৩০ জুন ২০১৭, শুক্রবার, ১১:২৯

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প

ব্যয় বেড়েছে ৭৫০০ কোটি টাকা

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যয় এখন সরকারি হিসাবে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) দলিলে এই ব্যয়ের অঙ্ক উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকল্পটির ব্যয় সম্পর্কে আগে যা প্রকাশ হয়েছে, এই ব্যয় তার চেয়ে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা বেশি।
অর্থ, পরিকল্পনা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আলাদা আলাদা সূত্র প্রথম আলোকে বলেছে, রূপপুর প্রকল্পের ব্যয় আরও বাড়বে। তাঁদের কাছে আরও যেসব সম্ভাব্য ব্যয়ের হিসাব রয়েছে, তাতে সরাসরি এই প্রকল্প ও তার আনুষঙ্গিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি স্পষ্ট।
সূত্রগুলো বলেছে, রূপপুর প্রকল্পের ব্যয় সম্পর্কে সরকার স্পষ্ট করে কিছু না বলায় বা বলতে না পারায় এ বিষয়ে শুরুতেই প্রশ্ন উঠেছিল। অনেকে ধারণা করেছিলেন, রাশিয়ার সঙ্গে সই হওয়া সাধারণ চুক্তি (জেনারেল কন্ট্রাক্ট) অনুযায়ী প্রকল্পের যে ব্যয় নির্ধারিত হয়েছিল (১ হাজার ২৬৫ কোটি মার্কিন ডলার বা ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা), সেটাই এই প্রকল্পের সম্পূর্ণ ব্যয়।
রূপপুর প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শৌকত আকবর তখন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, সাধারণ চুক্তিতে যে ব্যয় ধরা হয়েছে, সেটি প্রকল্পের ‘ফার্ম অ্যান্ড ফিক্সড কস্ট’। এই ব্যয় প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদে আর বাড়বে না। তবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তখন বলেছিলেন, রূপপুর প্রকল্পের অনেক ‘হিডেন কস্ট’ অর্থাৎ লুক্কায়িত ব্যয় আছে।
প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ-সমীক্ষা, ভূমি উন্নয়ন, নকশা প্রণয়ন, কতিপয় ভৌত অবকাঠামো তৈরি প্রভৃতির জন্য ব্যয় হয় ৫৫ কোটি ডলার বা প্রায় ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এটা হিসাবে ধরে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৩২০ কোটি ডলার বা ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
রাশিয়া এই ১ হাজার ৩২০ কোটি ডলারের ৯০ শতাংশ ঋণ হিসেবে বাংলাদেশকে দিচ্ছে। অবশিষ্ট ১০ শতাংশ জোগান দেবে সরকার। এ ছাড়া এখন যে ব্যয় বাড়ছে, সেসবই সরকারকে বহন করতে হবে।
ব্যয় বৃদ্ধি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, এডিপিতে কত ব্যয় দেখানো হয়েছে, তা বিস্তারিতভাবে না দেখে বলতে পারবেন না।
আর বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকল্পের আর্থিক ও কারিগরি সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় মোট কত টাকা ব্যয়ের কথা বলা হয়েছে কিংবা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সর্বমোট কত টাকায় বাস্তবায়ন সাপেক্ষে প্রকল্পটি অনুমোদন করেছে, তা আমরা জানি না। তাই প্রকল্পের ব্যয় কতটা বাড়ছে, শেষ পর্যন্ত কত ব্যয় হবে, তা বলা সম্ভব নয়।’
এডিপি দলিলে যে এখন প্রকল্পের ব্যয় ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা বলা বলেছে, এই বাড়তি ব্যয়ের খাত কী? এ বিষয়টি জানতে চাইলে উপরিউক্ত তিন মন্ত্রণালয়ের সূত্রই বলেন, জনবল প্রশিক্ষণ এবং পারমাণবিক অবকাঠামো নির্মাণের কতিপয় কাজে ভারতের সহযোগিতা নিতে এই বাড়তি অর্থের দরকার হতে পারে।
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলতি বছরের ৭ থেকে ১০ এপ্রিল ভারত সফর করেন। এ সময় সই হওয়া চুক্তি (অ্যাগ্রিমেন্ট) অনুযায়ী, ভারত সরকারের পরমাণু শক্তি বিভাগের অধীন গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) ইউনিট ‘গ্লোবাল সেন্টার
