২৯ জুন ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:৪৯

চাল কিনতে গিয়ে মাথায় হাত সাধারণ মানুষের

চালের বাজার এখন বেশ গরম। নরম হবার কোনও লক্ষণ নেই। চাল কিনতে গিয়ে সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষ পড়ছেন বিপাকে। আজ তারা যেদামে চাল কেনেন, কাল বাজার গিয়ে দেখছেন আরও ২/৩ টাকা বেড়ে গেছে। এমন করেই দ্রুত দাম বাড়ছে চালের। শহর-বন্দর, গ্রাম-পল্লি সর্বত্র চালের দাম এখন ঊর্ধ্বমুখি। কিন্তু নিয়ন্ত্রণের কেউ নেই। দেশ যারা চালাচ্ছেন, চালের দাম নিয়ে কোনও মাথাব্যথা ছিল না এতোদিন তাদের। বেসরকারি আমদানিকারকরা সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার না করলে চাল আমদানিতে উৎসাহ পাচ্ছেন না। মাননীয় খাদ্যমন্ত্রী অবশ্য সম্পূরক শুল্ক প্রত্যারের জন্য দু'মাস আগেই এনবিআরকে চিঠি দিয়েছেন। তিনি বলেন, শুল্ক প্রত্যাহার করা হলে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। মূলত সম্পূরক শুল্কে আটকা পড়েছে চাল আমদানির বিষয়টি। আড়াই লাখ টন চাল ভিয়েতনাম থেকে আমদানির কথা ঘোষণা করেছে সরকার। তবে তা কবে নাগাদ দেশে এসে পৌঁছুবে সেকথা বলা হচ্ছে না।

এবার চালের অভ্যন্তরীণ সংগ্রহও আশানুরূপ নয়। মিলাররা চাল দিতে পারছেন না। সরকারি রেট কম তাই দিচ্ছেন না। এমন অভিযোগও আছে মিলারদের বিরুদ্ধে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন আছে। তেমনই চাল নিয়ে চালবাজি বা কারসাজিও আছে বলে অনেকের ধারণা। সরকারি মজুদও কমে গেছে চালের। ঈদ উপলক্ষে দুস্থদের একলাখ টন চাল দেবার আদেশ জারি হলেও ভাড়ারে পর্যাপ্ত নেই বলে বণ্টন করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দ্রুত সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে বলে সরকারের নীতিনির্ধারক সূত্রগুলোর দাবি।
একটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিদিনই বাজারে মোটা চালের দাম বাড়ছে। চিকন চালের দামও নিয়ন্ত্রণহীন। মোটা চাল ৪৮/৫০ টাকা প্রতি কেজি। পাইজাম ও লতা ৫১/৫২। নাজির ও মিনিকেট ৫৪/৬২ টাকা করে। কোনও কোনও বাজারে আরও বেশি। প্রতিবছর বোরো ফসল উঠলে চালের দাম কিছুটা কমে। এবার উল্টো মানে সব চালের দাম বেড়েছে। টিসিবি'র হিসাব অনুযায়ী বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৪৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ।

নিম্ন আয়ের মানুষ বাজারে চাল কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। তারা বলছেন, চালের দাম পাগলা ঘোড়া হয়ে ঊর্দ্ধমুখে ছুটছে। আগামিতে তাদের ভাত খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে বলে ধারণা। কিন্তু ভাত ছেড়ে কী খাবেন? আটার দামও কি কম? ৪০ টাকা কেজির নিচে খাবার মতো আটাওতো পাওয়া যায় না। বোঝা যাচ্ছে, মঙ্গা আবার দেশের দোরগোড়ে করাঘাত করছে।

১৬ কোটি মানুষের দেশে তিনস্তরে নিদেনপক্ষে ৫০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যপণ্য মজুদ থাকা জরুরি। জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং আমাদের দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশেষজ্ঞদের মতে সরকারি ভাড়ারে কমপক্ষে ১০ লাখ টন, বেসরকারি পর্যায়ে মজুতদার, আড়তদার, মিলমালিক ও খুচরা বাজারে ২০ লাখ টন এবং ভোক্তা পর্যায়ে ২০ লাখ টন খাদ্যপণ্য মজুদ থাকলেই কেবল খাদ্যনিরাপত্তার মাপকাঠি ঠিক থাকে বলে ধরা হয়। গত কয়েক মাসে দেশের খাদ্যব্যবস্থাপনায় ত্রুটির কারণে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তা সরকারি ভাড়ার ও বেসরকারি পর্যায়ের মজুদ মূল্যায়ন করলেই গুমোর ফাঁক হয়ে যাবে।

