২৯ জুন ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১২:০৬

চাল নিয়ে চালবাজি

নেপথ্যে কি বেসিক ব্যাংকের লুণ্ঠিত পুঁজি

সরকারিভাবে চাল আমদানীর তোড়জোড় এবং সেই সাথে চাল আমদানীর জন্য পুর্বে নির্ধারিত ২৮ শতাঙ্ক শুল্ক কমিয়ে তা ’ ১০ শতাশ করার খবরে এক সপ্তাহ জুড়ে বগুড়া
হ উত্তারঞ্চলের হাট বাজারে চালের দরে স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। তবে ঈদের ছুটি ও তার পরেই নিয়মিত সাপÍাহিক ছুটি শেষ হবার পরে বাংলাদেশ-ভারতের স্থলবন্দরগুলো দিয়ে চাল আমদানী শুরু হলে কমে যাবে চালের দাম। স্থল বন্দরগুলোতে কাষ্টম ক্লিয়ারিং জটিলতামুক্ত হলে এবং পণ্যবাহী ট্রাকে পথে পথে পুলিশী হয়রানি ও চাঁদাবাজী বন্ধ হলে কেজি প্রতি চালের দর কমপক্ষে ১০ টাকা কমে যাবে বলে দাবি করেছেন সং¯িøষ্ট আমদানীকারক ও ব্যবসায়ীরা।

এদিকে বৈরী প্রকৃতির কারণে চলতি মওশুমে দেশের বিভিন্নস্থানে বোরো আবাদে বিপর্যয় ও ফলন কম হওয়ার কারণে এক শ্রেণীর মজুদদার বেসিক ব্যাংকের লুটের টাকা এবং বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকের ওডি স্যাঙ্কশান ’ এর পুঁজি ব্যবহার করে ধান কিনে নিয়ে চাল তৈরী ও মজুদ করে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরী করে চালের বাজার অস্থির ও অস্থিতিশীল করে তুলেছিল বলে জানা গেছে ।
গতকাল বুধবার বগুড়ার খুচরা বাজারগুলোতে চালের দর সম্পর্কে তথ্য নিতে গেলে বগুড়া শহরের মালতীনগর বখশী বাজারে মুদি ও চাল ব্যবসায়ী রতন জানায়, গত তিন মাস ধরে বগুড়ায় প্রতিদিনই একটু একটু করে চালের দাম বাড়তে থাকলেও গত এক সপ্তাহ যাবৎ চালের বাজার সম্পূর্ণ স্থিতিশীল রয়েছে। একই ধরনের তথ্য দিয়েছেন , বগুড়ার ফতেহ আলী বাজার , রাজাবাজার, কালিতলা হাট, খান্দার বাজার , গোদারপাড়া চার মাথা বাজারের খুচরা ও পাইকারী চাল ব্যবসায়ীরা। এই ব্যবসায়ীরা বাড়তি আরো জানান যে , তারা শুনেছেন , চালের আমদানী শুল্ক কমেছে । আমদানীকারকরা ভারত থেকে চাল আমদানী করছেন । তাই আমদানীর চাল বাজার আসার খবরেই চালের বাজার স্থিতিশীল রয়েছে । আমদানীর চাল বাজারে আসলে তাই চালের দাম ও কমবে ।
বগুড়া চেম্বারের ভাইস প্রেসিডেন্ট এনামুল হক দুলাল বলেছেন , চাল আমদানীর শুল্ক কমানোর পর বগুড়ার যেসব আমদানীকারক এতদিন হাত গুটিয়ে বসেছিল তারা এবার গা’ ঝাড়া দিয়ে উঠেছে । ব্যাংকে তারা ঋণপত্র খুলছে । বাংলাদেশ ব্যাংকের বগুড়া শাখার এলসি মনিটরিং শাখা থেকেও বগুড়া , জয়পুর হাট , নওগাঁ , ঈশ্বরদী ও সৈয়দপুরের কয়েকশ’ বড় আমদানীকারকের ঋণপত্র খোলার তথ্য রয়েছে বলে জানা গেছে ।

বগুড়ার বৃহত্তম আড়তদার , ব্যবসায়ী ও আমদানীকারক আলহাজ্ব আব্দুল গফুর জানিয়েছেন, সরকার চালের আমদানী শুল্ক কমানোর পরপরই আমদানী ঋণপত্র খোলার হিড়িক পড়েছে । উত্তারঞ্চলের হিলি, বুড়িমারি ও সোনামসজিদ স্থল বন্দরের ভারতীয় অংশে ইতোমধ্যেই চাল বাহী শতশত ট্রাাক এসে বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে ।
হিলি স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ সুত্র জানিয়েছে , এই বন্দর দিয়ে ঈদের ছুটি শুরুর আগেই ১০ হাজার মেট্রিক টন ভারতীয় চাল ঢুঁকেছে। ঈদের ও ঈদের পরের সাপ্তাহিক ছুটি শেষ হলেই পরবর্তি ৫দিনে বিভিন্ন স্থল বন্দর দিয়ে বিপুল পরিমাণে চাল ঢুঁকবে দেশে বলে তথ্য নিশ্চিত করেছে সুত্রটি।

উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকজন আমদানীকারক বলেছেন , চালের আমদানী শুল্ক কমালেই শুধু হবেনা , সেই কাষ্টম ক্লিয়ারিং এ যেন হয়রানী / জটিলতা না হয় তা’ নিশ্চিত করতে হবে । পাশাপাশি চাল সহ সব ধরণের পণ্যবাহী ট্রাক ও যানবাহণে পথে পথে পুলিশী হয়রানী ও চাাঁদাবাজী বন্ধ করতে হবে । তারা দাবী করেছেন , যদি কাষ্টম ক্লিয়ারিং এ হয়রাণী জটিলতা ও পথে পথে হয়রাণী চাঁদাবাজী বন্ধ হয় তবে আগামী সপ্তাহে চালের দাম কেজিতে ১০ টাকা কমে যাবে ।
এদিকে ধান চালের কথিত সঙ্কটের অজুহাতে বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের হাটে বাজারে চালের মুল্যবৃদ্ধির জন্য বিএনপি সমর্থিত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মহল বিশেষ কর্তৃক অভিযোগের আংগুল তোলা হলেও বাস্তবে এই কৃত্রিম সঙ্কটের পেছনে বরং সরকার সমর্থক ও বেসিক সহ অন্যান্য ব্যাংক লুটের সাথে জড়িতদের একটি সিন্ডিকেটই জড়িত বলে ব্যবসায়ী মহলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে ।
বগুড়ার ব্যবসায়ী মহলে শোনা এই গুঞ্জনের বিষয়ে অনুসন্ধানকালে নিশ্চিত হওয়া গেছে বগুড়ার সরকার সমর্থিত হিসেবে সর্ব মহলে সুপরিচিত এক মাড়োয়ারী সহ ৩ জন ব্যাবসায়ী বেসিক ব্যাংকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ৩শ’ কোটি টাকা। এই ৩ ব্যবসায়ীর ঘনিষ্ঠ একটি ব্যবসায়ী চক্র যারা অটোরাইস মিল, ফ্লাওয়ার মিল, চাতাল ব্যবসা ও আমদানীর সাথে জড়িতরাই বিপুল পরিমাণ পুঁজির অঙ্ক প্রথমত ভারত থেকে যন্ত্রপাতি এনে বগুড়াসহ বিভিন্ন স্থানে ঢেউটিনের বিশাল বিশাল গোডাউন, অটো রাইস ও ফ্লাওয়ার মিল স্থাপন করেছে। আর এসব যন্ত্রপাতি আমদানীর নামে ওভার ইন ভয়েসের মাধ্যমে ব্যাংক লুটের টাকার বিপুল পরিমাণে পুঁজি পাচার করেছে। ওভার ইন ভয়েস ছাড়াও হুন্ডির মাধ্যমে ব্যাংক লুটের টাকা পাচারের কাজে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছে চিহ্ণিত একটি মাড়োয়ারি চক্র। বর্তমানে ধান চালের গোপন মজুদ ও কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির পেছনেও রয়েছে সংশ্লিষ্ট মাড়োয়ারি চক্রটি বলে পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

এদিকে ধানচালের বাজার সম্পর্কে অনুসন্ধানকালে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বোরো ফলনের ঘাটতি যাই হোক না কেন বগুড়া ছিল তার ব্যতিক্রম। কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্য বগুড়ায় এবছর ১ লাখ ৯০ হাজার ১শ’ ৮ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও চাষ হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার ৪শ’ ৫০ হেক্টর। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও সাড়ে ৩শ ’ হেক্টর বেশি জমিতে চাষ হয়েছে বোরো। আবার ৭ লাখ ৫০ হাজার ১শ’ ২২ মেঃ টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৭ লাখ ৬৪ হাজার ৬শ’ মেঃ টন ধান উৎপাদন হয়েছে। যা’ লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ১৪ হাজার ৫শ’ মেঃ টন বেশি । অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হল বগুড়ায় এবার বোরো মওশুমে বগুড়া জেলায় ৬২ হাজার মেঃ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সংগৃহীত হয়েছে মাত্র ৬ হাজার ২শ’ মেঃ টন চাল। যে কারণে চালের মজুদ বগুড়ায় উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁচেছে । বগুড়ার ২২টি এলএসডি এবং একটি সিএসডি গোডাউনের ধারণ ক্ষমতা ১ লাখ ৩৩ হাজার মেঃ টন হলেও বগুড়ায় বর্তমানে ধান / চাল/ গমের মজুদ মাত্র ১৮ হাজার ৮ শ’ মেঃ টন।

বগুড়ার বিভিন্ন গ্রাম ও ইউনিয়ন পর্যায়ে খবর নিয়ে দেখা গেছে , সরাসরি বেসিক ব্যাংকের অর্থলুটের সাথে জড়িতদের অটোরাইস মিলসহ এই চক্রের সাথে সংশ্লিষ্ট মজুদদাররা গ্রামে গ্রামে ট্রাক পাঠিয়ে সরাসরি কিছুটা চড়া দরে ধান সংগ্রহ করেছে । ফলে মওশুমের শুরুতেই বগুড়ার বাজারে মারাত্মক ধান সঙ্কটের সৃষ্টি হয়। আর এই ধান সঙ্কটের ফলেই মুলত বগুড়ায় শেষ পর্যন্ত সরকারি ভাবে ধান চাল সংগ্রহ অভিযান ব্যর্থ হয় আর বাজার দরেও সৃষ্টি হয়েছিল ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা।

https://www.dailyinqilab.com/article/85308