৩০ জুন ২০১৭, শুক্রবার, ১১:২৩

চালের বদলে গম

|| আলমগীর মহিউদ্দিন ||

খবরের কাগজে সরকারি বক্তব্য হিসেবে প্রচারিত হয়েছে, এখন চালের বদলে গম দেয়া হবে ভিজিএফে। ভিজিএফ অর্থাৎ ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং, যার বাংলা হলো আক্রম্য বা অরক্ষিত গোষ্ঠীকে খাওয়ানো। অন্য কথায় যারা হতদরিদ্র, খাবার কেনার বা জোগাড়ের ক্ষমতা নেই, তাদের খাওনোর ব্যবস্থা, তবে এ পদ্ধতিতে যারা খাবার অর্থাৎ চাল পেত বা পায়, তাদের নির্ধারিত স্বল্পমূল্যে চাল বিতরণ করা হয়। বিনেপয়সায় না। এ ব্যবস্থাটি চলে আসছে স্বাধীনতার আগে থেকে। এ জন্যই কি ইংরেজি নাম! তাই বা বলি কী করে। এখন ‘সর্বত্র বাংলার’ যুগের যেন ইংরেজি নামে বাহার আরো বেড়েছে। ইংরেজি শব্দগুলো বাংলায় লেখা হচ্ছে। যেমন ‘সাইনবোর্ড’। এর সমার্থক বাংলা শিক্ষিতরাও বুঝবে না, অশিক্ষিতদের বাদই দেয়া যাক। ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ না গেয়ে আসল কথায় আসা যাক।
চাল নিয়ে তেলেসমাতির প্রমাণ এই ভিজিএফ পদ্ধতি, যার বিশ্লেষণে দেখা যাবে ক্ষমতাবান, ক্ষমতাপ্রয়াসী ও ভুক্তভোগী সবাই এ বিষয়ে সম্পৃক্ত। স্বাধীনতা-উত্তরকালে গরিব-অসহায় মানুষদের সাহায্যের জন্য এ পদ্ধতি চালু হয়। নিঃসন্দেহে এটা প্রশংসাযোগ্য। তবে সাধারণত যা এ দেশে ঘটে থাকে লোহায় মরিচা পড়ার মতো। ভালো জিনিস, পদ্ধতি বা কর্মকাণ্ডে মরচে পড়তে থাকে। লোহা যেমন মুক্তবাতাসের শুদ্ধ অক্সিজেন পেলে মরিচা ছাড়তে শুরু করে, এই ভিজিএফের অবস্থাও তাই হয়ে গেল। মরিচার মতো জীবনের অঙ্গ হয়ে গেল।
এর জন্ম চালের অভাব মেটানোর চেষ্টা হলেও সম্পৃক্তজনদের কাছে লাভের পথ হিসেবে আবির্ভূত হলো। ফলে ব্যবস্থাটি স্থায়ী হয়ে গেল। যেহেতু গরিব-অসহায় মানুষ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকল, তাই এ ব্যবস্থা বন্ধ করার প্রয়োজন পড়ল না। তখন গম এ দেশে হতোই না বলা চলে। তবে দেশের অপর অংশ থেকে এর আমদানি ছিল সহজ, তাই এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহজ হলো। সেই সাথে এখানে এর চাষের দিকেও লক্ষ্য দেয়া হলো। দেশের উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক চাষ হতে থাকল। তখন শুধু ধান নয়, গমও এ দেশের প্রধান উৎপাদিত শস্য হয়ে গেল। তবে প্রণিধানের বিষয় হলো, সবখানেই সেই একই প্রশ্ন : ‘আমার কী লাভ?’ আসলে এ প্রশ্ন যেমন এ দেশের ভাষায় প্রধান প্রকাশ, তেমনি জনমানসের চিন্তার ভিত্তির এক বিরাট অংশ। যেকোনো কাজ করতে গেলেই প্রথম প্রশ্ন ওঠেÑ ‘আমার কী লাভ?’ যেন জীবন সব সময় লাভ-লোকসানের হিসাব, অন্যগুলো গৌণ।
সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতর বলেছে, যেহেতু সরকারি গুদামে চালের মজুদ খুবই কম, তাই গম দেয়া হবে যাতে গরিব মানুষ ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে। সরকারি কর্মকর্তা বলেছেন, আপৎকালীন মজুদ হিসেবে ১০ লাখ টন গম-চাল সরকারি গুদামে থাকে। এখন তা এক লাখ টনে নেমে গেছে। তাই গম দেয়ার চিন্তা। তবে নতুন সরবরাহ না হলে এখানেও টান পড়তে পারে। সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেছিলেন, মজুদ ব্যবস্থায় কেন টান পড়ল? সংগ্রহ কেন করা হয়নি? তার জবাবে তিনি বলেছেন, উৎপাদন কম হয়েছে, আবার হাওরে আকস্মিক বন্যা, বোরো ধানে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ, সারা দেশে অতি বৃষ্টি অবস্থা সঙ্গিন করেছে। এ অবস্থা কি এ দেশে নতুন? ভিজিএফ ব্যবস্থার উৎপত্তি প্রমাণ করে এ অবস্থা নতুন নয়। আর সরকারি গুদামে খাদ্যের ঘাটতি হওয়াও নতুন নয়।
যে অবস্থা নতুন নয় এবং সবার গা-সওয়া হয়ে গেছে, তা হলো মুনাফাখোরদের কর্মকাণ্ড। তাদের দোষ দেয়া যায় নাÑ কারণ তারা মুনাফার জন্যই ব্যবসায় করে, তাদের কর্মকাণ্ড চালায়। তারা জনজীবন দুর্বিষহ না করে তুলতে পারে, তার জন্য থাকে সরকারি ব্যবস্থা। যুগে যুগে দেখা গেছে, সরকারি ব্যবস্থা এই মুনাফাখোরদের নিয়ন্ত্রণের নামে অনেক স্থলে এদের বাহন হয়ে পড়ে। তখনই সব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সংবাদমাধ্যম আমাদের অর্থমন্ত্রীর ভাষায় ‘চিৎকার-চেঁচামেচি’ করে। অর্থমন্ত্রীকে সবাই ধন্যবাদ দেয় তার এমন সাধারণ মানুষের ভাষা গণ্ডির সরকারি ডায়ালগে ব্যবহারের পারঙ্গম দেখে। তার বিভিন্ন ব্যবস্থায় দাম বাড়ানোর কৌশলকে সহায়তা করে ব্যবসায়ীরাও খুশি। যেমন এবারে কয়েকটি করের কথা বললে ব্যবসায়ীরা তেমন উচ্চবাচ্য করেননি, বরং সরকারি কর্মকর্তারাই তাদের ঐচিত্যের বাইরে গিয়ে বক্তব্য দিয়েছে। অনেকেই এতে বিভ্রান্ত হয়েছেÑ তবে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর সুযোগটার জন্য তাকে ধন্যবাদ দিয়েছে।
যা বলছিলাম, সংবাদমাধ্যম চালের দাম বেড়ে যাওয়াকে লাগামহীন বলে লিখেছে। সেই সাথে গরিবের কষ্টের কথাও লিখেছে। অবশ্য তারা তাই লিখে থাকেন। কারণ, তারা সাধারণ মানুষের কথা ভাবেন ও লিখেন বলে মনে করে থাকেন। সরকারি দফতর যেমন এক দিকে তাদের এসব সঠিক তথ্য দেয়ার জন্য প্রকাশ্যে বক্তব্য দেয়, তেমনি কঠোর নজর রাখে, এর কারণ লিখতে গিয়ে যেন বিস্তৃত সত্য তথ্যের অবতারণা না করেন।
এই দাম বাড়ানোর কথা লিখতে গিয়ে মনে পড়ল চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের কথা। দেশের উত্তরাঞ্চলে কয়েক লাখ (সরকারি হিসাবে কয়েক হাজার) লোক না খেয়ে, স্বল্প খেয়ে এবং তার জন্য অসুস্থ হয়ে মারা যায় বলে খবর বের হয়। এই দুর্ভিক্ষপীড়িত এলাকায় এক সাংবাদিক অনুসন্ধানে গিয়ে চমৎকার বিষয় আবিষ্কার করেন। চার দিকে ুধার্ত মানুষেরা মারা গেলেও সাদুল্লাহপুরে একজন মানুষও মারা যাননি। এর কারণটাই হলো চমৎকার বিষয়। সেখানকার মহকুমা হাকিম একজন সমাজকর্মী ছিলেন। তার থিওরি ছিল, জনগণকে নিজেদের বিষয়ে ভাবতে এবং কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে দিলে, তারা সেটা সঠিকভাবে করে এবং নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে পারে সহজেই। তিনি সাদুল্লাহপুরে এই পরীক্ষাটি