এবার হাওর অঞ্চলে অকাল বন্যার আঘাত ও দেশের কয়েক জেলায় ব্লাস্ট ভাইরাসের আক্রমণের ফলে বোরো মার খেয়েছে। বেসরকারি খাতে কমেছে চাল আমদানি। গত একবছরে বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি হয় মাত্র ১ লাখ ২৮ হাজার টন। অথচ ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এখাতে চাল আমদানি হয় প্রায় ৩০ লাখ টন।

সরকারের ভাড়ারে গত ৬ বছরের মধ্যে খাদ্যপণ্যের মজুদ সবচেয়ে কম। খাদ্য অধিদফতরসূত্রমতে বর্তমানে সরকারি ভাড়ারে মাত্র ১ লাখ ৯১ হাজার টন চাল আছে। অথচ গত ২০১৫-১৬ তে ছিল ৬ লাখ ৯৬ হাজার টন। এর আগে ২০১৪-১৫ তে ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার টন, ২০১৩-১৪ তে ৬ লাখ ৫৮ হাজার টন, ২০১২-১৩ তে ৬ লাখ ৯৯ হাজার টন এবং ২০১১-১২ তে ৯ লাখ ৯৮ হাজার টন চালের মজুদ ছিল। সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ১৮ জুন, ২০১৭।

বাজারনিয়ন্ত্রণের জন্য ন্যায্যমূল্যে চালসহ সীমিত আকারে কয়েকটি পণ্যের বিক্রি (ওএমএস) শুরু করেছিল সরকার। কিন্তু তেল, ছোলা, চিনি, ডাল দিতে পারলেও চাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানা গেছে। প্রধানখাদ্যপণ্য চাল না দিয়ে শুধু ডাল, তেল ইত্যাদি দিয়ে কী হবে? ভাত না হলেতো বাঙালির পেট ভরে না। ফলে সরকারের ওএমএস কর্মসূচি ব্যর্থ হতে চলেছে। এতে ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো অবস্থা। চালের দাম ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে গরিবের পকেট কাটছেন তারা। পাশাপাশি মিলমালিকরাও চালসরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছেন।
চালের দাম অস্বাভাবিক বাড়বার বিষয়টি স্বীকার করে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, চলতি বোরো মওসুমে লক্ষ্যমাত্রার চাইতে উৎপাদন ১৫ থেকে ২০ লাখ টন হতে পারে। এ পরিস্থিতির সুযোগে কতিপয় ব্যবসায়ী কারসাজি করে বাড়াচ্ছেন। তিনি বলেন, দেশে এখন চালের সংকট নেই। পরিস্থিতি মুকাবিলায় সরকার আড়াই লাখ টন চাল ভিয়েতনাম থেকে দ্রুত আমদানির কথা উল্লেখ করেন। এছাড়া থাইল্যান্ড ও ভারত থেকেও চাল আমদানি করা হবে। সবমিলিয়ে ১০ লাখ টন চাল আমদানি করা হবে। দ্রুতই চালের দাম কমে যাবে বলে মন্ত্রী আশা করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, বর্তমানে চালের যে আমদানিশুল্ক রয়েছে তাতে ব্যবসায়ীরা চাল আমদানি করতে আগ্রহী নন। কেন না, ২৮ ভাগ আমদানিশুল্ক, ব্যাংকঋণ ও পরিবহনখরচসহ আরও যে খরচ রয়েছে তাতে প্রতি কেজি চালের দাম পড়ে যাবে ৪৫ থেকে ৪৭ টাকা। তাই আমদানিশুল্ক না কমালে চাল আমদানি করবেন না ব্যবসায়ীরা।
অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গত মঙ্গলবার বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ চালের আমদানিশুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে কমানোর কথা ঘোষণা করেছেন। তিনি আরও বলেন, এর ফলে চালের দাম অনতিবিলম্বে ৪০ টাকার নিচে নেমে আসবে। দেখা যাক, মন্ত্রীর কথা কতটা কার্যকর হয়।

প্রকৃত অর্থে প্রতিবছরই কমবেশ চাল আমদানি করতে হয়েছে। অথচ ক্ষমতাসীনরা বুকচিতিয়ে বলে বেড়িয়েছেন ‘দেশ খাদ্যেস্বয়ংসম্পূর্ণ। খাদ্যের কোনও অভাব নেই।’ তাহলে প্রায় প্রতিবছর লাখ লাখ টন চাল আমদানি করা হলো কেন? ক্ষমতায় টিকে থাকবার জন্য বুঝি এমন চালবাজি না করলেই নয়? ‘যা নয় তা হয়’ বলে জনগণের চোখে ধূলো দেয়া ব্যতীত কি কোনও উপায় থাকে না? এবার যখন থলের বেড়াল বেরুতে শুরু করেছে তখন প্রায় মাথাখারাপ হবার উপক্রম বৈকি।