ফর নিউক্লিয়ার এনার্জি পার্টনারশিপ (জিসিএনইপি)’ এবং ভারতের ‘অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি বোর্ড (এইআরবি)’ এই সহায়তা দেবে। আর শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচি এগিয়ে নেওয়ার জন্য দুই দেশ পরস্পরকে সহযোগিতা করবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের কয়েক দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের ব্লুমবার্গ টেলিভিশনকে উদ্ধৃত করে ভারতের অনলাইন পোর্টাল ‘লাইভমিন্ট’ এক প্রতিবেদনে বলেছিল, ভারতের সহযোগিতার জন্য বাড়তি ব্যয় হতে পারে ৯৪ কোটি (৯৪০ মিলিয়ন) ডলার। প্রতি ডলার প্রায় ৮০ টাকা হিসাবে এই অর্থের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকাই হয়।
মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলেন, রূপপুর প্রকল্পের ভারী যন্ত্রপাতি ও মালামাল আনার জন্য পাকশী থেকে প্রকল্প এলাকা পর্যন্ত একটি বিশেষায়িত রেললাইন করা হচ্ছে। এ জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ কোটি ডলার (প্রায় ৪০০ কোটি টাকা)। নৌপথে প্রকল্পের ভারী মালামাল পরিবহনের জন্য আরিচা থেকে পাকশী পর্যন্ত নদী খননে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫০ কোটি ডলার (প্রায় ১২শ কোটি টাকা)। রূপপুর থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য স্থিতিশীল লাইন তৈরি করতে হবে। এ জন্য একটি সমীক্ষা করা হয়েছে। তাতে এই কাজের জন্য ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ২৫০ কোটি ডলার (প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা)।
এসব মিলে ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার, যা প্রতি ডলার ৮০ টাকা হিসাবে টাকার অঙ্কে দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকার মতো। অবশ্য এই রেললাইন স্থাপন, নদী খনন ও সঞ্চালন লাইন নির্মাণের ব্যয় রূপপুর প্রকল্পের ব্যয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত না হয়ে রেল, নৌপরিবহন ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের খাতেও যেতে পারে।
তবে এসব ব্যয় ছাড়াও রূপপুর প্রকল্পের প্রথম চার বছর বাদে সমগ্র আয়ুষ্কালজুড়ে জ্বালানি (ইউরেনিয়াম) কেনা ও পরিবহন, স্পেন্ট ফুয়েল ফেরত পাঠানো, রাশিয়ার সঙ্গে সম্ভাব্য পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ (ওঅ্যান্ডএম) চুক্তিভুক্ত কাজ প্রভৃতির জন্য আলাদাভাবে অর্থ ব্যয় করতে হবে। তাতে প্রকল্পের ব্যয় শেষ পর্যন্ত কত হবে, তা এখন বলা সম্ভব নয়। তা ছাড়া এই ব্যয়গুলোকে প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যয়ের হিসাবে না ধরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালন বা চলিত ব্যয় হিসাবে ধরার সুযোগ রয়েছে।
প্রকল্পের মূল পর্যায়ের অর্থায়নের জন্য ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া। ঋণ চুক্তিও হয়ে গেছে। এ ছাড়া সই হওয়া সাধারণ চুক্তির (জেনারেল কন্ট্রাক্ট) শর্ত অনুযায়ী মোট চুক্তিমূল্যের ১০ শতাংশ অগ্রিম হিসেবে রুশ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাটমস্ট্রয়েক্সপোর্ট’কে দিতে হবে। সে অনুযায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা অগ্রিম হিসেবে দেওয়া হয়েছে।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ হাজার ১৮৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।
প্রকল্পের প্রথম পর্বের কাজ (সমীক্ষা, মাটি ভরাট, পাইলিং, অফিস ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ) আগস্ট মাসের মধ্যে শেষ হতে পারে। আগামী সেপ্টেম্বরে প্রকল্পের মূল পর্বের নির্মাণকাজ (ফার্স্ট কংক্রিট) শুরু হবে। এই বিষয়ের খুঁটিনাটি চূড়ান্ত করার জন্য গত মে মাসে রাশিয়ার একটি উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ দল ঢাকা সফর করেছে। এ সময় দুই পক্ষের আলোচনায় মূল পর্ব শুরুর বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেজস্ক্রিয় পারমাণবিক বর্জ্য রাশিয়ার ফেরত নেওয়ার বিষয়ে চুক্তির খসড়া ৫ জুন মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে। এ-সংক্রান্ত চুক্তিটি কবে সই হবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1233416/