২৯ জুন ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১২:০০

আবাসিকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণ থমকে আছে

মন্ত্রিসভায় ৬ মাসের মধ্যে অপসারণের সিদ্ধান্তের পর বছর পার

আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণে মন্ত্রিসভার বেঁধে দেয়া ছয় মাস সময় পার হয়েছে আরও ছয় মাস আগেই। এক বছরের মাথায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের অগ্রগতি সামান্যই। প্রথম দিকে সংস্থাগুলোকে কিছুটা তৎপর মনে হলেও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুই যেন ঝিমিয়ে গেছে।

গত বছরের ৪ এপ্রিল মন্ত্রিসভার বৈঠকে আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ছয় মাসের মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠান অপসারণের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রণালয়কে। তিন দিন পর ৭ এপ্রিল

এলজিআরডিমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন সংবাদ সম্মেলন করে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণের বিস্তারিত তুলে ধরেন। সমন্বয়ের জন্য এলজিআরডি সচিবকে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় কমিটি। ওই কমিটি প্রথম দিকে ১৫ দিন অন্তর সমন্বয় সভা করত। এখন মাঝে মধ্যে সভা হলেও কাজের অগ্রগতি নেই বললেই চলে। তবে গত রোববারও এ সংক্রান্ত সর্বশেষ সভা হয়েছে।

সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রথম দিকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণে দেশের ১১টি সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভা সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঢাকাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মাঠে নামে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন, গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদফতর এবং জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। ঢাকা শহরে সর্বত্র সাড়া পড়ে যায়। সক্রিয় হয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের পর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরে যেতে নোটিশ করে। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) বেশ কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ট্রেডলাইসেন্স বাতিল করে দেয়। রাজউকও ভবন মালিকদের উচ্ছেদের নোটিশ দেয়। তবে, রাজউকের কার্যক্রম কেবল গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় স্থাপনা উচ্ছেদ, র্যা ম্প অপসারণ ও ফুটপাত দখলমুক্ত করার কাজে ঘুরপাক খায়- যা এখনও কিছুটা সচল আছে। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের কোনো তৎপরতা এখন চোখে পড়ছে না। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামসহ অন্য সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভায়ও একই অবস্থা।

জানতে চাইলে নগর বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক যুগান্তরকে বলেন, রাজধানীর আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরানোর মূল কাজ করতে হবে রাজউককে। তবে এ ধরনের কাজে রাজউকের যথেষ্ট অনীহা রয়েছে। নগরবাসীর কাছে এটি পরিষ্কার। এর জ্বলন্ত উদাহরণ মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করা। রাজউকের ন্যূনতম ইচ্ছে থাকলে বেঁধে দেয়া ছয় মাসে শতভাগ না পারলেও বড় অংশ সরানো সম্ভব হতো।

তিনি জানান, সরকারের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হলে আবাসিক এলাকার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সাহস বেড়ে যাবে। তারা নতুন উদ্যমে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে। এজন্য সরকারের শীর্ষ পর্যায়কে এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরামর্শ দেন ওই নগর বিশেষজ্ঞ।

এ প্রসঙ্গে রাজউকের নতুন চেয়ারম্যান আবদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্তের আগ থেকেই রাজউক আবাসিক এলাকার বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধে কাজ শুরু করে। তবে মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্তের পর এ তৎপরতা আরও জোরালো করা হয়েছে- এটা অব্যাহত রয়েছে। এটা নতুন করে জোরদার করা হবে।

তিনি আরও বলেন, আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণের নোটিশ দেয়ার পর থেকে অনেকে মামলা করে স্থগিতাদেশ এনেছেন। সেসব মামলাও আইনগতভাবে মোকাবেলা করা হবে।

এ ব্যাপারে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেজবাহুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে শুরু থেকে ডিএনসিসি জোরেশোরে কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে। রেস্টুরেন্ট, শপিংসেন্টারসহ অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণ করা হয়েছে। তবে মামলা জটিলতায় কাজ এগিয়ে নেয়া যাচ্ছে না। এসংক্রান্ত কাজের জন্য ডিএনসিসি মেয়রের বিরুদ্ধে দু’শতাধিক মামলা হয়েছে। এসব মামলা মোকাবেলা করে আমাদের এগোতে হচ্ছে। তিনি বলেন, মাঠের সবশেষ চিত্র এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রতি মাসে মন্ত্রিসভাকে অবহিত করা হচ্ছে। আইনি জটিলতা নিরসন না করলে তো কোনো প্রতিষ্ঠানকে আমরা সরিয়ে দিতে পারি না।

এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল যুগান্তরকে বলেন, মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমরা ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ট্রেডলাইসেন্স বাতিল করেছি। অনেক ক্ষেত্রে রাজউককে সহায়তা করছি। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার আলোকে কার্যক্রম পরিচালনা করছি। তবে এটা করতে গিয়ে ইতিমধ্যে ডিএসসিসি মেয়রের বিরুদ্ধে অর্ধশত মামলা হয়েছে। মামলা মোকাবেলা করে এগোতে হচ্ছে । তবে আমরা শুরু থেকে সক্রিয় ছিলাম এখনও আছি। আবাসিক এলাকার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণের বিষয়ে ডিএসসিসির এ অবস্থান অব্যাহত থাকবে।

মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের পর সংবাদ সম্মেলনে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, আবাসিক এলাকা থেকে প্রথমে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণ করা হবে। হাসপাতাল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অপসারণের ব্যাপারে এলাকাবাসীর মতামত নেয়া হবে। তারা মত দিলে ওই সব স্বাস্থ্য ও শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান থাকবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরপর এক বছরের বেশি সময় পার হলেও ঢাকা বা অন্য কোনো শহর স্থানীয়দের সঙ্গে আলোচনার বিষয়টি থেকে গেছে উপেক্ষিত।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাবাসীর অভিযোগ, আবাসিক এলাকার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণে ঢাকঢোল পিটিয়ে সরকার ছয় মাসের সময়সীমা বেঁধে দিলেও এরই মধ্যে এক বছর পার হয়ে গেছে। কার্যকর কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। নির্ধারিত সময়ে উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ না হওয়ায় নগরবাসী এ সিদ্ধান্তকে লোক দেখানো সিদ্ধান্ত বলে সমালোচনা করছেন।

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-সচিব মাহমুদুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জোর তৎপরতা চালানো হচ্ছে। প্রতি মাসে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত একটি সভা হচ্ছে। সেখানে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছ থেকে প্রাপ্ততথ্য সমন্বয় করে মন্ত্রিপরিষদে পাঠানো হচ্ছে।

তিনি বলেন, সংস্থাগুলোর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় মামলা জটিলতার কারণে কাজ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিকদের নোটিশ ইস্যুর পর সংশ্লিষ্ট সংস্থার বিরুদ্ধে মামলার হিড়িক পড়েছে। এসব মামলা মোকাবেলা করে কার্যক্রম এগিয়ে নেয়া খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/06/29/135423