চাল আমাদের প্রধানখাদ্য। ধান কম উৎপাদন হলে চাল কমবে এতো স্বাভাবিক ব্যাপার। যেহেতু ধান থেকেই চাল হয়। তবে একটা বিষয় হয়তো অনেকে খেয়াল করেন না। সেটা হচ্ছে ধান বা চাল যখন কৃষকের কাছে থাকে তখন এর দাম প্রায়শ কমই থাকে। গ্রামের হাটবাজারের ধানক্রেতা বা ফড়িয়ারা পর্যন্ত ধানের সঠিক মূল্য দিতে চায় না। দামতো কম দেয়ই। আবার নানাভাবে ওজনেও বেশি নিয়ে নেয় কৃষকদের কাছ থেকে। শুধু কি ফড়িয়া? সরকারি ভাড়ার বা গুদামে ধান বা চাল যাই দিক কৃষককে ঠকানো হবেই। ঠক খাওয়াই যেন তাদের বিধিলিপি। যুগযুগ ধরে কৃষক নানাভাবে প্রতারিত হন। ঠকেন।

বেশি দামে বীজ, সার, কীটনাশক কিনতে হয় কৃষককে। সেচের জন্য জ্বালানি তেল কেনেন তারা। এর দামও আকাশছোঁয়া। কিন্তু তারা যখন ধান বেঁচতে যান হাটে তখন এর দাম কম থাকে। কখনও কখনও ষড়যন্ত্র করে ধানের দাম কমিয়ে রাখা হয়। যেই কৃষকের গোলা থেকে ধান বেরিয়ে মহাজন বা ফড়িয়ার কাছে চলে যায় তখনই বেড়ে যায় দাম। এই মহাজনরাই ঠকায় কৃষকদের বেশি। এরপর সরকারি ভাড়ারে ধান দিলেও সঙ্গে সঙ্গে দাম পাওয়া যায় না। কখনও কখনও তা পেতে ৬ মাস ১ বছর চলে যায়।

অর্থমন্ত্রী মালসাহেব সংসদে দলীয় এমপিদের তোপের মুখে পড়ে টেকো মাথায় হাত বুলালেও গরিবলোককে মাথায় হাত দিতে হয় চাল কিনতে বাজারে গিয়ে। বিশেষত যারা দিন আনেন দিন খান, তাদের অবস্থা খুব খারাপ। মোটা চাল ঢাকার বাজারে এখন ৫০ টাকার ওপর কেজি। চিকন চাল মিনিকেট ও নাজিরশাইল ৬০/৬৫ টাকায় পৌঁছে গেছে। যার পরিবারে ৫/৭ জন খানেওয়ালা তার অন্তত দুতিনবেলার জন্য ৪/৫ কেজি চাল লাগেই। একজন দিনমজুরের দিনে ইনকাম কত? খুব বেশি হলে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। চাল কিনতেই ২০০/২৫০ গেলে অন্য জিনিস কীভাবে কিনবেন? তরিতরকারি, তেল, পেঁয়াজ-মরিচের দামও কম না। অর্থাৎ দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে খেটেখাওয়া মানুষের জীবন। তাই বাজারে গেলে চালসহ নিত্যপণ্যের দাম শুনে মাথা গরম হয়ে ওঠে। অলক্ষ্যেই হাতটা মাথায় চলে যায়। কীভাবে চাল, ডাল, লবণ, তেল, তরকারি কিনবেন? মাছের দিকেতো চোখ ফিরে তাকাবারও ফুরসত থাকে না খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষের। তবে বড়লোক ও সরকারি চাকুরেদের কথা ভিন্ন। সরকারি চাকুরেদের তো বলা চলে অঢেল ইনকাম। বেতন একলাফে ডবল করা হয়েছে। এরপরও বেড়েছে ৫ পারসেন্ট। তাদের চিন্তা কীসের?

যাই হোক, সাধারণ মানুষের প্রধানখাদ্য চাল নিয়ে চালবাজি বা কারসাজি দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর নয়। যেকোনও মূল্যে একশ্রেণির ব্যবসায়ীর দুরভিসন্ধি থেকে চালের মূল্যনিয়ন্ত্রণ করে বাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। এতে ব্যর্থ হলে এর দায়ভার ক্ষমতাসীনরা এড়াতে পারবেন না আদৌ।

http://www.dailysangram.com/post/289560