করেন। তিনি সমাজকর্মী ও উৎসাহীদের নিয়ে গ্রামসরকার এবং থানাসরকার গঠন করেন। এ সরকারের কর্মকাণ্ডে প্রচলিত সরকারি ব্যবস্থা কোনোক্রমেই সংশ্লিষ্ট হবে না এবং হস্তক্ষেপ হবে। গ্রামসরকারে একজন প্রেসিডেন্ট থাকবেন, মন্ত্রিসভা থাকবে এবং বিভিন্ন বিষয়ে মন্ত্রী থাকবে। সেখানের রাস্তার পাশের এবং অন্যান্য জায়গার সরকারি জায়গাগুলো ভূমিহীন ও গরিব কৃষকদের মাঝে ভাগ করে দিলেন এবং কৃষকদের বললেন তাদের কী করতে হবে। আর থানাপর্যায়ের সরকারি কর্মচারীদেরও এতে সম্পৃক্ত করলেন। যেমনÑ থানার দারোগাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, থানা হেলথ অফিসারকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইত্যাদি পদবি দিলেন এবং গ্রাম ও থানা সরকারের নিয়মিত বৈঠকে নানা বিষয় আলোচনা ও ব্যবস্থা নেয়া হতে থাকল। শিগগিরই সারা এলাকায় ফুল-ফসলে ভরে উঠল এবং এলাকায় কেউ বেকার থাকল না। বিষয়টি সরকারের দৃষ্টিগোচর হলে সে বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু হলো এবং একপর্যায়ে গ্রামসরকার ও থানাসরকার গঠনের কথা ঘোষণা করা হলো। সাদুল্লাহপুরে এ গ্রাম ও থানাসরকারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ড ছিল চালের অভাব দূর এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণ। এর পটপরিবর্তন হলো। কারণ বহু পুরনো। কায়েমি স্বার্থ। এর মাঝে প্রতিষ্ঠিত সরকারের কর্মচারী, রাজনৈতিক দলসংশ্লিষ্ট। কারণ গ্রামসরকারে কোনো রাজনৈতিক দল বা সরকারি কর্মচারীরা নিজ পদে বা মতামত নিয়ে কাজ করতে পারে। এ ঘটনায় স্মৃতিচারণের উদ্দেশ্যে এ দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য চালের উৎপাদন, নিয়ন্ত্রণ ও বিপণনের কায়েমি স্বার্থের একটা ুদ্র চিত্র তুলে ধরা। এ অবস্থা থেকে বের হতে হলে দু’টি স্বাধীনতা একান্তভাবে প্রয়োজন। তা হলো অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও ভোক্তাদের এ দু’টি স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ ভোগ করতে দিতে হবে। সাদুল্লাহপুরের মানুষ যখন এ দু’টি স্বাধীনতা স্বল্পকালীন সময়ের জন্য হলেও ভোগ করেছিল তখন নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে জনগণের কাছে ছিল। তাই কোনো অন্যায় কাজ হয়নি, চুরি-ডাকাতি-ঘুষসহ সব অনাচার বন্ধ ছিল। ইংরেজিতে যাকে বলে ম্যানেজমেন্ট বা ব্যবস্থাপনায় কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি। কোনো কায়েমি স্বার্থে ব্যবহৃত হয়নি। ফলে স্বল্পমূল্যে চাল সবার কাছে পৌঁছে ছিল। অথচ এই এলাকার পাশেই সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় খাদ্যাভাবের সুযোগ কায়েমি স্বার্থ ব্যবহার করে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করে। তাই যখনই কোনো সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয় বা সাধারণ কোনো সমস্যার উৎপত্তি ঘটে, এটা ধারণা করা অস্বাভাবিক হবে না, এর মূলে ব্যবস্থাপনার ঘাটতি। এবারের খাদ্যঘাটতি ও দাম বেড়ে চলার পেছনে প্রধান কারণ এর অভাব ধারণা করা যায়। মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা শুধু এর সুযোগ নিয়েছেন। