এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, মোবাইল কোর্ট যখন শুরু হয় তখন আদালত থেকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ভেজালবিরোধী অভিযান করা হয়। শুরুতে এটা কিছু ভালো কাজ করেছে। কিন্তু এখন মোবাইল কোর্টের দেয়া সাজা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মাসদার হোসেন মামলার রায় অনুযায়ী বিচার বিভাগ স্বাধীন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে সাজা দেয়া বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপের শামিল। তবে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা যায়। আমি মনে করি, মোবাইল কোর্ট থাকা উচিত; তবে তা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে করতে হবে। সেটা সম্ভব না হলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে পুলিশের হাতে দিবেন। বিচারের দায়িত্ব তাদের দেয়া যাবে না।
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, মোবাইল কোর্ট মূলত বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের আন্দোলন থেকে দূরে রাখার জন্য করা হয়। আমরা ২০১২, ’১৩ ও ’১৪ সালে দেখেছি বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধ আন্দোলনে রাজনৈতিক দলের অনেক নেতাকর্মীকে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সাজা দেয়ো হয়েছে। অর্থাৎ মোবইল কোর্ট সৃষ্টি ও পরিচালনা মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে করা হয়েছে। পরে বিভিন্ন সামাজিক ও ব্যবসায়িক কাজেও মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয়। মোবাইল কোর্টে মূলত মাসদার হোসেন মামলার রায়ের চেতনা অর্থাৎ স্বাধীন বিচার বিভাগের মূল কাঠামোতে আঘাত করে এবং সংবিধানের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন অনুচ্ছেদের পরিপন্থী।
সম্প্রতি মোবাইল কোর্ট অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। রায়ে প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌম বিচারিক মতা নির্বাহী কর্মকর্তাদের হাতে দেয়ার ঘটনাকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আক্রমণ বলে অভিহিত করা হয়। রায়ে বলা হয়, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক মতা দেয়া সংবিধানের লঙ্ঘন এবং তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর আঘাত করেছে। এটি মতার পৃথকীকরণ নীতিরও পরিপন্থী। রায়ে বলা হয়, নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে তারা প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌম বিচারিকমতা চর্চা করতে পারেন না।
বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ১১ মে কামরুজ্জামান খান বনাম বাংলাদেশ মামলায় ২০০৯ সালের ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনকে সংবিধান পরিপন্থী ও এখতিয়ারবহির্ভূত হিসেবে ঘোষণা করেন। রায়ে আদালত বাংলাদেশের ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের ৬(১) ধারা উল্লেখ করে বলেন, নির্বাহী কর্মকর্তারা কোনো অবস্থাতেই বিচারিক মতা প্রয়োগ করতে পারেন না। হাইকোর্ট অবশ্য দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিচারিক সেবাদানের স্বার্থে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ধারণাকে সমর্থন করেছেন। তবে শর্ত হলো, এই আদালত অবশ্যই বিচারকদের দ্বারা পরিচালিত হতে হবে।


http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/231775