২৯ জুন ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১২:০৩

কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়!

তারাগুনিয়া জুনিয়র গার্লস হাই স্কুল। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার এই নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তিনটি শ্রেণিতে (ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম) শিক্ষার্থী ১৩০ জন। তবে বিদ্যালয়টি নতুন কোনো শ্রেণি ও শাখা আর খুলতে পারছে না। কারণ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এ ধরনের বিদ্যালয়ের শ্রেণি ও শাখা খোলা বন্ধ রাখা হয়েছে। এদিকে নতুন শ্রেণি-শাখা খুলতে না পারায় এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি আটকে আছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, নাকি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়_ কোথা থেকে এসব বিদ্যালয়ের শ্রেণি-শাখার অনুমোদন দেওয়া হবে, তা নিয়ে ঠেলাঠেলি চলছে এ দুই মন্ত্রণালয়ের ভেতর।

এক বছর আগে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ঘোষণা দিয়েছিলেন, সারাদেশের সাড়ে তিন হাজার নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় দেখভালের দায়িত্ব তারা (শিক্ষা মন্ত্রণালয়) প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করছেন। কেউ নতুন শ্রেণি ও শাখা খোলা এবং শিক্ষক এমপিওভুক্তি বিষয়ে আবেদন করলে তা ওই মন্ত্রণালয় নিষ্পত্তি করবে। তবে বাস্তবে গত এক বছরে সেখান থেকে এ বিষয়ে কোনো আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়নি। এ প্রসঙ্গে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা স্তর এখনও চালু হয়নি। তাই বিষয়টি তাদের এখতিয়ারভুক্ত নয়।


তারাগুনিয়া জুনিয়র গার্লস হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবদুল আলীম সমকালকে জানান, ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত ওই বিদ্যালয় ২০১০ সালে এমপিওভুক্তি পেলেও নানা জটিলতায় এতদিন তারা বেতন-ভাতা পাননি। কিছুদিন হলো তা

চালু হয়েছে। এখন তারা চাইছেন নবম ও দশম শ্রেণি চালু করতে। অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয় আবেদনই জমা নিচ্ছে না। একই উপজেলার ডা. একরামুল হক নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. তসলিম উদ্দিন সমকালকে বলেন, 'নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় নিয়ে সারাদেশে এক জগাখিচুড়ি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের পর সরকার বলেছিল, ২০১৮ সালের মধ্যে জাতীয় নীতি বাস্তবায়িত হবে। এখন বলছে ২০২১ সালের কথা। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা চালুর সময় নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তহীনতায় সারাদেশের প্রায় পাঁচ হাজার নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সব প্রশাসনিক কাজ আটকে আছে। নতুন নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপনেও সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।'

দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে টানাহেঁচড়া :অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা কার্যকর হলে বর্তমান নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোই (জুনিয়র হাই স্কুল) প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিণত হবে। এসব বিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সরকারের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট দুটি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে টানাহেঁচড়া চলছে প্রায় দুই বছর ধরে।

সারাদেশে বর্তমানে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা চার হাজার ৩৬৫টি। গত বছরের ১৮ মে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক যৌথ সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, প্রাথমিক শিক্ষা স্তর উন্নীত হবে অষ্টম শ্রেণিতে। জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সেদিন বলেছিলেন, 'এখন থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় থাকবে। সেখানেই ঠিক হবে_ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস, পরীক্ষা, সিলেবাসসহ সব বিষয় কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন হবে।' প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজারও তখন বলেছিলেন, 'অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের সব কার্যক্রম আমাদের কাছে দেওয়া হয়েছে। আজকের তারিখ থেকে এ কার্যক্রম শুরু করে দিলাম। নতুন অর্থবছরের আগেই আনুষঙ্গিক সব ঠিক করে ফেলা হবে। এ জন্য সবার সহযোগিতা চাইছি।'

অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয় এমন এমপিওভুক্ত ৫৫৩ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও নন-এমপিওভুক্ত এক হাজার ৮২৮টি নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তখন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সভায় জানানো হয়, এই সিদ্ধান্তের ফলে চার হাজার ৩৬৫টি বেসরকারি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলে যাবে। তবে বাস্তবে এ কাজ গত ১৩ মাসেও হয়নি।

ওই সভায় প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একই বছরের ২১ জুন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান আবারও জানান, পঞ্চমের সমাপনী পরীক্ষাও ২০১৬ সাল থেকে বাতিল হবে এবং অষ্টম শ্রেণিতে প্রাথমিক সমাপনী হবে। কিন্তু ওই বছরের ২৭ জুন মন্ত্রিসভা 'অষ্টম শ্রেণিতে প্রাইমারি স্কুল সার্টিফিকেট (পিএসসি) পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করে পঞ্চম শ্রেণি পর্যায়ে বিদ্যমান প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল'-এর প্রস্তাব অনুমোদন না দিয়ে তা আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে উপস্থাপনের নির্দেশ দেয়। পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা ও অষ্টম শ্রেণির জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা আগের মতোই বহাল থাকবে বলে সিদ্ধান্ত দেয় মন্ত্রিসভা।

নতুন নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপনেও নিষেধাজ্ঞা :এদিকে গত ২৫ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সালমা জাহান স্বাক্ষরিত এক আদেশে নতুন নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপনেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এতে নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার সামগ্রিক বিকাশ ও সম্প্রসারণ কাজও থমকে গেছে। নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার এই বন্ধ্যত্ব কাটাতে ও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা চালুর বিষয়ে সর্বশেষ গত ১৬ মে দুই মন্ত্রণালয়ের এক যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করতে সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে প্রস্তাব চূড়ান্ত করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আলমগীরের নেতৃত্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত এ কমিটির প্রস্তাব সার-সংক্ষেপ আকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করা হবে। পরে তা মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। তবে এসব বিদ্যালয়ের কী হবে, সে সম্পর্কে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

গত ১৪ জুন এসব বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক-১) রুহী রহমান সমকালকে বলেন, 'নিম্ন মাধ্যমিক এসব বিদ্যালয় নতুন স্থাপনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে কি-না, শ্রেণি ও শাখা খোলার অনুমতি দেওয়া হবে কি-না, দিলে কোন মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেবে, এসব বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। দুই মন্ত্রণালয় বসে আলোচনা করে এসব ঠিক করবে বলে জানান তিনি।

http://bangla.samakal.net/2017/06/29/303892