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, চালের উৎপাদনের অগ্রগতি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। এক সময়ে একই জমিতে যা উৎপাদন হতো তার চেয়ে এখন উৎপাদন কয়েক গুণ বেশি। এর জন্য গবেষক-বিজ্ঞানী ও সংস্থা বিরিকে ধন্যবাদ দিতে হয়। ১৯৭০ সালে স্থাপিত এই সংস্থা এ পর্যন্ত ৫৭টি উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত উপহার দিয়েছে। এবার বিরি তিনটি নতুন জাতের উদ্ভাবন করেছে। এরা হলো ব্রি-৮০ (বৃষ্টিনির্ভর রোপা আমন), ব্রি-৭৯ (জলমগ্ন তিন সপ্তাহ ডুবে থাকা সহনশীল জাত) এবং ব্রি-৬ (ইরি ও ব্রি ক্রস আমন মওসুমের ধান)। এখন দেশের ৮০ শতাংশ জমিতে ব্রি-ধানের চাষ হচ্ছে এবং বিশ্বের ১৯টি দেশে এসব ধান চাষ হচ্ছে। ১৯৭১ সালে এসে এক কোটি ৬০ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়ে খাদ্যাভাবের চাপ কমিয়ে দেয়। এখন এর উৎপাদন দুই কোটি ৫০ লাখ টনে পৌঁছেছেÑ যদিও জনসংখ্যার চাপে জমির আকার ছোট হয়ে পড়েছে। এখন উৎপাদিত ধান প্রয়োজন মেটালেও ২০২০ সালে হয়তো সমস্যার সৃষ্টি হবে। কেননা তখন নতুন তিন কোটি লোক জনসংখ্যার সাথে যোগ হবে। তাই খাদ্যাভাব মেটাতে বর্তমানে প্রতি হেক্টরে ২.৭৪ টন থেকে বাড়িয়ে ৩.৭৪ টন উৎপাদন করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্তত সাতটি ব্যবস্থা নিলে খাদ্যাভাব অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভবÑ ০১. স্থানীয় জাত (যা এখন ৩৫% সীমিত) বাদ দিয়ে উন্নত জাত আমন মওসুমে লাগাতে হবে, ০২. বোরো মওসুমে আধুনিক জাতের সীমিত করতে হবে, ০৩. বর্তমানের জাতগুলো নতুন উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল দিয়ে পরিবর্তন করতে হবে, ০৪. বোরো ও আমনের সময় সেচব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে, ০৫. নয়া উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলোর ব্যাপক ব্যবহার করতে হবে; ০৬. বীজ ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে, ০৭. ফসল কাটার পরের নানা প্রতিবন্ধকতা ও ক্ষতিগুলো এড়াতে যান্ত্রিকীকরণের চেষ্টা নিতে হবে।
একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন, বিতরণ ও বিপণনে মনিটরিং খুবই দুর্বল। এটা চলমান পদ্ধতিতে হতে হবে।
বিশেষ করে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়া, জমির আকারের ক্রমবর্ধমান সীমিত হওয়া, নতুন জাতের আগমন ইত্যাদি গভীরভাবে মনিটরিং করতে হবে। এখন এগুলো বাইরের দেশ শক্তিশালী করছে বলে রিপোর্টে বলা হয়। আসল কথা, সতর্ক থাকতে হবে সব সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে। তাহলে চালের বদলে গমের কথা বা হঠাৎ খাদ্যাভাব হওয়ার সম্ভাবনা হবে কম।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/231677